আজ বৃহস্পতিবার, ১২ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৫শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

শিশু ধর্ষিতাকে হুমকিতে এলাকা ছাড়া

#চানমারির ইমামের বিরুদ্ধে চার্জশীট

নিজস্ব প্রতিবেদক:

৮ বছরের শিশুকে ধর্ষণ ধর্ষণ করার পর মসজিদের ইমাম ফজলুর রহমান ওরফে রফিকুল ইসলাম ওই শিশুটির বাসার সামনে পাহারা বসান। যাতে কোনভাবে তারা পুলিশকে জানাতে না পারে। এদিকে শিশুটির শারীরিক অবস্থা খারাপ হতে থাকলে শহরের ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। সেখান থেকে শিশুটিকে অপহরণ ও হত্যার জন্য কয়েক দফায় চেষ্টা করা হয়েছিলো। শিশুটির বাবা হাসপাতালের এক কর্মীর বোরকা পরে আদমজী এলাকায় গিয়ে র‌্যাবকে সব জানান। ঘটনার ৫দিনের মাথায় ধর্ষক ও তার ৫ সহযোগীকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব-১১। এদিকে ইমাম কারাগারে থাকলেও প্রভাবশালীদের হুমকি ধামকিতে ওই শিশুর পরিবার কায়েমপুর এলাকার ভাড়া বাসা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে। আদালত সূত্র জানায়, করোনাকালে ভার্চুয়াল কোটে জামিনের আবেদন করেছিলো অভিযুক্ত ইমাম ও তার সহযোগীরা।

সূত্র আরও জানায়, এ মামলায় এজাহারভুক্ত ৮ আসামীর মধ্যে মনির (৪৫) ও ফকির আলম (৫২) কে মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়ে মার্চ মাসে বাকী ৬ জন ফজলুর রহমান ওরফে রফিকুল ইসলাম, মসজিদটির পরিচালনা কমিটির সভাপতি শরীফ হোসেন, ইমামের সহযোগী রমজান আলী, গিয়াস উদ্দিন, হাবিব এ এলাহি এবং মোতাহার হোসেনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। এ বছরের ১৮ মে ভার্চুয়াল কোর্টের মাধ্যমে আসামীদের জামিন চাইলে আদালত জামিন নামঞ্জুর করেন।

উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের ২ আগস্ট সকালে সদর উপজেলার ফতুল্লা থানার চানমারি এলাকায় বায়তুল হাফেজ জামে মসজিদের তৃতীয় তলায় ইমাম ফজলুর রহমানের ব্যক্তিগত কক্ষে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। পরে পরিবারের অভিযোগের ভিত্তিতে ৭ আগষ্ট ফতুল্লার চাঁদমারি ও ইসদাইরসহ বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে ধর্ষক ফজলুর রহমানসহ ছয়জনকে আটক করে র‌্যাব-১১।

শিশুটির পরিবার জানায়, বাসায় গিয়ে ঝাড় ফ্’ুকে কাজ না হওয়ায় চানমারি এলাকার বাইতুল হাফেজ জামে মসজিদের ইমাম ফজলুর রহমান ওরফে রফিকুল ইসলাম শিশুটিকে নিয়ে গত বছরের ২ আগস্ট শুক্রবার ফজর নামাজের পরপরই মসজিদে আসতে বলেন। কথা মতো ৮ বছর বয়সী কণ্যাকে নিয়ে যায় তার বাবা। এরপর বাবাকে মোমবাতি ও আগরবাতি আনতে পাঠিয়ে মসজিদের তিন তলায় অবস্থিত নিজের বেডরুমে শিশুকে বেঁধে ধর্ষণ করে ওই ইমাম। ভোরে দোকানপাট খোলা না থাকায় ৪৫ মিনিট পর বাবা এসে দেখে তার মেয়ে অসুস্থ। তাকে নানাভাবে বুঝিয়ে মেয়েকে তুলে দেয়। শিশুটি বাড়ি যাওয়ার পর বাবা-মাকে সে জানায়, তাকে ধর্ষণ করেছে ওই ইমাম। ধর্ষণের পর গোসল করিয়েছে। শুক্রবার এই ঘটনার পর অসুস্থ শিশুটিকে চিকিৎসা নিতেও বাধা দেয় ইমাম ও তার কয়েকজন সহযোগী।

৪৫ মিনিটে যা করলো ইমাম
শিশুটির বাবা গেছে মোমবাতি-আগরবাতি আনতে। ইমামের কথামতো মসজিদের মোয়াজ্জেম গেটে তালা মেরেছে, যাতে আর কেউ ঢুকতে না পারে। মসজিদের তিন তলায় নিজের রুমে ইমাম রফিকুল ও ওই শিশুটি ছাড়া আর কেউ নেই তখন। এক পর্যায়ে শিশুটির দুই হাত পিছনে বেঁধে ফেলে রফিকুল। শিশুটি চিৎকার করলে মুখে টেপ মেরে দেয়। তারপর শিশুটিকে ধর্ষণ করে সে। পাশবিক নির্যাতনের প্রমান মুছে ফেলতে মসজিদের ছাদে নিয়ে শিশুটির শরীরে পানি ঢালে সে। এরপরে শিশুটির গলায় ছুরি ধরে হুমকি দিয়ে বলে, ‘ যদি তোর বাবা মাকে বলিস তবে তোকে জবাই করে ফেলবো।’

ফোন করে পান আনতে বলেছিলো
ধর্ষক রফিকুল ভালো করেই জানতো ভোর সোয়া ৫টায় চানমারি এলাকায় কোন দোকানপাট খোলা থাকে না। তাই আগেই ধর্ষণের পরিকল্পনা করে শিশুটির বাবাকে বাইরে পাঠায় সে। ঝাড় ফুঁ’কের জন্য এক প্যাকেট মোমবাতি ও এক প্যাকেট আগরবাতি দরকার বলে শিশুর বাবাকে পাঠায় তা আনতে। তার কথা মতো শিশুর বাবা তা আনতে গিয়ে দেখে সব দোকানপাট বন্ধ। তবুও মেয়ের সুস্থতার আশায় সে অনেক দূর পর্যন্ত চলে যায়। তার আগমন আরও দেরী করাতে ইমাম রফিকুল তার মোবাইল ফোনে কল বলে, ‘আমার জন্য পান কিনে আনিও’।

ঘটনার শুরু
নির্যাতনের শিকার শিশুটি ২য় শ্রেনীতে অধ্যয়নরত। শিশুটি রাতের বেলায় বিভিন্ন প্রকার দুঃস্বপ্ন দেখে কান্নাকাটি করত। বিভিন্ন প্রকার কবিরাজি চিকিৎসা করে ভালো না হওয়ায় ইমাম ফজলুর রহমান ওরফে রফিকুলের কাছে নিয়ে আসে। সে দুই-তিনবার পানি পড়া দেয়। এতে কাজ না হলে ভিকটিমের বাসায় গিয়ে ‘বাড়ি বন্দি’’ নামক চিকিৎসা করে আসে। বৃহস্পতিবার মাগরিবের সময় ভিকটিমের বাবা ইমাম ফজলুর ওরফে রফিকুলকে ফোন দিয়ে মেয়ের চিকিৎসার ব্যাপারে বললে পরের দিন অর্থাৎ শুক্রবার ফজরের আজানের সাথে সাথে মেয়েকে নিয়ে মসজিদে আসতে বলে রফিকুল। এই নরাধমের কুটচাল ঘুর্নাক্ষরেও টের পায়নি শিশুটির সহজ সরল বাবা। সে সময়মতো মেয়েকে নিয়ে আসে আবার ইমামের কথামতো মোমবাতি-আগরবাতি আনতে বাইরে যায়।

এরপরের ঘটনা আরও ভয়াবহ

বাড়ি ফিরে শিশুটির শারিরীক অবস্থার অবনতি ঘটে। এক পর্যায়ে সে বাবা-মাকে বলে দেয় ইমামের পাশবিক নির্যাতনের কথা। মেয়ের মুখে সব কথা শুনে মসজিদে এসে বিচার দিলে মসজিদ কমিটির কিছু সংখ্যক লোক ও আশে পাশের ধর্ষকের কিছু ভক্ত মিলে শিশু ও পরিবারটিকে মারাত্বক ভাবে হেনস্থা করে। ধর্ষক ফজলুর রহমান তার অনুসারীদের দিয়ে এমন একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি করে যে, ভুক্তভোগী পরিবারটি যেন থানা বা হাসপাপতালেও যেতে না পারে।

হাসপাতালে হত্যার চেষ্টা

মসজিদের ইমাম ও তার ভক্তদের ভয়ে শিশুটিকে নিয়ে বাড়ি ফিরে যায় তার পরিবার। তবে অবস্থার অবনতি হলে ধর্ষণের শিকার শিশুটিকে নিয়ে গোপনে নারায়ণগঞ্জ জেনারেল (ভিক্টোরিয়া) হাসপাতালে ভর্তি করে। খবর পেয়ে ধর্ষক ও তার অনুসারীরা শিশুটিকে হত্যা এবং অপহরণ করার উদ্দেশ্যে কয়েক দফায় চেষ্টা চালায়। তারা গোটা হাসপাতালের তাদের খুঁজে বেড়ায়।
এমন পরিস্থিতি দেখে শিশুটিকে হাসপাতালে লুকিয়ে রাখে। ওই সময়ে ওর বাবা মা দীর্ঘসময় ধরে হাসপাতালের টয়লেট ও বেডের নিচে লুকিয়ে থাকে।

বোরকা পড়ে র‌্যাব অফিসে বাবা

ধর্ষণের শিকার শিশুকে যখন ধর্ষক ও তার সহযোগীরা খুঁজছিলো তখন অজানা আতংক দেখা দেয় শিশুটির বাবার মনে। সে বুঝতে পারে, হাসপাতাল থেকে ধরে নিয়ে তাদের বড় ধরনের ক্ষতি করবে তারা। টয়লেটে আর বেডের নীচে লুকিয়ে থাকার পর এক পর্যায়ে একজন নার্সের কাছে বোরকা চেয়ে নেয় সে। আর সেই বোরকা পড়েই আদমজীস্থ র‌্যাব-১১’র সদর দফতরে গিয়ে অভিযোগ দেয় একজন ইমামের দ্বারা পাশবিকতার শিকার হওয়া এক ছোট্ট শিশুর অসহায় বাবা।

বোরকার নীচে হাহাকার

নির্যাতনের শিকার ওই শিশুর বাবা একটি গার্মেন্টে পাহারাদারের কাজ করে। বেতনের বিনিময়ে হলেও অন্যের সহায়-সম্পত্তি রক্ষায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ সে। তবে নিজের ছোট্ট মেয়েটির এমন অবস্থার পর মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে সে। ধর্ষণের বিচার চাইতে গিয়ে মসজিদ কমিটি ও আশপাশের কিছু মানুষের আচরণে চেনা পৃথিবীটা হঠাৎ করে অচেনা মনে হয় তার কাছে। তার মনে প্রশ্ন উঠে, সারাক্ষন নামাজ পড়া মানুষগুলো যদি এমন হয় তবে অন্যরা কেমন হবে। বোরকা পড়ে যখন র‌্যাব অফিসে যাচ্ছিলেন তখন, মনের ভিতরটা হাহাকার হয়ে উঠে তার। শিশু মেয়েটির কষ্টের কথা ভাবতে গিয়ে দু’চোখ বেয়ে পানি ঝড়ছিলো। এতটুকু মেয়ের যন্ত্রনার ছটফট করার চিত্র মনে ভেসে উঠে তখন বুকটা ফেটে যাচ্ছিলো নিদারুণ কষ্টে।

হাসপাতালে নিরাপত্ত চৌকি ——

র‌্যাব-১১ এর সে সময়ের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আলেপ উদ্দিন এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, ৬ আগস্ট এক ব্যক্তি এসে এই মর্মে একটি অভিযোগ দেয় যে, তার মেয়ে বর্তমানে ভিক্টোরিয়া জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে। ২য় শ্রেনীতে পড়–য়া তার মেয়েকে মসজিদের ইমাম ধর্ষণ করেছে। ধর্ষণের পর ইমামের অনুসারীরা তাকে ও মেয়েকে মেরে ফেলার জন্য বার বার হাসপাতালে গিয়ে খুঁজছে। ঘটনা শুনার পর তাৎক্ষণিকভাবে র‌্যাব-১১ এর একটি অভিযানিক দল হাসপাতালে গিয়ে ঘটনার সত্যতা পায়। পরে হাসপাতালে তাদের নিরাপত্তা দেয়ার জন্য নিরাপত্তা চৌকি স্থাপন করে। এরপর আভিযানিক দলটি ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও ধর্ষককে গ্রেপ্তারে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে। ২ দিনের চেষ্টায় ০৭ আগস্ট সকাল ৬টায় নারায়ণগঞ্জ জেলার ফতুল্লা থানাধীন উত্তর চাষাঢ়া চানমারীস্থ এলাকা হতে ধর্ষক ফজলুর রহমান @ রফিকুল ইসলাম (৪৫) কে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারকৃত নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া থানার সরাপাড়া এলাকার মৃত রিয়াজ উদ্দিনের ছেলে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ধর্ষক তার কু কর্মের কথা স্বীকার করেছে।

ঐ দিন দুপুরে র‌্যাব-১১ অধিনায়ক (সিও) লেফটেনেন্ট কর্নেল কাজী শামসের উদ্দিন প্রেস ব্রিফিংয়ে গণমাধ্যমকে জানান, ধর্ষনের শিকার শিশুটির বাবা একটি গার্মেন্টস কারখানার নৈশ প্রহরী ও মা গার্মেন্টস কর্মী। তাদের তিন মেয়ের মধ্যে এই শিশুটি সবার ছোট। ধর্ষক ফজলুর রহমান ওরফে রফিকুল ইসলাম চাঁদমারি বায়তুল হাফেজ জামে মসজিদে ইমামতি ছাড়াও পার্শ্ববর্তী একটি মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। নারায়ণগঞ্জ শহরের দেওভোগ এলাকায় স্ত্রী-সন্তানসহ ভাড়া বাসায় বসবাস করছেন তিনি। ধর্ষনের শিকার শিশুটি বেশ কিছুদিন যাবত প্রায় রাতেই দুঃস্বপ্ন দেখে ভয় পেতো। এতে শিশুটি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। স্থানীয় কয়েকজনের পরামর্শ মতে ঝাড় ফুঁক ও পড়া পানি আনার জন্য শিশুটির বাবা চাঁদমারি এলাকায় বায়তুল হাফেজ জামে মসজিদের ইমাম ফজলুর রহমানের কাছে শিশুটিকে নিয়ে যায়। ইমাম ফজলুর রহমান এ সময় ঝাড় ফুঁকের জন্য আগরবাতি মোমবাতি আনার জন্য কৌশলে শিশুটির বাবাকে দোকানে পাঠিয়ে মসজিদের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে দেয়। পরে নিজের রুমে শিশুটিকে নিয়ে হাত বেঁধে ও মুখে স্কচটেপ লাগিয়ে ধর্ষণ করে। পরে মসজিদের ছাদে পানির ট্যাংকির পানি দিয়ে শিশুটির কোমর থেকে পা পর্যন্ত ধুয়ে পরিস্কার করে দেয়। এরপর শিশুটিকে জামাকাপড় পড়িয়ে ইমাম ফজলুর রহমান ছুরি দেখিয়ে শিশুটিকে ভয় দেখায় এবং এ ঘটনা কাউকে জানালে জবাই করে হত্যার হুমকি দেয়।

গতকাল এ প্রতিবেদক কায়েমপুর এলাকায় ওই শিশুটির পরিবারকে খুঁজতে গেলে এলাকাবাসি জানায়, ধর্ষণণের শিকার হওয়ার কয়েক মাস পর শিশুকে নিয়ে তার পরিবারের লোকজন অন্য এলাকায় চলে গেছেন। এলাকার বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তির চাপে কায়েমপুর ভাড়া বাসা থেকে তারা চলে যান।

স্পন্সরেড আর্টিকেলঃ