আজ শনিবার, ৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

বিশ্বকবির প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধা

রণজিৎ মোদক :

“নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই নাহি রে। ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।” কবি সবাইকে ঘরের বাহিরে যেতে বারণ করে, নিজেই শ্রাবণ দিবসে ঘরের বাহির হলেন। কবি জানতেন তিনি আর ফিরে আসবেন না। তাই তিনি শুনিয়ে গেছেন বিদায়ের গান। “যখন পরবে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে, আমি বাইব না মোর খেয়াতরী এই ঘাটে।” আজ ২২শে শ্রাবণ। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মহাপ্রয়াণ দিবস।

ভোগ ঐশ্বর্য সমিত জমিদার পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেও ছোটকাল থেকেই কি যেন কি শূণ্যতা তাঁর হৃদয়কে ঘিরে রেখে ছিলো। পাওয়ার আনন্দ ক্ষণস্থায়ী। না পাওয়ার বেদনা দীর্ঘস্থায়ী। পাওয়া না পাওয়ার বেদনা বিদুর স্বপ্ন মানুষকে দোলায়িত করে। কি পেলাম আর কি পেলামনা চিন্তা-চেতনা আশা-নিরাশা মানুষকে সর্বক্ষণ বেদনার সাগরে ডুবিয়ে রাখে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সর্বক্ষণ বেদনার অমিয় সাগরে অবগাহন করেছেন। তাঁর চিন্তা চেতনা ছিল আগামী দিনের জন্য।

তিনি ছিলেন সবুজের পুজারী। রবীন্দ্রকাব্যে আমরা ছয় ঋতুর বর্ণনাই পাই। গ্রীষ্মের দাবদাহে আসে বৈশাখ, ফলের সমারোহ নিয়ে আসে জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ় আসে বাদলধারা আর কদম্বরেণুর সুবাস নিয়ে। শ্রাবণে অথৈ জল বাংলার মাঠঘাট নদী-নালা, খাল-বিল জলে ভরপুর হয়। শরতের শিউলি, হাসনাহেনা আরও নাম না জানা কত ফুলে ভরে যায় বাংলার প্রকৃতি। হেমন্তে ফসল কাটা, ফসলের উৎসব। ঋতুরাজ বসন্তের বিরহী মনে প্রকৃতির পাতা গজানোর মতো উঠে সুর ও সুখের আবেশ। এসবের অনবদ্য চিত্রায়ন রবীন্দ্রকাব্যের পরতে পরতে প্রস্ফুটিত হয়েছে। বর্ষায় কদম ফুল খোঁপায় গুঁজে কিশোরী-যুবতীদের সাজ যেন নৈসর্গিক দৃশ্যের অবতারণা করে।

“যখন মেঘে বর্ষা আসে, বর্ষে ঝরঝর, কাননে ফুটে নব মালতি কদম্ব কেশর।” কবি মূলত এভাবেই বর্ষাকে আবিষ্কার করেছেন। বর্ষার সাথে কবির আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তাছাড়া বর্ষার প্রতি প্রতিটি বাঙালি কবিকুল অত্যন্ত দুর্বল। এলিয়টের ‘পোড়া জমি’ প্রভাবিত কবি জীবনানন্দ দাশ বর্ষাকে অনেকটা উপেক্ষাই করেছেন। কিন্তু কবিগুরু তাঁর কাব্যে বর্ষাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছেন। শুধু তাই নয় বর্ষার মধ্যে সমস্ত ঋতুর প্রাণ খুঁজে নিয়েছেন। এই বাংলাদেশের পদ্মার কূলে বসে তিনি তার অমর কাব্য ‘সোনার তরী’ উপহার দিলেন। বিশাল জীবন নদীর কূলে বসে জীবন দেবতার চরণে তাঁর সমস্ত সম্পদ নিবেদন করেছেন।

“সীমার মাঝে অসীম, তুমি বাজাও সুর। আমার মধ্যে তোমার প্রকাশ, তাই এত মধুর।” কবি সেই মধুর সন্ধানে ভ্রমর রূপী আত্মাকে কল্পনার ডানায় উড়িয়ে দিয়েছেন। বহু গুণের গুনী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাহিত্যের সব শাখায় বিচরণ করেছেন। তিনি মৌমাছির নেয় বিভিন্ন ফুলে ফুলে বিচরণ করে নানা রঙের ফুলের মধু সংগ্রহ করে সাহিত্য ভান্ডার পূর্ণ করেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন লালন শাহ্’র ভাব শিষ্য। শুধু তাই নয় চার শত বছর পূর্বের বৈষ্ণব কবি চন্ডীদাসের লেখা বিরহ সঙ্গীত ‘এ ভরা বাদর মাহ ভাদর শূন্য মন্দির মোর’- এ গানের সুর করে কবি আপন কণ্ঠে গেয়েছেন। কবি তাঁর ছদ্মনামে ভানুসিংহের পদাবলী রয়েছে। কবি তাঁর জীবনের সমস্ত প্রেমকে ভক্তির চন্দনে লেপন করে জীবন দেবতার চরণে অর্পণ করেছেন। তিনি শ্রীকৃষ্ণের অমিয় বাণী শ্রীমদ্ভগবদগীতা আর শ্রীমদ্ভাগবতের ভক্তিরসামৃত আস্বাদন করে গীতাঞ্জলি উপহার দিলেন। ‘রূপসাগরে ডুব দিয়েছি, অরূপ রতন আশা করি।’ কিশোর বয়সের চঞ্চলতা শীতের ভোরে নাগরা জুতায় জল ভরে হাঁটা চলায়ও জ্বর-সর্দি পায়নি শিশু রবিকে। বিশ্রী রকম সুন্দর ছিল শরীর। তিনি তার জীবন দেবতাকে খুঁজতে খুঁজতে নিজের নয়ন-পাতে এবং হৃদয়মাঝে অনুসন্ধান করেছেন ধ্যানী কবি। “নয়নে রয়েছো তুমি তবু, নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে। হৃদয়ে রয়েছো তুমি তবু হৃদয় না পায় তোমায় বুঝিতে।।”

কবিতার গীতাঞ্জলিতে প্রথমে তিনি তাঁর আত্ম নিবেদন করলেন- “আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার, চরণধুলার তলে। সকল অহংকার হে আমার, ডুবাও চোখের জলে। নোবেল বিজয়ী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে এদেশে আলোচনা-সমালোচনা কম হয়নি। একশ্রেণীর জ্ঞানপাপীরা বেশি সমালোচনা করেছে। এখনো করছে আগামীতেও করবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।

তবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর জন্মগ্রহণ করবে না। এপেন্ডিসাইডের ব্যথায় কবি যখন কাতর তার পুত্র রথীন্দ্রনাথ কলকাতা থেকে গৃহে ডাক্তার এনে অপারেশন করেন। কবির এতে মত ছিল না। তারপরও পরিস্থিতির কারণে তাকে চিকিৎসা দেওয়া হয়। আজকের মত চিকিৎসা এত উন্নত ছিল না সত্য। বিশ্রী রকম সুন্দর দেহটা ডাক্তারি অস্ত্রের আঘাতে ক্ষত করা হলো। কবি তাঁর সেই গীতাঞ্জলিতে গেয়েছেন, “একটি নমস্কার, প্রভু, একটি নমস্কার, সমস্ত প্রাণ উড়ে চলুক, মহামরণ পারে।।” আজ ২২শে শ্রাবণ মহাকবির মহাপ্রয়াণ দিবস। যাবার দিনে এই কথাটি বলে যেন যাই, ‘যা দেখেছি যা পেয়েছি,
তুলনা তার নাই।’

(লেখক: শিক্ষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট। সভাপতি, নারায়ণগঞ্জ সাংবাদিক কল্যাণ সমবায় সমিতি লি.।)

স্পন্সরেড আর্টিকেলঃ