আজ মঙ্গলবার, ১০ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৩শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

পাহাড়ে শুরু হয়েছে বৈশাখী উৎসব

সংবাদচর্চা রিপোর্ট:

বাঙালি সাংস্কৃতির ধারণ বাহক নৃগোষ্ঠী ।নানা আয়োজনে  পাহাড়ে শুরু হয়েছে বর্ষবরণ ও বিদায়ের মহান উৎসব বৈসাবি। আজ বৃহস্পতিবার সকালে কাপ্তাই হ্রদের পানিতে ফুল ভাসিয়ে চাকমা জনগোষ্ঠী উৎসবের প্রথম দিন ‘ফুলবিজু’ উদযাপন করেছে। আর ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী এদিন পানিতে ফুল ভাসিয়ে পালন করেছে ‘হারি বৈসুক’।

সকাল ৭টায় রাঙামাটি শহরের রাজবাড়ী ঘাটে চাকমা জনগোষ্ঠীর ফুলবিজুতে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের পার্বত্যাঞ্চল কমিটির সভাপতি প্রকৃতি রঞ্জন চাকমা। এ আয়োজনে অংশ নেন চাকমা তরুণ-তরুণী ও বিভিন্ন বয়সের মানুষ।

এরপর সকাল ৮টায় রাঙামাটি শহরের গর্জনতলি এলাকায় ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর সদস্যরা অংশ নেন ‘হারি বৈসুক’-এ। তাঁরাও একইভাবে পানিতে ফুল ভাসিয়ে, ঐতিহ্যবাহী গড়াইয়া নৃত্য পরিবেশন, বয়স্কদের স্নান ও বস্ত্র দানের মাধ্যমে পালন করেন দিনটি।

কাল শুক্রবার চাকমাদের মূল বিজু, ত্রিপুরাদের ‘বুইসুকমা’ পালিত হবে। ১৮ এপ্রিল মারমা জনগোষ্ঠীর ‘সাংগ্রাই’ উৎসবের মধ্য দিয়ে শেষ হবে পাহাড়ের বর্ষবরণ ও বিদায়ের মহান উৎসব বৈসাবি।

 

চাকমাদের ‘বিজু’

পার্বত্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় নৃগোষ্ঠী হলো চাকমারা। বিজু তাই এখানে এনে দেয় এক অন্য রকম অনূভূতি আর মোহনীয় আবেশের দ্যোতনা। এই উৎসবের সঙ্গে তাই যেন দুলে ওঠে পুরো পার্বত্য চট্টগ্রাম। উৎসবের প্রথম দিনকে চাকমারা বলে ‘ফুলবিজু’। এই দিন বিজুর ফুল তোলা হয় এবং ফুল দিয়ে ঘর সাজানো হয়। পরে সে ফুল দিন শেষে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়।

বিজুর সময় ছোট ছেলেমেয়েরা পরিচ্ছন্ন কাপড় পরে দলবেঁধে বাড়ি বাড়ি বেড়াতে যায়। তারা বয়স্কদের সালাম করে এবং ঘরের হাঁস-মুরগিকে ধান-চাল ছিটিয়ে দিয়ে খাওয়ায়। এই সময় ঘরে ঘরে রান্না করা হয় ‘পাঁচন’। হরেক রকম সবজি আর তরকারি দিয়ে রান্না করা এই খাবারটি। প্রতিটি ঘরেই এক ধরনের প্রতিযোগিতা চলে কে কার পাঁচনে কত বেশি তরকারি দিতে পারে। গ্রামের ছেলেমেয়েরা ঘিলা খেলা, গুদু (হাডুডু) খেলায় মেতে ওঠে আর আকাশ প্রদীপ জ্বালায় এবং বাজি ফোটায় মহানন্দে। বয়স্করা বিভিন্ন মদ পান করে। বিজু উৎসবের সময় কোনো প্রাণী হত্যা করা হয় না। তবে নববর্ষের দিন মাস মাংসসহ মজার মজার সব খাবারের আয়োজন থাকে। এই দিন ভালো কিছু খেলে সারা বছর ধরে ভালো খাবারদাবার করার সম্ভাবনা থাকে বলে তারা বিশ্বাস করে।

 

 

ত্রিপুরাদের ‘বৈসুক’

ত্রিপুরাদের ধর্মীয় এবং সামাজিক উৎসবের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং প্রধান উৎসব হলো বুইসুক বা বৈসুক। চৈত্র মাসের শেষের দুদিন ও নববর্ষের প্রথম দিনটিসহ মোট তিন দিন ধরে পালন করা হয় এই উৎসব। চৈত্র মাসের শেষ দুদিনের প্রথম দিনটিকে ত্রিপুরারা ‘হারি বুইসুক’ এবং শেষ দিনটিকে ‘বুইসুকমা’ বলে থাকে। আর নববর্ষের প্রথম দিনটিকে তারা বলে ‘বিসিকাতাল’। উৎসবের প্রথম দিন ত্রিপুরা ছেলেমেয়েরা গাছ থেকে ফুল তোলে। ফুল দিয়ে ঘর সাজায়। কাপড়চোপড় ধুয়ে পরিষ্কার করে। ঝুড়িতে ধান নিয়ে তারা গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে মোরগ-মুরগিকে ছিটিয়ে দেয়। গৃহপালিত সব প্রাণীকে খুব ভোরে ছেড়ে দেয়। পরিচ্ছন্ন কাপড়চোপড় পরে ছেলেমেয়েরা গ্রামে ঘুরে বেড়ায়। ছেলেমেয়েদের বিচিত্র পিঠা আর বড়দের মদ ও অন্যান্য পানীয় পান করানো হয়। বৈসুক শুরুর দিন থেকে ‘গরাইয়া’ নৃত্যদল গ্রামে গ্রামে গিয়ে প্রত্যেক ঘরের উঠোনে নৃত্য করে। এই আনন্দদায়ক ও চিত্তাকর্ষক নৃত্যকে ত্রিপুরারা গরাইয়া নৃত্য বা খেরেবাই নৃত্য বলে।

এই নৃত্যে ২২টি অসাধারণ মুদ্রা সৃষ্টি করা হয়। এই নৃত্য দলের শিল্পীদের একজনের কাঁধে একটি শূল থাকে। এই শূলে একটি খাদি বাঁধা থাকে। যদি কোনো ঘরের উঠোনে এই শূল বসানো হয়, তবে ঘরের মালিককে গরাইয়া দেবতার পূজা দিতে হয়।

এভাবে প্রত্যেক ঘরের উঠোনে নৃত্য শেষে শিল্পীদের মদ, মুরগির বাচ্চা, চাল দেওয়া হয়। বিনিময়ে শিল্পীরা সুর করে সেই গৃহস্থকে আশীর্বাদ করে যায়। নৃত্য শেষে শিল্পীরা উপঢৌকন হিসেবে পাওয়া সামগ্রী দিয়ে গড়াইয়া দেবতার পূজা করে। কোনো শিল্পী যদি একবার এই গড়াইয়া নৃত্যে অংশ নেয়, তবে তাকে তিন বছর পর পর এই নৃত্যে অংশ নিতে হয়। তা ছাড়া তার অমঙ্গল এমনকি মৃত্যু হয় বলে ‘ত্রিপুরা মিথ’ আছে।

এই লোকনৃত্যটিতে ১৬ জন থেকে শুরু করে ৫০০ জন পর্যন্ত অংশ নিতে পারে। বৈসুক উৎসবের জনপ্রিয় এবং আকর্ষণীয় নৃত্যটি দেখার জন্য প্রত্যেক বৈসুকে সারা দেশের শত শত সংস্কৃতিকর্মী ও শিল্পী পার্বত্য চট্টগ্রামে আসেন।

 

মারমাদের ‘সাংগ্রাই’

বৈসাবি উৎসবের ‘সা’ আদ্যাক্ষরটি পাহাড়ের অন্যতম নৃগোষ্ঠী মারমাদের ‘সাংগ্রাই’ উৎসব থেকে নেওয়া। মারমাদের অন্যতম প্রধান সামাজিক উৎসব হলো সাংগ্রাই। মারমারা সাধারণত চন্দ্রমাস অনুসারে এই দিনটি পালন করে থাকে। বছরের শেষ দুদিন এবং নববর্ষের প্রথম দিন—এই তিন দিন উদযাপিত হয় এই উৎসব। সাংগ্রাই উৎসব উদযাপনের সময় মারমা তরুণী-তরুণীরা পিঠা তৈরি করার জন্য চালের গুঁড়া প্রস্তুত করে। এ সময় ‘পানি খেলা’ হয়।

সাংগ্রাই উৎসব এবং পানি খেলা এখন যেন একে অপরের সমর্থক হয়ে গেছে। এই খেলার সময় এক জায়গায় পানি ভর্তি রেখে তরুণ-তরুণীরা একে অপরের দিকে পানি ছুড়ে মারে। স্নিগ্ধতায়, ভালোবাসায়, শ্রদ্ধায় ভিজিয়ে দেয় পরস্পরকে।

এ ছাড়া এই দিন মারমারা বৌদ্ধ মন্দিরে যায়। মারমারা এই সময় মেতে ওঠে ‘ঘিলা খেলায়’।

চৈত্রসংক্রান্তি উপলক্ষে সাংগ্রাই উৎসব উদযাপন করা হয় বলে ধারণা করা হয়। ‘সংক্রান্তি’ শব্দ থেকেই ‘সাংগ্রাই’ শব্দটি এসেছে।

বৈসাবি উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ হলো মারমা তরুণ-তরুণীদের পানি খেলা। মারমা সংস্কৃতি সংসদ প্রতিবছর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ঘুরে এই পানি উৎসব পালন করে থাকে।

এই বছর এই পানি খেলা ১৫ এপ্রিল রাঙামাটির বেতবুনিয়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে অনুষ্ঠিত হবে।

ত্রিপুরাদের বৈসুক-এর ‘বৈ’, মারমাদের সাংগ্রাই-এর ‘সা’ আর চাকমাদের বিজুর ‘বি’, এই উৎসবকে একসঙ্গে বোঝাতে পুরো আয়োজনকে একসঙ্গে ‘বৈসাবি’ হিসেবে বোঝানো হয়। তবে প্রতিটি জনগোষ্ঠীই প্রায় একই রঙে ঢঙে পালন করে থাকে বর্ষবরণ ও বিদায়ের এই সুবিশাল উৎসবটি।

স্পন্সরেড আর্টিকেলঃ