আজ শুক্রবার, ২৭শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১০ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

সরস ও নিটোল বন্ধুত্ব ছিল আমাদের।

রাজ্জাক সাহেবের সঙ্গে আমার সর্বশেষ কথা হয় একটি টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠানে। তিনি স্টুডিওতে ছিলেন। আমি টেলিফোনে কথা বলি। তিনি বলেছিলেন, অনেক দিন দুজনের দেখা হয় না। আমি তখন ‘চোখ যে মনের কথা বলে’ গানটি গাইলাম একবার। এইটাই তাঁর সঙ্গে আমার শেষ কথা বলা।

যদ্দুর মনে পড়ে, রাজ্জাকের সঙ্গে প্রথম কাজী মাজহারুল আনোয়ারের যোগাযোগ ছবিতে সাইন করেছিলাম। পরে সে ছবিটাতে অভিনয় করা হয়নি। তারপর কাজী জহিরের ময়নামতি চলচ্চিত্রেই মনে হয় প্রথম অভিনয় করি।

রাজ্জাকের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব ছিল। সম্পর্ক ছিল খুনসুটির। সরস ও নিটোল বন্ধুত্ব ছিল আমাদের। চট্টগ্রামে একবার খুব ঝগড়া হয় আমাদের। তারপর অনেক বছর আমরা একসঙ্গে কাজ করিনি। প্রায় ২০ বছর পর আমাদের সন্তান ছবিতে আবার একসঙ্গে কাজ করি।

আমরা তো সব সময় খুনসুটি করতেই থাকি। মানে তাঁর সঙ্গে আমার সব সময় একটা খোঁচাখুঁচি লেগেই থাকত। মতের অমিল হতো। এগুলো এখন মনে পড়ছে আর কী। তিনি বলতেন, ‘এই রাগ করেছেন নাকি?’ আমি বলতাম, ‘এই যাও চুপ, বেশি কথা বলবে না।’

এ বছরের শুরুর দিকে রাজ্জাক যখন অসুস্থ হয়ে পড়েন, তখন আমি তাঁকে দেখতে হাসপাতালে যাই। রাজ্জাকের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলি। রাজ্জাককে হাসপাতাল থেকে বাসায় আনার পর খুব করে বলেছিলেন একদিন বাসায় আসতে। কেন যেন যাওয়া হয়নি। আসলে তাঁর বাসায় যাতায়াতটা আমার একেবারেই ছিল না। একবার বোধ হয় গিয়েছিলাম। রোজ শুটিংয়েই তো দেখা হতো। তাই বাড়িতে যাওয়া-আসা ছিল না।

একবার তাঁর বাসায় গিয়েছিলাম। তখন তাঁর বাসা হলিক্রস স্কুলের ওই দিকে ছিল। ময়নামতি ছবির শুটিংয়ে সাভারে যাওয়ার আগে তাঁকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম। আমাদের তখন খুব একটা ভালো বন্ধুত্ব ছিল। তিনি হয়তো বলতেন, ‘ম্যাডাম আপনি ওই দিকে যাচ্ছেন, আমাকে একটু উঠিয়ে নিয়েন।’ আমিও বলতাম, ‘এই আপনি যাচ্ছেন, আমি একলা যাব? আমাকে একটু উঠিয়ে নিয়েন।’ আমাদের মধ্যে এ রকম একটা বিষয় ছিল। রাস্তাঘাটে দেখা হতো, শুটিংয়ে দেখা হতো। তাই তাঁর বাসায় যাওয়াটা একেবারেই হয়ে ওঠেনি।

রাজ্জাক সাহেব যে নেই, সেটা আমি এখনো ভাবতে পারছি না। আমি এখনো ভাবছি, হয়তো কেউ বলবে, ‘এই রাজ্জাকের সঙ্গে একটা প্রোগ্রাম আছে।’ আমি বলব, ‘রাজ্জাকের সঙ্গে কোনো প্রোগ্রাম করবই না।’

তাঁর সঙ্গে কাজ করতে গেলে আমার লাগালাগি হতো। ঝগড়া লাগত। আমি একটা কথা বললে তিনি উল্টোভাবে উত্তর দিতেন। তিনি একটা কথা বললে আমি মানতাম না। ওই বয়সে একটা ছেলেমানুষি ছিল। মানুষের অনুভূতি বিভিন্ন রকমের হয়। আমরা দুজনে আসলে মারামারি করি, কিলাকিলি করি। হ্যাঁ, আমি কিলাকিলির কথাই বলছি। তাঁর সঙ্গে মনের একটা টান আছে। ঝগড়া হয়েছে, ২০ বছর কথা বলি নাই। আবার যখন কাজ করতে গেছি, সে কথা ভুলেও গেছি। রাজ্জাকের চেয়ে আমি বয়সে ছোট, তা সত্ত্বেও আমাদের বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। এখন বুঝতে পারছি, দুজনেরই কাজের ক্ষেত্রে যে বন্ধন ছিল, তা-ই বোধ হয় কাজ করেছে, একটা শক্ত বন্ধন।

এর মানে এই না যে আমরা দুজন প্রেমিক-প্রেমিকা হিসেবে দুজনকে ভালোবাসি। সেটা ঠিক না। বিষয়টি হলো, কাজের ক্ষেত্রে নিরবধি আমরা চলেছি। বলে না যে, নদী বয়ে যায় নিজস্ব গতিতে। কাজের ক্ষেত্রে সেই নদীটা বেশি সঞ্চারিত হয়েছিল আমাদের মনে। ঝগড়া হলেও একজন আরেকজনকে উপেক্ষা করার কোনো উপায় ছিল না। এটাই হচ্ছে সত্যিকারের বন্ধুত্ব। বন্ধুত্বের বন্ধনটা কতটা গভীর ছিল, তা আজ বুঝতে পারছি। মনে হচ্ছে, আসলেই কি তা-ই? সত্যিই কি রাজ্জাক মারা গেছেন? আমাদের দুজনের মধ্যে নিয়মিত কথা, দেখা হয়তো ছিল না। তারপরও অনুভব করছি বন্ধুত্ব।

কত কথাই তো মনে হচ্ছে আজ। আমরা কখনোই রেস্তোরাঁয় গিয়ে একসঙ্গে খাইনি। আমার বাবা খুব ভালো রাঁধতেন। তো শুটিং শেষে রাজ্জাক আমাদের বাসায় আসতেন। আব্বা বলতেন, ‘বাবাজি একটু খেয়ে যাও।’ রাজ্জাক বলতেন, ‘ইশ্, কাকাবাবু আপনার হাতের রান্না যা মজা।’ তিনি প্রায়ই আমাদের ঢাকার বাসায় আসতেন।

রাজ্জাকের সঙ্গে আমার অলিখিতভাবে বা গোপনভাবে কোনো কিছু ছিল না। যে বন্ধুত্ব হয়েছে, তা আন্তরিকতায় পূর্ণ। স্বার্থ নানা রকম হয়। আমাদেরও স্বার্থ ছিল। কিন্তু সেই স্বার্থ নিষ্পেষিত করতে পারেনি বন্ধুত্বটা। আমাদের দুজনের বন্ধুত্বকে একজন একজনের প্রতি ভালোবাসা-শ্রদ্ধাকে কলুষিত করতে পারেনি, এটাই আজ মনে হচ্ছে।

স্পন্সরেড আর্টিকেলঃ