আজ শনিবার, ১৪ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৭শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

না.গঞ্জ শহরে ৫০ ভয়ংকর কিশোর গ্যাং

# পরিবার ও প্রশাসনের নজরদারি বাড়াতে হবে : নাগরিক নেতা
# গোয়েন্দা নজরদারিতে রয়েছে : র‌্যাব ও পুলিশ কর্মকর্তা

বিশেষ প্রতিবেদক:
শহর ও আশপাশের এলাকায় বিভিন্ন অপরাধ কমকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে কম বয়সীরা। চাঁদাবাজি, ছিনতাই, মাদক, ইভটিজিংসহ নানা অপরাধ করে বেড়াচ্ছে ওরা। এমনকি খুনের মতো ঘটনার সাথেও জড়িত কিশোর-যুবারা। ১৩ থেকে ২০ বছর বয়সীদের বলয়ে রাখতে আস্কারা দেয়ার অভিযোগ রয়েছে এলাকার নেতা-পাতি নেতাদের বিরুদ্ধে। মাথার উপর ভাইদের ছায়া থাকায় পাড়া মহল্লা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ভয়ংকর অর্ধশত কিশোর গ্যাং। সচেতন মহল বলছে, অসুস্থ বিনোদনে জড়িয়ে পড়ে কিশোররা বিপথে যাচ্ছে। এ বিষয়ে পরিবার ও প্রশাসনকে সজাগ থাকতে হবে।
বিভিন্ন এলাকা ঘুরে জানা গেছে, পাড়া মহল্লায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এক একটি দলে রয়েছে ৪০ থেকে ৫০ কিশোর-যুবা। আধিপত্য বা কোন বিষয়ে সংঘর্ষ হলে অন্য এলাকার বন্ধু গ্যাং সদস্যরা যোগ দেয়। কাজে অকাজে এলাকায় দল বেধে ঘোরাঘুরি, স্কুল টাইম বা গার্মেন্ট ছুটি হলে ওদের ছোটাছুটিও বেড়ে যায়। মোটর সাইকেলে ৩/৪ জন বসে মহল্লার রাস্তায় টহল দেয়। আর যাদের মোটরসাইকেল নেই তারা রাস্তায় প্রকাশ্যে বেহায়াপনা করে।
সূত্রমতে’ দেওভোগে ৫ গ্যাং রয়েছে। এরমধ্যে তুহিন গ্যাং ও চেয়ারম্যান বাড়ি এলাকায় আসিফ গ্যাং অন্যতম। বাবুরাইলে রয়েছে কৃষ্ণা গ্যাং, আমির গ্যাং,অপু বাহিনীসহ আরও ৩ টি। নয়াপাড়ায় রিক্সা রমজান ও ভূইয়াপাড়ার ছোট অনিক গ্যাং বিভিন্ন এলাকায় ভাড়া খাটে। তাঁতি পাড়ায় রয়েছে রায়হান গ্যাং। নলুয়া পাড়ায় নইলা শুভ গ্যাংয়ের কথা জানা গেছে।
নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার সৈয়দপুর এলাকায় কয়েকটি গ্যাং রয়েছে। তারা নিজেদের মধ্যে বড় ভাই-ছোট ভাই নিয়ে ও মাদক বিক্রি নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। স্থানীয়রা জানান, সৈয়দপুরে সেভেন স্টার, আলদাগা, ইয়াং স্টার, ডিপটি গ্রুপ সহ আরও ২টি গ্যাং রয়েছে। এ গ্যাং সদস্যরা ফকির বাড়ি এলাকায় বঙ্গবন্ধু উচ্চ বিদ্যালয় ছুটির সময়ে সড়কে মোটরবাইকের মহড়া দেয়। এ সময় স্কুলের ছাত্রিরা ইভটিজিংয়ের শিকার হয়। এ এলাকায় দৌলত মেম্বারের ছেলে একটি গ্যাং পালে।
শহরের মন্ডলপাড়া ও জিমখানা এলাকায় শাহ আলম বাহিনী চাঁদাবাজি, ছিনতাইসহ ইভটিজিংয়ে জড়িত। ডিআইটি এলাকা নিয়ন্ত্রন করে মইন্না রাকিব গ্যাং। এ গ্যাংয়ের সেকেন্ড ইন কমান্ডের নাম জুম্মান। বিএনপি অফিসের গলিতে এই গ্যাংয়ের সদস্য সব অপকর্মের টাকা ভাগাভাগি করে বলে স্থানীয়রা জানান। টানবাজারে নিসান ও বাঙ্গালী গ্যাংয়ের সদস্যরা নদীর তীরে সব অপকর্ম নিয়ন্ত্রন করে। মোবাইল ছিনতাই, চোরাই মোবাইল বেচাকেনা, মদ, জুয়াসহ বিভিন্ন সেক্টর থেকে টাকা পায় ওরা।
গলাচিপায় রয়েছে টাইগার গ্যাং। টাইগার গ্যাংয়ের সদস্যরা এলাকায় মাদক বিক্রির জন্য নতুন নতুন ছেলেদের খুঁজে। গত ২৯ জুন ফুচকা বিক্রেতা জুয়েল মাদক বিক্রি করতে রাজি না হওয়ায় টাইগার গ্যাংয়ের সদস্য আলম তাকে ছুরিকাঘাত করে। চাষাড়ায় রয়েছে বাবু বাহিনী। এই বাহিনীর সদস্যরা দিনের বেলায় ডান্ডি নেশায় ভুদ থাকে আর রাতের বেলায় চলন্ত গাড়ি থেকে মুরগি ও মাছ ছিনতাই করে বেড়ায়। এছাড়া রাতে বাড়ি ফেরত পথিক বা রিকশা আরোহীদের কাছ থেকে মোবাইল ও টাকা ছিনতাই করে বাবু বাহিনী। ভয়ংকর এ বাহিনীর কথা চাষাঢ়ার এলাকার ফুটপাতের সব ব্যবসায়ীও জানে।
জামতলায় সক্রিয় রয়েছে রায়হান গ্রুপ। এছাড়া চানমারিতে খান বাবু বাহিনী। খানপুরে কিং স্টার, এল আর বি গ্রুপ ও স্ট্রয় এট্যাক নামে গ্যাং দাবড়ে বেড়ায়। তল্লায় রয়েছে কসাই গ্যাং, বাবা গ্রুপ, গাল কাটা সাদ্দাম বাহিনী, লাদেন গ্যাং। ইসদাইরে ধোপা গ্যাং ও কমল বাহিনী সক্রিয় রয়েছে। গত ২৪ আগস্ট রাতে ইসদাইরের কাপুইড়াপট্টি এলাকায় যুবা গ্যাংয়ের সদস্যরা হামলা করে বাড়িঘর- দোকানপাট ভাংচুর করে। এ ঘটনায় ২৬ আগস্ট ৫ গ্যাং সদস্যকে দেশীয় অস্ত্রসহ আটক করে ফতুল্লা মডেল থানা পুলিশের এসআই মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে একটি টিম।

ইসদাইর সুগন্ধা আবাসিক এলাকায় ইবন বাহিনী দাপিয়ে বেড়ায়। এই বাহিনীর সদস্যদের লালন পালন করে এলাকার জনৈক বড় ভাই। ইবন বাহিনীর সদস্যরা সুগন্ধা মসজিদের পেছনে একটি খালি জায়গায় দেশীয় অস্ত্র পুঁতে রাখে বলে জানান স্থানীয়রা। বুড়ির দোকান আফরাফুল, রগ কাটা আকাশ, ফ্লেক্সী সাইফ গ্যাং ছিনতাই, মাদক বিক্রিসহ নানা অপকর্ম করে বেড়ায়। উত্তর মাসদাইর গাবতলীতে আলিফ গ্যাং ও উৎস গ্যাং। দুই গ্যাংয়েই ২০ থেকে ২৫ সদস্য রয়েছে। এর মধ্যে উৎস গ্যাংয়ের প্রধান উৎস দুইবার গ্রেপ্তার হলেও তাকে ছাড়িয়ে আনে তার বাবা। আফাজনগরে নাজমুল গ্যাং সক্রিয় রয়েছে।
শিবু র্মাকেটে মিশাইল রাকিব গ্যাং ও ব্লেড বাবুল গ্যাং দাবড়ে বেড়ায়। দক্ষিন সস্তাপুরের তোতলা দিপু আর পঞ্চিম সস্তাপুরের ওয়াইফাই সাগর গ্যাং সক্রিয় রয়েছে। কায়েমপুরে বুইট্টা বাবু, ইকবাল বাহিনীর সদস্যর এলাকায় মাদক বিক্রি, ইভটিজিংসহ নানা অপকর্ম করে বেড়ায়।

শুক্রবারে কিশোর গ্যাংয়ের আড্ডা বসে শহরে
শহরের ৫ নং ঘাটের জাহাজের উপর, দেওভোগের রাসেল পার্কে পশ্চিমে। বাবুরাইলে পুলের উপর। জিমখানার মাঠের পাশে। জামতলায় হিরা কমিটি সেন্টারের সামনে, চাষাড়ার বালুর মাঠে, নাগবাড়ির মাঠের সাথে। নবীগঞ্জ ঘাটে। বন্দর স্কুল ঘাটের পাশে। ফতুল্লার যাত্রার মাঠে। তল্লা বাজারের রেললাইনে। চাষাড়া রেল স্টেশনে। সুগন্ধা আবাসিক এলাকার মসজিদের পেছনে, খানপুরে হাসপাতালের পিছনে আড্ডা দেয় গ্যাং সদস্যরা। শুক্রবার এ আড্ডা বেশী হয় বলে জানান প্রত্যক্ষদর্শীরা।
কিশোর গ্যাংয়ের হাতে খুন
গত ২৩ আগষ্ট রাতে দেওভোগে অপু নামে এক ইলেকট্রিক মিস্ত্রীকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করেছে। ২৮ জুলাই শহররের দেওভোগ এলাকায় ছুরিকাআঘাতে শাকিল (৩৫) নামে এক যুবক খুন হয়। ২৭ জানুয়ারি দেওভোগ মাদরাসা এলাকায় এলোপাতাড়ি কুপিয়ে গুরুতর জখম করে হত্যা করে আলমগীর নামে এক যুবকে। ২৮ জানুয়ারি দেওভোগের লিচুবাগ এলাকার রিক্সা মিস্ত্রির ছেলে হাসিয়ারী শ্রমিক সিয়ামকে হত্যা করে। ২৭ জুলাই শীতলক্ষ্যায় নোঙ্গর করে রাখা একটি জাহাজ থেকে স্কুলছাত্র রিতুল ঘোষের (১৪) লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই ঘটনায় ৪ কিশোর আটক করা হয়।
সচেতন মহল মনে করছেন, সমাজে বড় ভাইদের আস্কারায় কিশোর-যুবারা নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। নিজের ক্ষমতা জাহির করতে ওরা কথিত বড় ভাইদের পেছন পেছন ঘুরে বেড়ায়। একসাথে গ্রুপ বেধে চললে তাদের সবাই ভয় পাবে এ ধারণা থেকেও গ্যাংয়ের দিকে ঝুঁকছে তারা। গবেষকদের মতে, মাঠ না থাকায় এখন কিশোররা খেলাধুলা থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। অধিকাংশ সময় তারা ডিজিটাল স্ক্রীনে চোখ রাখে। কারও কারও মতে, সুস্থ বিনোদন বাদ দিয়ে কিশোররা ইন্টারনেটে অসুস্থ বিনোদনে জড়িয়ে পড়েছে। এছাড়া টিভি অনুষ্ঠানে ক্রাইম অনুষ্ঠান দেখে কেউ কেউ অপরাধে পা বাড়ায়। তবে মূল সমস্যা দুর্নীতি, মাদক ও অপরাজনীতি বলে মনে করেন বোদ্ধা মহল। তাদের মতে, অপরাজনীতির কারনে এক শ্রেনীর নেতা ও দল এইসব কিশোরদের মিছিল মিটিংয়ে ব্যবহার করে। আবার তারাই মাদক বিক্রির কাজে লাগায় ওদের। তবে পরিবারের অসচেতনতাও দায়ী বলে চিহ্নিত করা হয়েছে গবেষনায়। কম বয়সী সন্তানের হাতে মোবাইল ফোন ও মোটরসাইকেল কিনে দিয়ে অস্থিরতার দিকে তাদের ঠেলে দেয়া হচ্ছে বলে গবেষনায় উঠে এসেছে। বোদ্ধা মহলের মতে, এখানে দুর্নীতির যোগ রয়েছে। দুর্নীতিবাজরা অঢেল অর্থ কামাই করায় সন্তানরাও আবদার বাড়িয়ে দেয়।
নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহমান বলেন, পরিবারে শিশুদের প্রতি যতœ নেয় না। শিশু কিশোরদের ব্যবহার করে বিভিন্ন ভাবে। তিনি বলেন, কিশোরা সংঘঠিত হয়ে অপরাধী করে। তারা বড় ভাইদের কাছ থেকে সুযোগ সুবিধা পায়। এই নাগরিক নেতার মতে, শিশু কিশোরদের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। সেই সাথে এই বিষয়গুলো প্রশাসনের তদারকি করতে হবে। তাহলে কিশোর গ্যাং কমে আসবে বলে মনে করেন তিনি।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর নারায়ণগঞ্জের সাধারণ সম্পাদক ধীমান সাহা জুয়েল বলেন, বিভিন্ন এলাকায় কিশোরদের খেলাধুলা করার জায়গা নেই। তাই তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও নানা ভাবে আড্ডা দিচ্ছে। তৈরি করছে গ্যাং। কিশোর অপরাধ রোধ করতে প্রশাসনের সাথে সামাজিক ভূমিকা সবচেয়ে বেশী জরুরী। সচেতন হতে হবে রাজনৈতিক ব্যক্তিদেরও।
এ বিষয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, সুবাস চন্দ সাহা বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিশোররা সংঘঠিত হয়ে বিভিন্ন অপরাধ কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ে। পুলিশ কিশোর গ্যাংয়ের বিষয়ে গোয়েন্দা নজরদারি করছে। তবে কিশোর বয়সী ছেলেদের প্রতি পরিবারের সদস্যদের নজর রাখা দরকার বেশী।
র‌্যাব’ ১১ এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, কিশোররা অনেকই অপরাধের সাথে জড়িত হচ্ছে। অনেক এলাকায় কিশোর গ্যাং প্রতিষ্ঠিত করছে। আমরা নারায়ণগঞ্জে কিশোর গ্যাংয়ের অনুসন্ধান করছি। নজরদারি করছি।

স্পন্সরেড আর্টিকেলঃ