আজ শুক্রবার, ১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

মাসে ২ বার ডাক্তার আসে

সাবিত আল হাসান:

প্রতিমাসে দুই থেকে তিনবার নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার নদীবেষ্টিত ইউনিয়ন বক্তাবলীতে যান ডা. আবু সায়েম ভুঁইয়া। উদ্দেশ্য, বক্তাবলীর কানাইনগর সরিফুন্নেসা উপ – স্বাস্থ্য কেন্দ্রে উপস্থিত হওয়া। কিন্তু সেখানে সেবাপ্রার্থী রোগীর সাথে হয়না তার সাক্ষাৎ। স্রেফ হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করে ফিরে আসেন বক্তাবলী থেকে। গত ৫ বছর ধরে এমনটাই চলছে বলে অভিযোগ স্থানীয় বাসিন্দাদের। বক্তাবলীতে বসবাসরত ৫০ হাজার মানুষকে সরকারি সেবা দিচ্ছেন একজন মেডিকেল সহকারী ও একজন শারীরিক অক্ষম চতুর্থ শ্রেনীর এক কর্মচারী।

বক্তাবলী সবুজ শস্য ক্ষেতের স্বর্গরাজ্য। শহর থেকে যাতায়াতের মাধ্যম ফেরী অথবা ট্রলার। গ্রামীন এলাকা, বিস্তির্ন ফসলী জমিতে পরিপূর্ন। কানাইনগর স্বাস্থ্য কেন্দ্রের অবস্থান বক্তাবলী ফেরী ঘাট থেকে বেশ ভেতরে। এক পাশেই রয়েছে কানাইনগর উচ্চ বিদ্যালয় এবং পরিবার পরিকল্পনা অফিস। ভোটের মানচিত্রে এলাকাটি নারায়ণগঞ্জ ৪ আসনের অন্তর্ভুক্ত। ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন সাংসদের ঘনিষ্ট সহচর শওকত আলী। নারায়ণগঞ্জে স্বাস্থ্য সেবা নিয়ে যেই সাংসদের এত ত্যাগ তিতিক্ষা, তার এলাকায় স্বাস্থ্য সেবার এমন করুন চিত্র স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন তুলেছে কথাগুলোর বাস্তবতা নিরীক্ষা করতে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, শেষ কবে বক্তাবলী উপ – স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ডাক্তারের সেবা পেয়েছেন তা মনে করতে পারছেন না কেউই। সরকারি সেবাদানের জন্য রয়েছেন মেডিকেল সহকারী এবং একজন পিয়ন। তাদের হাত ধরেই বক্তাবলীর ৫০ হাজার বাসিন্দা পেয়ে আসছেন সরকারি স্বাস্থ্যসেবা। অন্যথায় অন্তত ২ ঘন্টা সময় ব্যয় করে তাদের আসতে হবে শহরের ভিক্টোরিয়া জেনারেল হাসপাতালে কিংবা খানপুর ৩০০ শয্যা হাসপাতালে। প্রশ্ন হচ্ছে, তবে কেন বছরের পর বছর ডাক্তারকে ৭০ হাজার টাকা মাসিক বেতন দিয়ে পদে আসীন রাখা হয়েছে বক্তাবলীতে?

সংশ্লিষ্ট সুত্র জানায়, ২০১৪ কিংবা ১৫ সালে বক্তাবলী উপ স্বাস্থ্য কেন্দের দায়িত্ব পান ডা. আবু সায়েম ভুঁইয়া। এর পর কেটে গেছে ৫/৬ বছর। কিন্তু স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে বিন্দুমাত্র কোন আগ্রহ দেখাননি তিনি ও নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ। অভিযোগ, মাসে ২/৩ দিন হাসপাতালে এসে হাজিরা খাতায় সিগনেচার করে চলে যান। হাসপাতালে আগত সেবাপ্রার্থীদেরা এসে মেডিকেল এসিসটেন্টকে জানান তাদের সমস্যার কথা। তিনিই উপসর্গ দেখে ঔষধ দিয়ে দেন আর সেসব সরবরহ করেন শারীরিক অক্ষম এক চতুর্থ শ্রেনীর কর্মচারী। কারন হাসপাতালটিতে বর্তমানে ঔষধ বিতরনের জন্য ফার্মাসিস্ট নেই।

শুধু তাই নয়, করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের ডাক্তার আবু সায়েম বর্তমানে ঢাকায় করোনা রোগীদের সেবায় নিয়োজিত রয়েছেন। একই ভাবে মেডিকেল এসিসটেন্টকে নিয়ে আসা হয়েছে নারায়ণগঞ্জে করোনা রোগীদের সেবায়। ফলে বক্তাবলী উপ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে সেবা দেয়ার মত রইলো না কেউই। কোরবানী ঈদের পরে ফিরতে পারেন নিজ কর্মস্থলে এমনটাই জানিয়েছেন স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

সুত্রটি আরও জানায়, প্রায় ৬ মাস পূর্বে একই অভিযোগে ডাক্তার আবু সায়েমের বিরুদ্ধে ওঠার পর তাকে শোকজ করা হয়েছিলো সদর উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে। কিন্তু সেই শোকজের পরেও বহাল তবিয়তে নিজ দায়িত্বে থেকে যান। কথিত আছে, উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও ডাক্তার আবু সায়েমের গ্রেড প্রায় কাছাকাছি হওয়ায় কেউ কাউকে পরোয়া করেন না। আর এসকল দাপ্তরিক জটিলতায় বক্তাবলীবাসী পাচ্ছেন না সরকারি স্বাস্থ্য সেবার সুবিধা।

উপ স্বাস্থ্য কেন্দ্রের পাশের দোকানি মকবুল হোসেন বলেন, গত কয়েকবছর ধরে এখানে কোন ডাক্তার আসেনা। সকাল ১১টায় স্বাস্থ্য সহকারী আইসা ১ ঘন্টা রোগী দেইখা চইলা যাইতো। এখন তারেও করোনার জন্য শহরে নিয়া গেছে। এখন খালি অফিস খুইলা কয়টা ঔষধ দিয়া দেয়। ডাক্তার দেখানের মত কেউই নাই এখানে। বাধ্য হইয়া মানুষজন ফার্মেসিতে নিজেগো অসুখের চিকিৎসা করায়। বক্তাবলীর অধিকাংশ মানুষই গরিব, তারা শহরে গিয়া বড় ডাক্তার দেখনের টাকা পাইবো কই?

একই অভিযোগ করেন কানাইনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি খোরশেদ আলম বলেন, শেষ কবে এই কেন্দ্রে ডাক্তার এসেছিলো তা কেউই বলতে পারে না। এই কেন্দ্রটি ২০ শয্যা হাসপাতালে রূপ দেয়ার জন্য আমরা বহু দৌড়ঝাপ করেছি। আমাদের এখান থেকে নারায়ণগঞ্জ শহরে গিয়ে ডাক্তার দেখানো সম্ভব না। তাই আমাদের প্রচেষ্টার কমতি নেই। কিন্ত কেন্দ্রে যদি ডাক্তারই না আসে তাহলে বিল্ডিং দিয়ে কি হবে?

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কথা হয় ডাক্তার আবু সায়েম ভুঁইয়ার সাথে। তিনি বলেন, আমি বর্তমানে করোনা রোগীদের সেবার জন্য ঢাকায় অবস্থান করছি। কবে ডিউটি শেষ হবে জানা নেই। কবে নাগাদ বদলী হয়ে বক্তাবলী এসেছেন তাও বলতে পারেন না তিনি।
৫ বছর ধরে বক্তাবলী উপ – স্বাস্থ্য কেন্দ্রে না বসা এবং সিগনেচার করে আসার বিষয়টি জানতে চাইলে বলেন, আপনার মত অনেক সাংবাদিকের সাথে আমার পরিচয় আছে।

তারাও এসব বলতো, তাদের কাছেই জেনে নিয়েন। তাকে আবারও প্রশ্ন করা হয় এই অভিযোগের বিপরীতে আপনার বক্তব্য কি? তিনি উত্তরে জানান, এই বিষয়ে আপনি সদর উপজেলার স্বাস্থ্য কর্মকর্তা জায়েদুল আলমের সাথে কথা বলে নিয়েন। এর বেশী আমি কিছু বলতে পারবো না।

এ ব্যাপারে জেলা সিভিল সার্জন ডা. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, আমি এই অভিযোগ প্রথম শুনলাম। এতদিন কেউ আমাকে এই ব্যাপারে জানায়নি। যেহেতু বিষয়টি সদর উপজেলার আওতায় সেহেতু এর সকল ব্যবস্থা জায়েদুল ইসলামের উপরেই বর্তায়। আমি খোঁজ নিয়ে এর সত্যতা দেখবো।

সদর উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও জেলা করোনা বিষয়ক ফোকাল পার্সক ডা. জায়েদুল ইসলাম বলেন, তিনি শোকজের জবাবে বলেছিলেন যে ব্যক্তিগত অসুস্থতা ও কিছু কারনে নিয়মিত যেতে পারেননি। পরবর্তীতে কিছুদিন নিয়মিত সেখানে রোগী দেখেছেন। কিন্তু কেন এই অভিযোগ এলো আমি জানিনা। বর্তমানে তাকে অধিদপ্তর করোনা চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নিয়ে গেছেন। হয়তো সেখান থেকে ফিরলে আবারও নিয়মিত চেম্বারে বসবেন।

স্পন্সরেড আর্টিকেলঃ