আজ বুধবার, ১১ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৪শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

হাসপাতাল আর কত দূর

ধনী জেলায় বার্ণ ইউনিট নেই ॥ দুর্ঘটনার পর নেতা-জনপ্রতিনিধিদের ঢল!

রায়হান কবির নিলয়, বিশেষ প্রতিবেদকঃ

ফতুল্লার তল্লা এলাকায় বাইতুস সালাত জামে মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনায় দগ্ধ হবার পর উদ্ধার অভিযানে আসে ফায়ার সার্ভিস। এ্যাম্বুলেন্সে করে দ্বগ্ধদের নিয়ে যায় হাসপাতালে। তেমনি একটি এ্যাম্বুলেন্সে ছিলো ছোট্ট জুবায়ের। যন্ত্রনায় ছটফট করছিলো আর বার বার শুধু বলছিলো, হাসপাতাল আর কতদুর ? হাসপাতাল থেকে অনেক দূর চলে গেছে জুবায়ের, যেখান থেকে কেউ কোন দিন ফিরে আসে না। এ শিশুর বাবা জুলহাস বেপারীও মারা গেছেন গতকাল।

দেশের সবচেয়ে ধনী জেলা হওয়া সত্তেও নারায়ণগঞ্জ কতটা অবহেলিত করোনা মহামারীতে তা একবার প্রমাণ হয়েছে। মসজিদে বিস্ফোরণের পর ফের পরিস্কার হলো এখানকার চিকিৎসা ব্যবস্থা কতটা ভঙ্গুর। স্বজন হারানো পরিবারের সদস্যরা বলছেন, যদি এখানকার হাসপাতালে বার্ণ ইউনিট থাকতো তাহলে চিকিৎসা সেবা আরও আগেই পেতো তারা। এদিকে ভয়াবহ এ বিস্ফোরণের পর গতকাল এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ২৪ জন মারা গেছেন। এদিকে দুর্ঘটনার পর ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিরা। গতকাল স্থানীয়রা জানান, দু’দিন ধরে নেতা আর জনপ্রতিনিধিদের ঢল নেমেছে। তবে সচেতন মহলের মতে, নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিতে কোন্দল আর জনপ্রতিনিধিদের অবহেলার কারনে এখানে উন্নয়ন কাজ সব সময়েই কম হয়।

জুবায়েরের মা রাহিমা খাতুন জানিয়েছেন, বিস্ফোরণের খবর পেয়ে মসজিদে ছুটে যাই। গিয়ে দেখি মসজিদ বিধ্বস্ত। পরে জানতে পারি, ছেলে আর স্বামীকে নারায়ণগঞ্জের ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এরপর সেই হাসপাতালে যাই। সেখানে গেলে চিকিৎসকরা জানান তাদের রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে পাঠানো হয়েছে। রাত ১০ টায় ঢাকা যাই। সন্তান জুবায়ের আর স্বামীকে দেখতে পেয়েছিলাম। রাতে আমার সন্তান মারা যায়। রবিবার মারা গেছে আমার স্বামী।

একই বিস্ফোরনে আহত হয়েছিলেন নয়ন। তাকে কোলে করে নিয়ে এম্বুলেন্সে তুলে দিয়েছিলেন শায়েখ ইমরান মাদানী নামের একজন। তিনি তার ফেসবুকে স্টাটাস দেন, নয়ন নামের এই ছেলেটিকে আমি কোলে করে নিয়ে এম্বুলেন্সে তুলে দিয়েছি। ছেলেটিকে আমি যখন বললাম তোমার আম্মুর নাম্বার বলো, ছেলেটি শুধু বললো জামাতে দাঁড়ানের আগে আমি মায়ের সাথে কথা বলছি ডায়াল কলে নাম্বারটা দেখেন শেষে ৮০৩। আমি যখন কল করি তখন ছেলেটি শুধু বললো আমার মাকে বইলেন না, কান্নাকাটি করবো।

আমি ওর বোনকে কল দিয়ে জানাই ওর বোন আমাকে বললো, ভাইয়া আমরা রওনা দিচ্ছি আপনি আমার ভাইকে একটু খেয়াল রাইখেন। তল্লা থেকে ঢাকা পর্যন্ত নয়নের মুখে শুধু আল্লাহ আল্লাহ শব্দটা শোনা যাচ্ছিল বলে জানান ইমরান মাদানী। জানা গেছে, প্রতিটি এ্যাম্বুলেন্সে থাকা দ্বগ্ধ মানুষগুলোর প্রশ্ন ছিলো, হাসপাতাল যেতে আর কতক্ষন লাগবে।


জানা যায়, আগুনে পোড়া, বিষপান, আত্মহননের চেষ্টা সহ গুরুতর দূর্ঘটনায় শিকার হয়ে নারায়ণগঞ্জের দুই সরকারী হাসপাতালে গেলে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়েই উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে রোগীদের স্পর্শও করেন না কতর্ব্যরতরা। অনেক ক্ষেত্রে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় যাবার পথেই মৃত্যু হয় রোগীর। ধনী একটি জেলায় কেনো উন্নত চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত নারায়ণগঞ্জের মানুষ তা নিয়ে প্রথম প্রশ্ন উঠে করোনাকালে। সর্বশেষ তল্লায় মসজিদে বিস্ফোরনের ঘটনায় আরেকবার সে প্রশ্ন উঠেছে।

জানা যায়, নারায়ণগঞ্জের চাষাড়া থেকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের দুরুত্ব প্রায় ১৮ কিলোমিটার। দ্রুত গতিতে প্রাইভেট গাড়িতে গেলেও পৌছাতে সময় লাগবে ৪৫ মিনিট। একজন মুমূর্ষু রোগীকে নিয়ে সেখানে পৌঁছাতে রোগীর অবস্থার অনেকটাই অবনতি হয়ে যায়। গত ৪ সেপ্টেম্বর এশার নামাজের সময় মসজিদে বিস্ফোরনের ঘটনায় আহত হয় প্রায় ৫৫ জন মানুষ।

এরমধ্যে ৩৭ জনের অবস্থা আশংকাজনক ছিলো। তাদের অনেককে নারায়ণগঞ্জ ১০০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে নিলে অবস্থার অবনতি দেখে সেখান থেকে ঢাকায় রেফার্ড করেন চিকিৎসকরা। নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকায় পৌছানো পর্যন্ত এ্যাম্বুলেন্সে রোগীর আর্তনাদ সঙ্গে যারা ছিলেন তারাই দেখেছেন। এম্বুলেন্সের সাইরেনের শব্দে সে আর্তনাদ বাইরের মানুষের শোনার উপায় নেই।

গতকাল বিস্ফোরণের ঘটনায় দগ্ধদের দেখতে গিয়ে এবং ঘটনাস্থল তল্লার সেই মসজিদে এসে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেছেন, আগুনে পোড়া রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসার বিষয়টি স্থানীয় চিকিৎসকরা সঠিকভাবে জানেন না। এ বিষয়ে তাদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। নারায়ণগঞ্জ একটি বড় অঞ্চল কিন্তু বার্ন ইউনিট নেই। প্রত্যেক জেলায় বার্ন ইউনিট করতে হবে।

করোনাকালে গত ১৬ এপ্রিল শিল্প-প্রতিষ্ঠান, বন্দরনগরী ও জনবহুল নারায়ণগঞ্জ জেলায় কোনও গবেষণাগার নেই শুনে অবাক হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছিলেন, আমি অবাক হচ্ছি, সেখানে কোনও গবেষণাগার নেই?

স্পন্সরেড আর্টিকেলঃ