আজ বুধবার, ১১ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৪শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

সাংবাদিকদের নিয়ে মন্তব্য করায় তোপের মুখে সেলিম ওসমান

সৈয়দ মো. রিফাত
নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সংসদ সদস্য একেএম সেলিম ওসমান সাংবাদিকদের নিয়ে যে তোষামুদে বক্তব্য দিয়েছেন তাতে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সাংবাদিক সমাজ। নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাব ও প্রেসক্লাবের বাইরে একাধিক সাংবাদিক এবং সাংবাদিক নেতাদের সাথে কথা বলে এমন চিত্র বেরিয়ে এসেছে। এমনকি গতকালের প্রথম আলোর সভায় নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের সভাপতি প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সভাপতি এড. মাহবুবুর রহমান মাসুম বলেন, ‘সন্ত্রাস করবেন, সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে যুক্ত হবেন, মানুষ মারবেন, শীতলক্ষ্যায় লাশ ফেলবেন পত্রিকায় তা লেখা হবে আর আপনারা বলবেন ওমুক পত্রিকা ভালো না আমরা ওই পত্রিকা পড়ি না। প্রথম আলো পত্রিকা নারায়ণগঞ্জের গডফাদারদের রোষনলে পড়েছে বার বার। এই পত্রিকা নাকি কেউ ধরেই না, কেউ পড়েই না। প্রথম আলো সারা বাংলাদেশের, সারা পৃথিবীর বাংলা পাঠকদের মধ্যে শীর্ষে অবস্থান করছে। আজকে নারায়ণগঞ্জের গডফাদাররা বলে ওই পত্রিকা নাকি তারা ধরেন না। আমি বলবো, আপনি ধইরেন না। আপনারা যদি ওই পত্রিকা ধরেন তাহলে পত্রিকার জাত চলে যাবে।
গতকাল বিকালে নারায়ণগঞ্জ চাষাড়ার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে প্রথম আলো পত্রিকার ২০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বন্ধুসভার আয়োজিত এক সভায় তিনি এসব কথা বলেন।
মাহবুবুর রহমান বলেন, আজকে যা শুরু হয়ে গেছে। ‘কেউ হয়ে গেছেন আউলিয়া তো কেউ হয়ে গেছেন পীর’। একজন বলেছে আমি সাংবাদিকদের নামে কোন মামলা করি নি, এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অতীতে মামলা হয়েছে। প্রেস ক্লাবের সভাপতি হালিম আজাদ ও নাফিজ আশরাফ সাধারণ সম্পাদক থাকা অবস্থায় আপনি মামলা করেছেন। তিনি বলেছেন আমরা মামলা করি না। সাংবাদিকদের, গণমাধ্যম কর্মীদের আপনি উপদেশ দিতে আসবেন না।
তিনি বলেন, আপনারা সন্ত্রাস করবেন আমরা লিখবো। ভালো কাজ করে দেখান আমরা ভালো লিখবো। নারায়ণগঞ্জে পজিটিভ কাজ করে দেখান? বলেন আমরা ত্বকী হত্যার বিচার চাই। বলেন ১৬৪ ধারায় যে আসামীর কথা বলা হয়েছে তাকে গ্রেপ্তার করা হয় না কেন? এসব বলেন ? আমরা আপনাদের পক্ষে লিখবো। আপনারা যখন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বলেন না উল্টো তাদের পক্ষপাতিত্ব করেন তখন সাংবাদিকদের উপদেশ দিয়ে কোন লাভ নেই। সাংবাদিকরা সারা পৃথিবীতে অন্যায়ের বিরুদ্ধে যেমন সারাজীবন লিখেছে তেমনি ভবিষ্যতেও লিখবে।
অনুষ্ঠানে সকল গণমাধ্যম কর্মীদের সৎ সাংবাদিকতা করার আহবান জানিয়ে মাসুম বলেন, আমরা অতীতে যেমনি করে চলেছি। ভবিষ্যতেও এর ব্যতিক্রম হবে না। আমরা আমাদের মতোই চলবো। আমরা কখনোই নিরেপেক্ষ হতে পারি না। কারন সন্ত্রাসীকে আমরা সন্ত্রাস বলি। ভালো করলে ভালো লেখা হবে। খারাপ করলে খারাপ। যত কালা কানুন আমাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হোক না কেন, আমরা আমাদের মতোই চলবো। আমাদের মূল শক্তি আমাদের কলম। আমাদের হাতে কলম আছে। তাই আমরা মুক্ত চেতনায় লিখেই যাবো। মামলা তো আমরা খাচ্ছি। জেলে তো আমরা যাচ্ছি তাতে কী? আমাদের লেখা কখনোও বন্ধ হবে না।
নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রথম অলোর বন্ধুসভার সভাপতি সাব্বির আল ফাহাদের সভাপতিত্বে এসময় আরও উপস্থিত ছিলেন, সন্ত্রাস নিমূর্ল ত্বকী মঞ্চের আহবায়ক ও সাংস্কৃতিক ব্যাক্তিত্য রফিউর রাব্বী, জেলা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি আবদুস সালাম, সাধারণ সম্পাদক আফজাল হোসেন পন্টি, মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এটিএম কামাল, জেলা সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি এড. জিয়াউল ইসলাম কাজল, জেলা নাগরিক কমিটির সভাপতি এড. এবি সিদ্দিকি ও সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান,বাংলাদেশ ওর্য়াকার্স পার্টি জেলা সভাপতি হাফিজুর রহমান, গণসংহতি আন্দোলন জেলার সমন্বয়ক তরিকুল সুজন প্রমূখ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে খোদ প্রেসক্লাবের সভাপতি ও অন্যান্য নেতাদের সমালোচনা করে নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের জৌষ্ঠ সদস্য, দৈনিক আমাদের সময়ের জেলা প্রতিনিধি, দৈনিক সোজাসাপটার সম্পাদক ও নিউজ নারায়ণগঞ্জের সম্পাদক আবু সাউদ মাসুদ বলেন, “সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ওসমান পরিবারের মামলার সংখ্যা তেমন একটা নাই। হালিম আজাদ ও নাফিস আশরাফের বিরুদ্ধে মামলা করার প্রস্তুতি নিয়েছিল কিন্তু তাদের অনুরোধে পরে তারা আর মামলা করে নাই। সাংবাদিকদের বিষয়ে তারা একটু উল্টা পাল্টা কথা বলে। তবে মামলার বিষয়ে তারা অতটা আক্রমনাত্মক না। আমি যখন মানব জমিনে ছিলাম ‘৯৬ সালে’ তখন শামীম ওসমানকে ‘মুকুটহীন স¤্রাট’ লিখেছিলাম। সে সময় তারা তো আমাকে একাধিক মামলা দিতে পারতো। কিন্তু তারা কোন মামলা দেয় নাই তারা। তাদের সাথে ওসমান পরিবারের যে দ্বন্দ্ব সেটা হলো ত্বকী মঞ্চ নিয়ে। সাংবাদিক হিসেবে ত্বকীর বিচার অবশ্যই চাই। আমি আমার ‘লেখনী’ দিয়ে চাইবো। সাংবাদিক নেতা হয়ে সেখানে গিয়ে সদস্য সচিব হয়ে গেছি। তাদের বিরুদ্ধে মঞ্চে গিয়ে কথা বলি তবে তারাও পাল্টা বক্তব্য দিবে। সেই বক্তব্যটা সাংবাদিক হিসেবে হয় নাই। বক্তব্যটা হয়েছে ত্বকী মঞ্চের সদস্য সচিব হিসেবে। এটা কোন সংবাদপত্রের বিষয় না। আমাদের দাবী ছিল প্রেসক্লাবে সভাপতি এসব বিষয়ে জড়াবেন না। এটা আমাদের জন্য একটা খারাপ রেজাল্ট নিয়ে আসলো। তারা আমাদের কথা শুনে নাই।”
নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাধারন সম্পাদক শরীফ উদ্দিন সবুজ বলেন, “সেলিম ওসমান তো রাজনীতিতে আসছেন অনেক পরে। এর আগে ছিলেন প্রয়াত নাসিম ওসমান ও শামীম ওসমান। এরা সাংবাদিকদের অনেকের চাকরি খাইছে। অনেককে লাঞ্চিত করছে। প্রেসক্লাব অনেক সময় তারা দখলের চেষ্টা করছে। সাংবাদিকদের মধ্যে কোন্দল তৈরী করছে। অনুগত সাংবাদিক তৈরী করছে। হলুদ সাংবাদিক তৈরী করছে। এদের সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অবস্থান সবসময় ছিল। এটা তো নতুন কিছু না। সেলিম ওসমান যদি ভালো উদ্দেশে আহবান জানায় তবে তার সে আহবানের সাধুবাদ জানাই। যে কোন বিরোধ শেষ হওয়া দরকার। কিভাবে দখল করতে চেয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জমি দখলের মতো। সকল সাংবাদিকদের বের করে প্রেসক্লাবে তালা দিয়ে দিবে এমন চেষ্টাও তারা করেছে। যারা সত্য কথা লিখে, যারা তাদের অনুগত না তাদেরকে তারা প্রেসক্লাবে ঢুকতে দেবে না এক সময় এমন প্রচেষ্টা তাদের ছিল। ইদানিং শামীম ওসমান যেটা করে। যে সব ভূমিদস্যুদের পত্রিকা আছে, টিভি চ্যানেল আছে সেসব পত্রিকায় তার অনুগত সাংবাদিকদের নিয়োগ দেয়। সে তার অনুগত ‘সাংবাদিক বাহিনী’ তৈরী করছে। নারায়ণগঞ্জে একজন সাংবাদিক আছে যে নিজের নামের পিছনে ওসমান লাগায়। প্রেসক্লাবের সদস্যদের মধ্যে কেউ ভিন্নমত প্রকাশ করছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ওসমান পরিবারের মামলা যদি কারো নজরে না পড়ে থাকে। যদি না দেখে থাকে তবে সেটা তার ব্যাপার। তৎকালিন সময়ে হালিম আজাদ ও নাফিজ আশরাফকে মামলা দেয়া হয়েছিল। এর প্রতিবাদে নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাব ও বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) কঠোর বিবৃতি দিয়েছিল। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ব্যাপক লেখালেখি হয়েছিল। পরে ওসমান পরিবার মামলা প্রত্যাহার করেছিলেন। আমরা সাংবাদিকরা কাজ করি জনগনের স্বার্থে। মানুষের স্বার্থে। প্রেসক্লাবে যত বিরোধ তৈরী হয়েছে সেটা ন্যায় ও নীতিকথা লিখতে গিয়ে। কারো ব্যক্তিগত কোন চাওয়া পাওয়া নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হয় নাই। একটা সময় শামীম ওসমান প্রেসক্লাবে এসে বসে থাকতো। সে নির্দেশনা দিতো ‘কোন নিউজ হবে, কোন নিউজ হবে না’। ‘ইব্রাহিম হত্যা’র ঘটনার পরে বেশিরভাগ পত্রিকায় তারা সংবাদ প্রকাশ হতে দেয় নাই। ভিন্ন ধারার নিউজ সে তৈরী করছে। তার সন্ত্রাসীরা বিএনপির সমাবেশে হামলা করে ঘটনাকে অন্যদিকে রূপান্তর করেছিল। আমি ওই সময় সত্য নিউজ করেছিলাম। ‘তরুন সাংবাদিকরা সত্য প্রকাশের চেতনা বহন করে’। তারা এই ‘গডফাদারের’ কোমড় ভেঙ্গে দিয়েছে। কোন কিছু নিয়ন্ত্রণ করে রাখার ক্ষমতা এখন আর ওই পরিবারের নেই।”
দৈনিক দিনকালের জেলা প্রতিনিধি কামাল হোসেন বলেন, ‘ওসমান পরিবারের কেউ সাংবাদিকদের মামলা দিয়েছে এমন কোন কথা শুনি নাই।’
দৈনিক ইনকিলাবের জেলা প্রতিনিধি হাফিজুর রহমান মিন্টু বলেন, ‘ওসমান পরিবারের সেলিম ওসমান, শামীম ওসমান সাংবাদিকদের হয়তো হুমকি দিয়েছে। কিন্তু মারধর, মামলা করার কোন রেকর্ড নাই। সাংবাদিক নেতারা তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য এসব কথা বলছেন।’

স্পন্সরেড আর্টিকেলঃ