আজ বৃহস্পতিবার, ১২ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৫শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

পরিবহণ শ্রমিকদের হিংস্রতা

পেছনে গডফাদারদের প্রভাব ॥ মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে

বিশেষ প্রতিবেদকঃ

সড়কে দিন দিন হিংস্র হয়ে উঠছে পরিবহণ শ্রমিকরা। যাত্রিদের নিরাপত্তার বিষয়ে কোন আগ্রহ নেই তাদের। রাস্তার মাঝে যাত্রি তোলা আর চলন্ত গাড়ি থেকে অনেকটা মালের বস্তা ছুড়ে ফেলার মতো যাত্রি নামিয়ে জীবন ঝুঁকিতে ফেললেও কোন আফসোস নেই তাদের। অভিযোগ রয়েছে, নারায়ণগঞ্জের পরিবহণ গডফাদারদের আস্কারায় বেপরোয়া হয়ে উঠছে শ্রমিকরা। যাদের এসব দেখ ভাল করার কথা তারাও যেন পেরে উঠছে না। বিশ্লেষকরা বলছে, এমন আচরণ করে পরিবহণ সেক্টর ধ্বংস করছে মালিক-শ্রমিকরা। পরিবর্তন না হলে এক সময়ে সরকারী গাড়ি ও ব্যক্তি মালিকানা গাড়ির দাপটে হারিয়ে যাবে তারা।

প্রবীণদের সাথে আলাপ করে জানা যায়, একটা সময় ছিল যখন যাত্রীরা থাকতো পরিবহণ শ্রমিকদের কাছে লক্ষী। যেমনটা দোকানি তার ক্রেতাদের লক্ষী বলে সম্বোধন করেন। কিন্তু দিনের পর দিন যাত্রীসেবা যেমন কমেছে তেমনি বেড়েছে পরিবহণ শ্রমিকদের হিংস্রতা। ভেতরে বাইরে সমানতালে নিজেদের হিংস্রতা প্রদর্শন করে রীতিমত সড়কে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তারা। এদের পেছনে পরিবহণ মাফিয়ারা থাকায় খোদ প্রশাসনও যেন অসহায় বোধ করছে। হিংস্রতা ক্রমশ বিস্তার পাওয়ায় যাত্রীরা বাধ্য হয়ে ঝুঁকছেন ব্যক্তিগত পরিবহণ ক্রয়ে।

এক হিসেবে দেখা গেছে, করোনা পরবর্তী সময়ে দেশে মোটরসাইকেল ও বাইসাইকেল ক্রয় বেড়েছে অন্তত আড়াইগুণ। এর অন্যতম কারন বাসে বাড়তি ভাড়া এবং গণপরিবহনের ভোগান্তি। এছাড়াও স্বাভাবিক সময়ে পরিবহণ সংকট, গাড়ির স্টাফদের হিংস্র আচরণ, নারী যাত্রীদের যৌন নিপীড়ন, বিভিন্ন অজুহাতে বাড়তি ভাড়া আদায়, অপর্যাপ্ত সিট এবং সিটিং বাসের নামে চিটিং সেবা যাত্রীদের দিনে দিনে বিষিয়ে তুলছে। বাসের ভেতর নোংরা পরিবেশ আর ময়লা সিট কভারও আরও একটি কারন।

সম্প্রতি করোনাকালে সড়ক যোগাযোগ ও সেতু মন্ত্রনালয় প্রতিটি বাসে ২টি সিটে ১জন যাত্রী বসার অনুমতি দিয়ে চলাচল শুরুর অনুমতি দেয়। কিন্তু ১৫ দিন না যেতেই বাসভর্তি যাত্রী তুলে ৬০ শতাংশ ভাড়া আদায় করা শুরু করে বাসের ড্রাইভার ও হেলপাররা। এনিয়ে প্রতিবাদ করলে যাত্রীদের সাথে উগ্র আচরণ, অশ্রাব্য ভাষা ও গায়ে হাত দিতে দ্বিধা করে না। নির্ধারিত ভাড়ার অতিরিক্ত অর্থ গুনেও যাত্রীসেবা মিলেনি অংশেই। ১ সেপ্টেম্বর থেকে সকল গণপরিবহনের ভাড়া আগের নিয়মে চলাচল শুরু করলেও কেউ কেউ ধারনা করছেন সুযোগ পেলেই করোনাকালীন ভাড়া আদায়ের চেষ্টা করতে পারে এসকল পরিবহণ শ্রমিকরা।

বেসরকারী এনজিওতে চাকুরিজীবী রাসেল আহমেদ বলেন, করোনার প্রথম কিছুদিন বাসে যাতায়াত করেছি। পরে দেখতে পাই বাস ভর্তি যাত্রী নিয়ে চলতে হচ্ছে। ভাড়াও দিচ্ছি বেশী আবার সেবা পাচ্ছি আগের মত। ফলে বাধ্য হই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে। বর্তমানে কিছু টাকা সংগ্রহ করে সাইকেল কিনে নিয়েছি। এতে করে একদিকে আমার সময় বাঁচে, পাশাপাশি পরিবহণ শ্রমিকদের হাতে হেনস্থা থেকে মুক্তি পাচ্ছি।

একই বিষয়ে রোকসানা আক্তার নামে এক ব্যাংকার বলেন, বাসে চড়া আর অপমানিত হওয়া এক কথা। এরা যাত্রী তুলে তাদের কিভাবে অপমানিত করে বাড়তি ভাঁড়া আদায় করা যায় সেই চিন্তা থাকে স্টাফদের। আর শিক্ষিত ও ভদ্র হলে আরও বেশী হেনস্থা করে। সুযোগ পেলেই গায়ে হাত দিবে কিংবা মহিলাদের ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে কটুক্তি করবে। এমন অসংখ্য অপমান সহ্য করে অবশেষে বাধ্য হয়েছি স্কুটি কিনে নিতে। এখন যেই ভাড়ার টাকায় ভোগান্তি পোহাতে হতো একই টাকার তেল খরচ করে স্বাধীন ভাবে চলাফেরা করতে পারছি।

তিনি আরও বলেন, যাদের সামর্থ আছে তাদের উচিৎ সাইকেল, স্কুটি কিংবা মোটরসাইকেল কিনে গণপরিবহন এড়িয়ে চলা। আমাদের উপর ভর করেই এরা দিনে দিনে ফুলে ফেঁপে বেপরোয়া হয়েছে। প্রশাসন এদের দিকে উদাসীন, সুতরাং আমাদের উচিৎ সামাজিক ভাবে এই হিংস্রতার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক ভাবে রুখে দাঁড়াতে।
সরেজমিনে দেখা যায়, ঢাকা থেকে যাত্রি তুলে লিংক রোডের বিভিন্ন জায়গায় যাত্রি নামানোর সময়ে বাস চালক গাড়ি থামাতে চায় না। অনেকটা চলন্ত গাড়ি থেকেই রাস্তার মাঝে যাত্রি নামিয়ে দেয় তারা। যেন মানুষ নয় কোন মালের বোঝা ছুড়ে ফেললো। এতে বেশী বিপাকে পরে বৃদ্ধ, নারী ও শিশুরা। গতকাল জালকুঁড়িতে এক বৃদ্ধ জানান, এভাবে রাস্তার মাঝে আমাকে নামিয়ে দিলো। আমিতো দুর্ঘটনার শিকার হতে পারতাম। ওদের (পরিবহণ শ্রমিক) বাবাতোও বৃদ্ধ থাকতে পারে। তাকেওতো অন্য কোন বাস চালক বা হেলপার এভাবে রাস্তার মাঝে নামিয়ে দিবে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, শহরের বাসস্ট্যান্ড থেকে যাত্রি তুলে বঙ্গবন্ধু সড়কের বিভিন্ন জায়গায় রাস্তার মাঝে থামিয়ে যাত্রি নেয় বন্ধন, উৎসব, বন্ধু সহ বিভিন্ন পরিবহণ। তবে এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম বিআরটিসির দোতলা বাস। তারা নির্দিষ্ট কাউন্টার ছাড়া যাত্রি নেয় না। তাদের স্টাফদের আচরণ নিয়েও তেমন অভিযোগ নেই। চাষাঢ়ার এক ওষধের দোকানদার জানান, প্রতিদিন জিয়া হলের সামনে বাসগুলো রাস্তার মাঝে যাত্রি নামিয়ে দেয়। পেছনে গাড়ি, সামনে গাড়ি তার উপর রিকশা-সিএনজির জটে পরে হত বিহব্বল হয়ে পরে যাত্রিরা। অথচ এখানে ট্রাফিক পুলিশ বক্সে নিয়মিত ট্রাফিক পুলিশ থাকে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নারায়ণগঞ্জে পরিবহণ শ্রমিকদের হাতে নিয়ন্ত্রিত হয় রাতের ঢাকা নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড। রাত ৯টার পর থেকেই শীতল কাউন্টারের সামনে বন্ধন ও উৎসবের বাসগুলো সাইনবোর্ডগামী যাত্রী সংগ্রহের জন্য পথরোধ করে দাঁড়িয়ে থাকে। পেছনে রোগীবাহী এম্বুল্যান্সের সাইরেন অনবরত বাজতে থাকলেও তাতে বাস চালকদের ভ্রুক্ষেপ নেই। নিজেদের বাড়তি আয়ের কাছে পুরো দুনিয়া যেন নস্যি।

এছাড়া সড়কের মাঝে হার্ডব্রিক করে দাঁড়িয়ে যাওয়া, যেখানে সেখানে যাত্রী তোলা, মোটরসাইকেল কিংবা সাইকেল আরোহীকে চাপা দিয়ে দেয়ার মনোভাব দেখানো। সড়কের অন্যান্য গাড়ীকে তটস্থ করে রাখা এদের নিত্যনৈমেত্তিক ব্যাপার। এসব বিষয় নিয়ে একাধিকবার প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও তাতে কর্নপাত করেনি প্রশাসন ও মালিকপক্ষ।

১ বছর পূর্বে সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন হবার পর পরিবহণ শ্রমিকরা দেশব্যাপী অবরোধের ডাক দেয়। যারাই ঘর থেকে জরুরী প্রয়োজনে বের হয়েছে তাদের গায়ে পোড়া মবিল মাখিয়ে এক সন্ত্রাসের রাজ্য কায়েম করতে শুরু করে। পুরো শহর যেন একদল সন্ত্রাসী মাফিয়ার হাতে বন্দি ছিল। সেসময়ে ক্লাস করে ফিরে আসার সময় নারায়ণগঞ্জ মহিলা কলেজের বাস আক্রান্ত হয় পরিবহণ শ্রমিক নামধারী সন্ত্রাসীদের দ্বারা। কলেজ ছাত্রীর গায়ে পোড়া মবিল মাখিয়ে নিজেদের যৌন নিপীড়ক হিসেবে প্রমান দিতেও ভুল করেনি তারা।

তবে এতকিছুর পরেও ব্যতিক্রম ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে নারায়ণগঞ্জের দুইটি এসি বাস বিআরটিসি ও শীতল। এছাড়া নন এসির ভেতর বিআরটিসি দোতালা বাসটিও যাত্রী সেবায় ভালো ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে। অন্যান্য সকল বাসের তুলনায় কম ভাড়া নিয়েও সেবার দিক থেকে উন্নতমান রাখতে সক্ষম হওয়ায় দোতালা এই বাসটির কদর যাত্রীদের নিকট অনেকাংশে বেড়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরিবহণ শ্রমিকদের এমন হিংস্র আচরণের জন্য তারা নিজেরা যেমন দায়ী পাশাপাশি দায়ী সেসকল বাস মালিকরা। অভিযোগ পাওয়া মাত্র স্টাফের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া এবং যাত্রীদের সাথে সন্মানসূচক কথা বলার নির্দেশ প্রদান করলে এতটা হিংস্র হবার স্পর্ধা দেখাতে পারতো না তারা। বিভিন্ন জেলা থেকে এসে ধনী জেলা নারায়ণগঞ্জের যাত্রীদের সাথে যেভাবে অসভ্যতা উপস্থাপন করে তা একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। এদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা এবং যাত্রীদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে বয়কট বড় ধরনের পরিবর্তন এনে দিতে সক্ষম।

প্রবীণরা বলছেন, আগে যাত্রিবাহী বাস ব্যবসায়ীদের কাছে ছিলো। এখন তা গডফাদারদের কাছে চলে গেছে। গডফাদারদের উগ্র আচরণ দেখে পরিবহণ শ্রমিকরাও ফলো করে। বিশ্লেষকরা বলছে, যারা বাড়াবাড়ি করে তারাই ধ্বংস হয়। বিকৃত আচরণ, সেবা দিতে অনাগ্রহ সহ নানা কারনে মানুষ এক সময়ে যাত্রিবাহী পরিবহণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে। ইতিমধ্যে এমন ধারা শুরু হয়েছে। এখন যদি পরিবর্তনের চিন্তা না করে তবে পরিবহণ মালিক শ্রমিকরা নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্থ হবে।

স্পন্সরেড আর্টিকেলঃ