আজ মঙ্গলবার, ১৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৩রা ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

মাদকের ছোবলে ঝরছে প্রাণ

বিশেষ প্রতিবেদক

মাদকের বিরুদ্ধে পুলিশের জিরো টলারেন্স নীতি বেশ পুরাতন। প্রায় প্রতিদিনই একের পর এক বড়-ছোট ব্যবসায়ীকে আটক করছে র‌্যাব ও পুলিশ। মামলার রায় ও হচ্ছে ধারাবাহিক ভাবে। কিন্তু কোন ভাবেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না এর প্রসার রোধ ও সমাজে ছড়িয়ে পড়া প্রভাব। মাদকের এমন ভয়াল থাবায় একের পর এক স্বাভাবিক জীবন কেড়ে নিচ্ছে পরিবারগুলো থেকে। ঝরে যাচ্ছে একের পর এক সম্ভাবনাময়ী প্রান।

নারায়ণগঞ্জের প্রবেশ করতেই ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডে দেখা মিলবে একাধিক মাদকাসক্ত পূর্নবাসন কেন্দ্র। বলা হয় যে এলাকায় পুলিশ বেশী সে এলাকায় অপরাধীও বেশী। ঠিক সেই কথার মতই মাদকাসক্তের ছড়াছড়ির কারনেই গড়ে উঠেছে একাধিক মাদকাসক্ত পূর্নবাসন কেন্দ্র। যেখানে কয়েকমাস টানা চিকিৎসায় আসক্ত রোগী ফিরে আসে স্বাভাবিক জীবনে। তবে অনেকেই এর থেকে বেরিয়ে পুনরায় মাদকে আসক্ত হয়ে যাবার ঘটনাও একেবারে কম নয়। আর এর পেছনে মাদকের সহজলভ্যতা ও মাদক ব্যবসায়ীকে প্রভাবশালীদের শেল্টারকে দায়ী করছেন সচেতন নাগরিকরা।

বছরের শুরুর দিকে মাদক নির্মূলের লক্ষে অপারেশন চালায় প্রশাসনের কর্মকর্তারা। সাঁড়াশি অভিযানে মারা পরে একাধিক মাদকের গডফাদার। কিন্তু তাতে কেবল মাদকের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে বলেই জানা যায় বিভিন্ন সুত্রে। বন্ধ হয়নি মাদকের অবাধ প্রবেশ ও ব্যবসায়। পাল্টেছে মাদক বহনের কৌশল ও ব্যবসার ধরণ। এসকল ব্যবসায়ীরাও এখন প্রযুক্তি নির্ভর হওয়ায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে নির্ধারিত স্পটে মাদক বিক্রি করে থাকেন। পাশাপাশি থানা পুলিশ ও পুলিশের সোর্সকে মাসিক ভাতার ভিত্তিতে নিজেদের আড়াল করে রাখেন নির্বিঘ্নে। ফলে পুলিশের দৌড়ঝাঁপ শুরু হলে আগে থেকেই টের পেয়ে সটকে পরে তারা।

শুধুমাত্র মাদককে কেন্দ্র করে প্রতিনিয়ত লাখপতি বনে যাচ্ছে অসংখ্য মাদক ব্যবসায়ী। অন্যদিকে ব্যবসায়ীদের থেকে ক্রয় করতে গিয়ে মাদক সেবীরা জড়িয়ে পড়ছে অপরাধকর্মে। অপরাধের ক্ষেত্রে এসকল মাদকসেবীদের আচরণও হয় ভয়ংকর বেপরোয়া। মাদকের টাকা যোগাতে এমন কোন হীন কাজ নেই যা তারা করতে দ্বিধাবোধ করে। সামান্য কোন বিষয়কে কেন্দ্র করে নৃশংস ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে নিমিষেই।

তারই উদাহরণ হিসেবে সামনে চলে আসে সাম্প্রতিককালে ঘটা কিশোর গ্যাং এর দোর্দান্ড প্রতাপ। তাদের ভয়ংকর উত্থান গুরুত্বের সাথে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়েছে পুলিশ প্রশাসনকে। গত ২৭ জুলাই রাতে ফতুল্লার দেওভোগ হাশেম নগর এলাকায় মোটর সাইকেলের লাইটের আলো চোখে পড়ায় ক্ষিপ্ত হয়ে শাকিল নামে এক ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে হত্যা করে তুহিন ও তার দলের সদস্যরা। ঐ ঘটনায় নিহত শাকিলের ভাই সাঈদ বাদী হয়ে তুহিন, নিক্সন ও চান্দুর নাম সহ অজ্ঞাত ৮ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন।

মামলার তদন্তকারী অফিসার ফতুল্লা মডেল থানার এসআই মিজানুর রহমান জানান, ইয়াবা ব্যাবসায়ী তুহিন ও তার সদস্যরা বিভিন্ন স্থানে ইয়াবা সাপ্লাই দিতো এবং ইয়াবা বিক্রির টাকা কালেকশন করতো। ঘটনার দিন তুহিন বাংলাবাজার এলাকা থেকে মাদক বিক্রির টাকা নিয়ে ভাগাভাগি করছিলো। এসময় একটি মোটরসাইকেলের আলো চোখে পড়ায় তুহিন মোটর সাইকেল আরোহীকে থামায় এবং গালাগাল করে মারধর করতে থাকে। এক পর্যায়ে মোটরসাইকেল আরোহী দ্রুত মোটর সাইকেল চালিয়ে পালানোর চেষ্টা করলে তাকে ধাওয়া করে এলোপাথারী কুপিয়ে হত্যা করে। আশপাশের লোকজন ছুটে আসলে তাদেরকেও কোপায় তুহিন গ্যাং এর সদস্যরা। এছাড়া তার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি হত্যা মামলা রয়েছে।

সেই মামলায় তুহিনকে ১৭ সেপ্টেম্বর রাতে কুমিল্লার দেবিদ্বার থেকেআটক করা হয়। অস্ত্রের সন্ধানে তার দেয়া তথ্যমতে রাতে শহরের সৈয়দপুর এলাকায় অস্ত্র ও মাদক উদ্ধার যায় র্যা ব। এসময় আগে থেকে ওঁৎ পেতে থাকা তুহিনের সহযোগীরা তাকে ছাড়িয়ে নিতে র্যা বকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ে র্যা বও পাল্টা গুলি ছুাঁড়ে এতে দু’পক্ষের গোলাগুলিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হয় তুহিন। পরে আহত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। ঘটনাস্থলে তল্লাশি চালিয়ে একটি বিদেশী পিস্তল, একটি ম্যাগাজিন ও তিন রাউন্ড গুলি উদ্ধার করে র্যা ব।

সবশেষ সিদ্ধিরগঞ্জে পারিবারিক কলহের জের ধরে নিজ শ্যালিকা ও তার দুই কন্যাকে গলা কেটে হত্যা করে দুলাভাই আব্বাস। ছাড় দেয়নি নিজের প্রতিবন্ধী মেয়েকেও। জানা যায় আব্বাস ছিলেন প্রচন্ড রকম মাদকাসক্ত। তার সুমাইয়া নামের ১৫ বছরের একটি প্রতিবন্ধী মেয়ে রয়েছে। মাদকের টাকার জন্য প্রায়শই বাড়িতে নিজ স্ত্রী ইয়াসমিন ও প্রতিবন্ধী কন্যা সুমাইয়াকে মারধর করতো। আর এই কারণে ইয়াসমিন তার মেয়ে সুমাইয়াকে নিজের বোন নাসরিনের বাসায় রেখে আসতো।

ইয়াসমিন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমার স্বামী আব্বাস মাদকাসক্ত ছিলো। সে কোন কাজ করতো না। আমার বেতনের টাকা নিয়ে নেশা করতো। প্রতিবন্ধী অসহায় মেয়েটাকেও মারধর করতো। সে কারনে সুমাইয়াকে বুধবার রাতে ছোট বোন নাসরিনের বাসায় চলে আসি। বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৭টায় আমি বাসা থেকে বের হয়ে গার্মেন্টে চলে যাই। সকাল ১০টার পরে জানতে পারি আমার বোন ও তার মেয়ে দুটিকে মেরে ফেলেছে আব্বাস।

সংবাদ সম্মেলনে এসপি হারুন অর রশিদ গণমাধ্যমকে জানান, আব্বাস ইয়াবা সেটি নিশ্চিত হওয়া গেছে। সে ইতোমধ্যে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবদে হত্যাকা-ের দায় স্বীকার করেছে। সে জানিয়েছে শ্যালক ভায়রা তাকে একদিন চড় মারছে আর তার প্রতিশোধের মনে ধরে রেখেছিলো। আব্বাসের স্ত্রী তার মেয়েকে নিয়ে প্রায়ই ভায়রা শ্যালিকার বাসায় চলে যাওয়ায় সে মনে মনে ঠিক করে এ বাড়ির অস্তিত্বই রাখবেনা যাতে করে আর এ বাড়িতে না আসতে পারে তার পরিবার।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মাদক সেবীদের একের পর এক কর্মকান্ডে হারিয়ে যাচ্ছে অসংখ্য সম্ভাবনাময়ী প্রান। তাদের হিংসাত্বক কর্মকান্ডে জন্মদিচ্ছে নৃশংস হত্যাকান্ডের ঘটনা। একজন মাদকাসক্ত নিজের পরিবারের পাশাপাশি আশেপাশের মানুষের কাছেও যে কতটা ক্ষতির কারন হয়ে দাঁড়ায় সেটি একের পর এক ঘটনা প্রবাহে সামনে এসে হাজির হচ্ছে। প্রশাসনের কঠোর হস্তক্ষেপ ছাড়া কোন ভাবেই এই মাদকের থাবা থেকে নিস্তার পাবার সম্ভাবনা নেই। পুলিশ প্রশাসনের ভেতর থেকে মাদক সেবীদের সাথে লিয়াজোকারী ও দুর্নীতিবাজ মুক্ত করতে না পারলে খুব দ্রুত এর থেকে নিস্তার পাবে না সাধারণ নাগরিকরা।

সর্বশেষ সংবাদ