আজ বৃহস্পতিবার, ১৪ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ, ২৮শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

শেষ ঠিকানায়ও দুই নম্বরী

আনোয়ার হাসান ও বিল্লাল আহম্মেদ:
মাসদাইর কবরস্থানে একটি কবরের জায়গা ক্রয়ের জন্য বর্তমানে ২৫ লাখ টাকা গুনতে হয় মৃতের স্বজনকে। তবে অনেকে জায়গা না ক্রয় করেই বছরের পর বছর বাশেঁর বেড়া দিয়ে সাইনবোর্ড লাগিয়ে রাখেন। সাইনবোর্ডে লেখা হয়, জায়গা খরিদের জন্য নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনে আবেদনকৃত। প্রায় ৮ বছর আগে সিটি করপোরেশনে রূপান্তর হলেও কোন কোন কবরের সাইনবোর্ডে এখনও লেখা রয়েছে, নারায়ণগঞ্জ পৌরসভায় আবেদনকৃত। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অনেকে আবেদনই করেননি, কেউ আবার আবেদন করলে জায়গা কেনার বাদবাকী কাজ সারেননি। করস্থানে নিয়োজিত কর্মচারীদের ম্যানেজ করে কবরের জায়গা দখল করে রেখেছে বলে জানান স্থানীয়রা। তাদের কারনে বিড়ম্বনায় পড়তে হয় কবর খোঁড়ার কাজে নিয়োজিতরা।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, জীবিত ! ব্যক্তির কবরের জন্যও এমন বেড়া লাগানো হয়েছে। তাতে সাটানো সাইনবোর্ডে লেখা সেই একই শব্দ ‘আবেদনকৃত’। নাসিক সূত্রে জানা গেছে, ২০১১ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন থেকে মাত্র ৯ টি কবরের জমি বিক্রি করা হয়েছে। আগে একটি কবরের জন্য ৭ লাখ টাকা নেয়া হলেও ২০১১ সালের পর তা বাড়িয়ে ১০ বছরের ৭ লাখ ও ২০ বছরের জন্য ১৪ লাখ টাকা ধার্য্য করা হয়। তবে বর্তমানে একটি কবরের জন্য ২৫ লাখ টাকা দিতে হবে মৃতের স্বজনদের। সূত্রে আরও জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার আমলে এক সময় এই কবরস্থানে একটি কবরের জমি ২৫ হাজার টাকায় বিক্রি করা হতো। বিক্রিকৃত কবর গুলোর মেয়াদ শেষ হয়েছে। তবে নাসিকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ২০১১ সালের আগে ক্রয় করা সব কবরের জায়গা আজীবনের জন্য মালিকানা দেয়া হয়েছে।

ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের পুরনো সড়কের পাশে মাসদাইরে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কেন্দ্রীয় মসজিদ ও কবরস্থান অবস্থিত। তবে লোকমুখে মাসদাইর গোরস্থান নামেই এ এলাকা পরিচিত। এলাকাটি এনায়েতনগর ইউনিয়ন পরিষদের আওতাভুক্ত।

সরেজমিনে দেখা গেছে, মাসদাইর কবরস্থানের দু’পাশ মিলিয়ে প্রায় ২শ’৩০ টি কবরে বাশেঁর বেড়া দেয়া আছে। এছাড়া চারপাশে ইটের প্রাচিরসহ লোহার খাঁচা দেয়া রয়েছে প্রায় ৩শ’৫৫ টি কবরে। একটা বাঁশের বেড়ার সামনে এসে থমকে দাঁড়াতে হয় প্রতিবেদকদের। এখানে বাশেঁর বেড়া থাকলেও নেই কোন কবর। নাসিকে জমির জন্য আবেদন করেই কবরের চারপাশে বেড়া দেয়া হয়েছে অনেক বছর আগে। স্থানীয়রা জানান, বেড়া দিয়ে তারা নিজেদের পারিবারিক কবর বানিয়ে ফেলেছেন। অনেক দিন ধরে এখানে কবর না দেয়া হলেও দখল ছাড়েননি তারা।

২২ বছর ধরে কবরস্থানে কাজ করেন জয়নাল মিয়া। তিনি জানান, বাশেঁর বেড়া অনেক কবরে আছে। তার মতে ৬০ টি কবরের চার পাশে অনুমতি ছাড়া বেড়া নির্মাণ করা হয়েছে। অনেক কবরের শির না উঠিয়ে বেড়া দিয়ে রাখা হয়েছে। তাদের পরিবারের কোন সদস্য মারা যাওয়ার পর যাতে করে সেখানে দাফন করতে পারে এ কারনেই এ ব্যবস্থা।

স্থানীরা জানান, বাশেঁর বেড়া ও পাকা করা সব কবরের জমি নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশ থেকে বিক্রি হয়নি তা অনেকেই জানে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কবরের জমি দখলের জন্য এ কৌশল করা হয়ে থাকে। কোন ব্যক্তিকে কবর দেয়ার পর তার স্বজনরা কয়েক দিনের মধ্যে কবরের চারপাশে বাশেঁর বেড়া দেন। যখন এই বেড়া পুরনো হয়ে যায় তখন তারা ইটের প্রাচির (পাকা) করে ফেলে। তখন এ দেখে মনে হবে এটা অনেক পুরনো কবর। স্থানীয়দের মতে, নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন থেকে কবরের জমি বিক্রি করা হয় না বলে এ ধরনের কৌশল অবলম্বন করে মৃতের স্বজনরা। তাদের মতে, এটা এক ধরনের দুই নম্বরী। কবরস্থান হলো শেষ ঠিকানা, এখানেও এমন কারবার মানুষের শোভা পায় না। ভুক্তভোগীরা জানান, এভাবে জায়গা দখলের প্রতিযোগীতা নামায় মৃতের কবর দিতে গিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হয় স্বজনদের। কবর খুড়তে গেলে বেড়িয়ে সদ্য কবর দেয়া মৃতের দেহাংশ। নিয়মিত কবর খুঁড়েন এমন একজন জানান, বেড়া ও প্রাচীরে ঘেরা কবরের সংখ্যা বেশী হওয়ায় অনেক নতুন কবরে ফের কবর দিতে হয়। অনেক সময় খানিকটা খোঁড়াখুঁড়ির পর দেখা যায় কবর দেয়া আগের লাশ মাটিতে মেশেনি। পরে বাধ্য হয়ে অন্য জায়গায় কবর খুঁড়তে হয়।

নাসিকের ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও মাসদাইর কবরস্থানের তত্বাবধায়ক মাকসুদুল আলম খন্দকার খোরাশেদ জানান, ২০১১ সালে একটি আইন করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘১১ সালের আগে যে সব কবর কেনা হয়েছে তা আজীবনের জন্য। এরপর থেকে কবরের জায়গার দাম বাড়ানো হয়েছে। প্রথমে ৭ লাখ টাকা করা হলেও এখন একটি কবরের জন্য ২৫ লাখ টাকা দিতে হয়। সামনে আরও বৃদ্ধি করা হবে কারণ আমাদের উদ্দেশ্য হলো, যেন কেউ কবরের জন্য জায়গা না কেনে। অনুমোদন ছাড়া যারা বাঁশের বেড়া দিয়েছেন তারা সিটি করপোরেশনে আবেদন করে তিন মাসের জন্য অনুমোদন নেন। তিনি দাবি করেন, মানবিক কারনে আমরা তেমন খোঁজ নেইনা। তবে প্রতি বছর অবিক্রিত কবরে দেয়া বেড়া আমরা ভেঙ্গে দেয়া হয় বলে দাবি করেন এ জনপ্রতিনিধি।

এ বিষয়ে নাসিকের পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন হিরণ জানান, বেড়ার জন্য মাসদাইর কবরস্থানে জায়গার সংকট দেখা দিয়েছে। বর্তমানে কবরের জমির দাম অনেক। তাই কেউ সহজে কিনতে আসে না। তারা একটি সাইন বোর্ড টানিয়ে দেয় আবেদন করা হয়েছে কিন্তু এটা ভূয়া। আমাদের এখান থেকে আবেদন করার পর আমরা শুধু মাত্র মৃত ব্যক্তির নাম ঠিকানা দেয়ার জন্য একটি প্লেটের অনুমতি দিয়ে থাকি। তিনি আরও জানান, অনেক কবর পাকা করেছেন এমন অনেকে অনুমতিপত্র বা রশিদ দেখাতে পারে না। এজন্য বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে থাকেন মৃত ব্যক্তির স্বজনরা। এছাড়া অনেকে রাতের আঁধারে পাকা করে ফেলে। কিন্তু এ বিষয়ে আমরা জানতে পারি না। সেখানে যারা দায়িত্বে আছেন তারাও আমাদের জানান না। পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা আরও জানান, প্রতিবছর শবে বরাতের আগে অনেক কবরে নতুন করে বেড়া দেয়া হয়। কবরস্থান র্স্পশকর স্থান হওয়ায় আমরা তা দেখেও কিছুই করতে পারি না। তবে এবার কারো মনে কষ্ট না দিয়ে সকলের স্বার্থে আমরা একটি নোটিশ করবো। এরপর দ্রুত সময়ের মধ্যে বেড়া অপসারণ করবে নাসিক।

এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ জানান, বিষয়টি সমন্ধে আমি অবহিত আছি। আমরা দেখছি।

স্পন্সরেড আর্টিকেলঃ