আজ শনিবার, ১৪ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৭শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

বিশাল ফারাক

মীর আব্দুল আলীম: সাংবাদিক- ধান-চালের দরে বিশাল ফারাক। পত্রিকার এমন শিরোনাম দেখে ভাবি এ দেশে ফারাক নেই কোথায়? রাজনীতিতে, এক দলে আরেক দলে ফারাক, ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে ফারাক, সামাজিক বন্ধনে ফারাক, মায়া মমতায় ফারাক, ভ্রাতৃত্ব, মাতৃত্ব, পিতৃত্বের বন্ধনে এখন বিস্তর ফারাক। এই ফারাক দেখেইতো শিল্পিরা গায়- ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’। সত্যিই আমরা আগে (ছোট বেলায়) অনেক সুন্দর দিন কাঁটিয়েছি। সেই দিন আজ কোথায়?

রাজনীতি
রাজনীতিতে একদলের সাথে আরেক দলের ফারাক থাকাটাই স্বাভাবিক। অস্বভাবিক হলেইতো বিপদ। এমনটাই তো এখন হচ্ছে। এখন দলাদলির ফারাকটা কিন্তু অনেক বেড়েছে। ক্ষমতাসীন দল এলাকায় দাবড়ে বেড়ায়, আর বিরোধীরা চুপচাপ ঘাপটি মেরে থাকে। এখন কিন্তু এমন না। একেবারে লেং মারামারি চলে দলাদলিতে। একের পর এক মামলা, সঙ্গে থাকে হামলা। বাড়ি ছাড়া করা, দুনিয়া ছাড়া করা, দেশ ছাড়া করা কোনোটাই বাদ যায় না।

আগে কিন্তু এমনটা ছিল না। একদলের লোক আরেক দলের দাওয়াতে গিয়ে আনন্দে সামিল হতেন। আড্ডা দিতেন চায়ের টেবিলে। এখন ধান আর নৌকার টেবিল আলাদা। কোথাও কোথাও বিয়ে বাড়িতে এমন মার্কার পেন্ডেলও নাকি আলাদা হয়। বাড়ির শিশুরাও দলদলিতে জড়ায়। খেলতে গিয়ে নৌকার পরিবারের লোক, নৌকার পরিবারের শিশুদের সঙ্গে খেলাধুলা করে। ধানওয়ালা শিশুরা আলাদা খেলে। দলবাজি যারা করেন তাদের বিরোধীদের সঙ্গে রিতিমত মুখ চাওয়াচায়িও হারাম কোথাও কোথাও। তাহলে দলাদলিতে, মার্কায় মার্কায় ফারাকটা কত এটাই ভাবুন পাঠক!

শিক্ষক-শিক্ষার্থী
এই ফারাকটা ভয়াবহ! জাতির জন্য অসহনীয়। আগে শিক্ষক ছিলেন বাবার মতো। এখন শিক্ষক তো কখনো কখনো অর্থে কেনা কর্মচারী। এমন ভাবনা অনেক শিক্ষার্থীর মধ্যে। আর বাবা যদি ম্যানেজিং কমিটির কেউ হন তাহলে শিক্ষকদের ক্ষেত্র ভেদে হয়তো ওই মর্যাদাটাও আর থাকে না। ফেল করে ক্লাস টপকাতে না পারলে শিক্ষক বেচারার চাকরিটাই তখন খোয়া যায়। এই হচ্ছে আজকের শিক্ষকদের মর্যাদা! এদিকে অনেক শিক্ষকই আজ আগের শিক্ষকের মতো শিক্ষক নন। প্রফেশনাল শিক্ষক। তারা টিউশনি আর টাকা ছাড়া কিছুই বোঝেন না। তাই শিক্ষার্থীরাও তাদের দেখেন সেই দৃষ্টিতেই। বলতে হয় ছাত্র শিক্ষকের সম্পর্ক সেই আগের জায়গায় নেই। শিক্ষকরা এখন শিক্ষার্থীদের শাসন করতে যায় না। এটা রাষ্ট্রীয়ভাবে মানা।

আমাদের শিক্ষকরা আমাদের যেভাবে শাসন করেছেন, এমন শাসন করলে আজকের শিক্ষকরা তো লাশ হবেন! ছাত্র অভিভাবক মিলে শিক্ষকের চামড়া তুলে নেবেন। চোখ-মুখ ভোঁতা করে দেবেন। আমার মনে আছে, ক্লাস সিক্সে পড়ি তখন। সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাওয়ার পথে স্যারকে (শিক্ষক) দেখে তড়িঘড়ি নামতে গিয়ে জংলায় পড়ে পায়ের হাড় ভেঙেছিলাম। এখনও বুড়ো বয়সে শিক্ষকদের দেখলে শরীরের কাঁপুনি ওঠে। এখনকার ছাত্ররা শিক্ষকদের শাসনকে বাড়াবাড়ি ভাবে। উল্টো ছাত্ররাই শিক্ষকদের ধমক দেয়। মাঝেমধ্যে পত্রিকায় শিক্ষকদের গায়ে চড় থাপ্পর, কিল ঘুষি আর জীবন কেড়ে নেওয়ার খবর পাই। গোবেচারা শিক্ষকরা অসহয় অনেক ক্ষেত্রেই। ছাত্ররা সুযোগ পেলে বলে স্যার বেত্রাঘাত করেছেন। অমনি ওই শিক্ষক মশাইয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা। ছাত্র শিক্ষকের সম্পর্কের বিস্তর ফারাক হয়েছে।

সামাজিক বন্ধনে
‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’। আগের সেই দিন আছে কি? আমগাছতলায় আম পেড়ে, পাড়ার লোকশুদ্ধ ভর্তা বানিয়ে খাওয়া; মায়ের হাতের চাল ভাজা, সিম বিচি খেয়ে বিকেল পাড়া করা, আর কত কিছুই না ছিল। দুপুর না গড়তেই গাঁয়ের মাঠে ছেলে-বুড়া সবাই মিলে গ্রামীণ খেলায় মত্ত হতাম। সেই দিন কোথায় আজ? আমার দু’টো ছেলের কথা বলি। ওরা সকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটে। দিন ধরে কোচিং করতে করতে সন্ধ্যা। এরপর বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলা। আমি যে ফ্ল্যাটে থাকি সে বিল্ডিংয়ে ১৬৮টি বড়সর ফ্ল্যাটে প্রায় ১৪শ’ লেকের বাস। একটি বড় গ্রাম আরকি। গুনে গুনে ৭/৮ জনের নাম জানি। ছেলেরা তাও জানে কিনা সন্দেহ। বছরখানেক আগে আমার পাশের ফ্ল্যাটের এক ভদ্রমহিলার অকাল মৃত্যু হয়েছে। যে রাতে তিনি মারা গেছেন, আমার পরিবারের কেউ জানেন না সে খবর। সকালে ঘর থেকে বের হয়ে লিফ্টের পাশে মানুষের সমাগম থেকে বিষয়টি জানতে পারলাম। এই তো শহুরে জীবন। আর আমরা আগে কি দেখেছি? দু একদিন গাঁয়ের কারো সঙ্গে দেখা নেই তো মন আনচান করতো। এখন কেউ কারো খোঁজ রাখে না। সে সময় কোথায় হারিয়ে গেল? বড্ড ব্যস্ত আমরা। নিজেদের নিয়েই ব্যস্ততা বেশি।

ভ্রাতৃত্ব-মাতৃত্ব-পিতৃত্বের বন্ধনেও!
বাস্তব ঘটনা। পত্রিকায় খবর হয়েছে। বড় এক কর্মকর্তার পিতা মারা গেছেন বৃদ্ধাশ্রমে। পুত্রকে বাবার মারা যাওয়ার খবরটা দেওয়া হলে তিনি জানালেন-‘আমি এখন মিটিংয়ে আছি। লাশ আঞ্জুমানে দিয়ে দিন’। হায় পুত্র! ঠাকুরগাঁয়ে এক মায়ের ঘটনা সবাই জানেন। চলতি বছরের মাঝামাঝি সময়ের ঘটনা। ডিসি সাহেব গিয়ে পুত্রের নির্যাতদের শিকার মাকে এনে হাসপাতালে ভর্তি করেন। ছেলেকে দেন হজতে। মা তো জ্ঞন ফিরে একই প্রলাপ- ‘আমার ছেলে কোথায়? তোমরা তাকে মেরো না’। এমন হাজারো উদাহরণ আছে আমাদের ঘুণে ধরা এ সমাজের। মা-বাবার প্রতি সন্তানের মায়া মমতার ফারাক। কিন্তু এখন বেশ লক্ষণীয়। ভাই ভাইকে টাকার জন্য, জমির জন্য খুন করছে। ভাইয়ে ভাইয়ে ফারাক বেড়েছে। ভ্রাতৃত্ব-মাতৃত্ব-পিতৃত্বের বন্ধনে চিড় ধরেছে। এ চির জোড়া লাগানো না গেলে আমাদের যে আর অবশিষ্ট কিছু থাকে না।

ধর্মীয় বন্ধন
এ দেশে ইসলাম ধর্মের পর হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যাই বেশি। আমাদের যারা হিন্দু বন্ধুবান্ধব ছিল তাদের সঙ্গে খুব ভাব ছিল আমাদের। প্রশান্ত নামের এক কলেজ বন্ধু একদিন বাসায় আমার মায়ের খাবার খেতে গিয়ে বলল- চাচি দেন তো মাংসের বাটিটা। আমরাও হিন্দু বাড়িতে গিয়ে লাড্ডু, লাবড়া, লুচি খেয়ে আনন্দ করতাম। আর সেই আমরাই নানা ছুঁতায় হিন্দুবাড়ি পুড়িয়ে দিই। দুঃখজনক ও বেদনাদায়ক ঘটনা, গত ২৮ অক্টোবর রংপুরের গঙ্গাচরে টিটো রায় নামের এক ব্যক্তি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন। তাকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তার অপরাধের শাস্তি আইন অনুযায়ী হবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সাম্প্রদায়িক হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা কেন? আমাদের দেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে অসহিষ্ণুতা ও অধৈর্যের প্রকাশ ঘটছে। এ ধরনের সহিংসতা সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতির দেশের মানুষের মাঝে হতাশার সৃষ্টি করেছে। হিন্দুবাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেওয়ার এ ঘটনা সরকার কিংবা দেশের মুসলিম সম্প্রদায় ভালো দৃষ্টিতে নেয়নি। কোনো ব্যক্তিবিশেষের দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণের খেসারত কেন জাতি দেবে? কেউ কাণ্ডজ্ঞানহীনভাবে কোনো কিছু ঘটিয়ে ফেলতে পারে। টিটু রায় ভুল করতে পারেন। এটাতে টিটু রায়ের অপরাধ, গোটা হিন্দু সম্প্রদায়ের অপরাধ নয়। তাহলে এতগুলো হিন্দু বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হলো কেন?

মানুষগুলো সহায়সম্বল হারাবে, তাও আবার বিনাদোষে, এটা কেমন কথা? এতো কিছুর পরও কিন্তু আমরা একটি বিষয় খুব লক্ষ করেছি। হিন্দু মন্দিরে ও বাড়িঘরে যখন হামলা চলছিল, তখন তাদের রক্ষার জন্য স্থানীয় অনেক মুসলিম এগিয়ে এসেছেন, প্রতিরোধ গড়েছেন, এমনকি হামলাকারীদের হাতে আহতও হয়েছেন। এটা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। হিন্দুদের প্রতি মুসলিমদের ভালোবাসার ফল। আমরা বাঙালি এটাই হোক আমাদের পরিচয়। এ দেশে সা¤প্রদায়িক সহিংসতা বন্ধ হোক, আমাদের মানষিকতা বদলে যাক, এটাই প্রত্যাশা।

ধান-চালে দামের ফারাক
ধান চাল নিয়েই কিছু বলা হয়নি এখনো। এখন এ প্রসঙ্গে আসা যাক। এদেশে দ্রব্যমূল্যের ফারাকটা নতুন নয়। পাইকারি বাজারে শশার দাম ২০ টাকা তো খুচরা বাজারে ৫০ টাকা। কোনোকিছুতেই সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। তাই যে যার মতো দাম হাঁকে; লাভ গুনে নিজেদের মতো করে। দেশে এখন চালের দাম আকাশ ছুয়েছে। সিন্ডিকেট ওয়ালারা চাল বিক্রি করে টাকার পাহাড় গড়ছে। বাজারে নতুন ধান উঠেছে। চালের দাম কমছে না। আবার কৃষকরা ধানের দামও পাচ্ছে না। সরকার নির্ধারিত ধানের মূল্যের সঙ্গে বর্তমান বাজারে বিক্রিত চালের দরের বিশাল ফারাক থাকায় বোরোর পর এবার আমন সংগ্রহ অভিযানও ব্যর্থ হওয়ার জোরালো শঙ্কা রয়েছে। এতে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ফের হুমকির মুখে পড়বে। পাশাপাশি ভর মৌসুমেও চালের দর আগের মতোই চড়া থাকবে বলে বাজার-সংশ্লিষ্ট অনেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

গত ১২ নভেম্বর খাদ্য অধিদপ্তর প্রতি টন ধানের মূল্য ২৬ হাজার ৬৭ টাকা ৫৬ পয়সা ঘোষণা করেছে। অথচ টিসিবির মূল্যতালিকা অনুযায়ী ওইদিন বাজারে মোটা চাল (স্বর্ণা-চায়না ইরি) প্রতি কেজি ৪২ থেকে ৪৬ টাকা, পাইজাম-লতা ৫২ থেকে ৫৫ টাকা, মাঝারি মানের চাল ৪৮ থেকে ৫৫ টাকা, নাজির-মিনিকেট ৬০ থেকে ৬৫ টাকা এবং সরু চাল ৫৮ টাকা ৬৫ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। মিলমালিকদের মতে, এক মণ ধানে সর্বোচ্চ ২৭ কেজি চাল পাওয়া যায়। সে হিসেবে সরকার নির্ধারিত ধানের দর অনুযায়ী প্রতি কেজি চালের দাম হবে ৩৮ টাকা। অথচ বাজারে এ দামে সর্বনিম্নমানের চালও নেই। ধান চালের দামে এমন ফারাক হবে কেন? আর স্বাভাবিকভাবেই কৃষকরা এমন দামের ফারাক রেখে কেউ সরকারের কাছে ধান বিক্রি করবে বলে মনে হয় না।

এদেশে সব কিছুতেই ফারাক বেশ চোখে পরার মতো। এ দূরত্ব, এ অসংগতি কমিয়ে আনতে হবে। এ জন্য আমাদের মানসিকতা বদলাতে হবে, সরকারকে গুরুত্ব দিতে হবে। এভাবে চলতে থাকলে মানুষ আর মানুষ থাকে না। দেশ আর দেশ থাকবে না।

মীর আব্দুল আলীম: লেখক,কলামিষ্ট,গবেষক

স্পন্সরেড আর্টিকেলঃ