আজ বুধবার, ২৫শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৮ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

না.গঞ্জে ভ্যাকসিন সংকট, কুকুরের কামড়ে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি

সংবাদচর্চা রিপোর্ট

২০১২ সালে উচ্চ আদালত কুকুর নিধনের নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞার কারনে বর্তমানে বেওয়ারিশ কুকুর নিধনের কাজ বন্ধ রয়েছে। মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কুকুর মারা বন্ধ রেখে টিকাদান কর্মসূচি ও বন্ধ্যাত্বকরণ কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। কুকুরের টিকাদান কর্মসূচি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। অভয়ারণ্য নামে একটি বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে বন্ধ্যাত্বকরণ কার্যক্রম চালু আছে। উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞার পরিপ্রেক্ষিতে সারা দেশের ন্যায় নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের নগরীর বিভিন্ন এলাকার কুকুর নিধনের কার্যক্রম গুটিয়ে নেয়। সেই থেকে অদ্যবধি নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন অলি-গলিতে বেওয়ারিশ কুকুরের উপক্রম বেড়েই চলছে।

নারায়ণগঞ্জ শহরে কুকুরের উপক্রম এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, বৃদ্ধ যুবক থেকে শুরু করে স্কুল পড়–য়া ছেলে মেয়েরাও ভয়ে আতংকে নগরীতে চলাচল করছে। দিনের আলো যেমন তেমন। রাত গভীর হলে ভূতুড়ে আতংককেও হার মানায় বেওয়ারিশ কুকুরের দলগুলো। নগরবাসী সারাদিনের ক্লান্তিকর পরিশ্রমের সমাপ্তি টানতে নাড়ীর টানে বাড়ী ফেরার পথে বাধা হয়ে দাড়ায় নগরীর বেওয়ারিশ কুকুরগুলো। নগরীর প্রত্যেক এলাকা ও এলাকার অলিগলিতে ১০ কিংবা তার অধিক কুকুর একাট্টা হয়ে পুরো এলাকা প্রদক্ষিন করে থাকে আর তখনি যত বিপত্তি ঘটে। কর্মস্থল হতে বাড়ী ফেরা মানুষগুলো পথি মধ্যে প্রতিনিয়ত এক প্রকার যুদ্ধ করে নিজ নিজ ঘরে ফেরে। ক্লান্তিকর দিন শেষ করে বিশ্রাম আর পরম নিদ্রার আশায় থাকা নগরবাসীর রাতের ঘুমকেও হারাম করে দিচ্ছে বেওয়ারিশ কুকুরগুলো। রাত বাড়ার সাথে সাথে কুকুরের চেচামেচি বেড়ে যায়। আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত পুলিশ প্রশাসন অভিযান পরিচালনার লক্ষে এলাকাগুলোতে প্রবেশ করার সাথে সাথেই অপরাধীদের চেয়ে কুকুরগুলো যেন বেশি আতংকিত হয়ে পড়ছে। কুকুরের চেচামেচিতে চিহ্নিত অপরাধীরাও মেসেজ পেয়ে যায় এলাকায় পুলিশ প্রবেশ করেছে।

জাতীয় সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের হিসাবে কুকুরের আক্রমণের শিকার মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। ২০১৬ সালে নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকা সহ এর আশপাশের এলাকা থেকে লক্ষাধিক মানুষ জাতীয় সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে সেবা নিয়েছে।

নগরীর উত্তর চাষাড়াস্থ মাউরাপট্টি এলাকার বাসিন্দা মো. মাসুম সংবাদচর্চাকে বলেন, অফিস আদালতে যারা চাকরি করছেন তারা হয়তো দিন থাকতে অথবা সন্ধ্যার পরপরই বাড়ী ফিরছেন। আমরা যারা গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন কলকারখানায় চাকরী করি। আমাদের অনেক রাত পর্যন্ত ডিউটি করতে হয়। ছেলেরা যে কোন উপায়ে বাড়ী ফিরলেও নারী কর্মীদের ক্ষেত্রে বিষয়টা ভিন্ন। আমার বোন যখন অধিক রাত পর্যন্ত ডিউটি করে তখন আব্বু অথবা আম্মু এগিয়ে নিয়ে আসে। আর এই ভাবেই চলছে আমাদের আতংকিত রাত।

শহরের খানপুর এলাকার নাম না প্রকাশ করার শর্তে কলেজ পড়–য়া একজন শিক্ষার্থী বলেন, আমাদের এলাকার কুকুরের উপক্রম যে হারে বাড়ছে তাতে হয়তো কুকুরের আতংকেই মৃত্যুবরণ করতে হবে। এ সকল কুকুরগুলোকে যথাযথ নিয়ম মেনে টিকাদান করা হয়েছে? বন্ধ্যাকরণ কার্যক্রমের আওতায় আনা হয়েছে? বিগত কয়েক বছর পূর্বে এই খানপুর এলাকায় কুকুরগুলোকে আঙ্গুল দিয়ে গুনা যেত। তবে বর্তমানে এই এলাকার কুকুরের উপদ্রব এতটাই বৃদ্ধি পাচ্ছে যে। হিসাব করে একটি সংখ্যা ডায়েরীতে নোট করা যাবে না।

২০১৮ সালের জুলাই মাসে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের সহায়তায় সিটি কর্পোরেশন এর আওতাভূক্ত নগরীর বিভিন্ন এলাকায় টিকাদান কর্মসূচী পালন করা হয়। ২০১৯ সালেও এই কর্মসূচী পালান করা হবে বলে জানা যায়। তবে স্বল্প জনবল নিয়ে সিটি কর্পোরেশন এ সকল কার্যক্রম পরিচালনা করার ক্ষেত্রে খুবই বেগ পেতে হয় বলে সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানা যায়। নারায়ণগঞ্জের সিটি কর্পোরেশনের বাজেট সংকট থাকায় সিটি কর্পোরেশনের নিজ উদ্যোগে কুকুর সমস্যা নিয়ে কাজ করার কোন সম্ভাবনাও নেই বলে জানা যায়।

কুকুরের কামড়ে আক্রান্ত বেশ কিছু ভূক্তভোগী পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলে জানা যায়, কুকুরের কামড়ের চিকিৎসা নেওয়ার জন্য নারায়ণগঞ্জ ১০০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক কিংবা চিকিৎসা প্রদানে সহায়তাকারীরা চিকিৎসা প্রদানের ক্ষেত্রে এবং দায়িত্ব পালন করতে অপারগতা প্রকাশ করে। সরকার কর্তৃক যে সকল সরঞ্জাম চিকিৎসা প্রদানের জন্য সরবরাহ কিংবা প্রদান করা হয়েছে তা যথাযথভাবে পাচ্ছেনা ভূক্তভোগীরা।

দৈনিক সংবাদচর্চার বিশেষ অুনসন্ধানে জানা যায়, ২০১৭ সালে নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কুকুরের কামড়ে আক্রান্ত হয়ে নারায়ণগঞ্জ ১০০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসে ৫৭৫২ জন। ৫৭৫২ জনকে বিভিন্ন পর্যায়ে ১১২১৬ টি ভ্যাকসিন দেওয়া হয়। যার মধ্যে ৩২৪০টি ভ্যাকসিন কুকুরের কামড়ে আক্রান্ত রোগীরা বাহির থেকে সংগ্রহ করে নিয়ে আসে। অপর দিকে ২০১৮ সালে আক্রান্ত সংখ্যা ২০১৭ সালকে অতিক্রম করে নারায়ণগঞ্জ ১০০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা নিতে আসে ৫৯৪২ জন। ২০১৮ সালে কুকুরের কামড়ে আক্রান্ত ৫৯৪২ জনকে ২১৬৭৩টি ভ্যাকসিন দেওয়া হয়। যার মধ্যে ৩০২৬ টি ভ্যাকসিন আক্রান্ত রোগীরা বাহির থেকে সংগ্রহ করে নিয়ে আসে।

উল্লেখ্য যে, কুকুরের কামড়ে আক্রান্ত রোগীকে বিভিন্ন পর্যায়ে ৪টি করে ভ্যাকসিন দেওয়ার নিয়ম থাকলেও অজ্ঞাত কারন বশত ২০১৭ ও ২০১৮ সালের ১১৬৯৪ জন রোগীকে ৪৬৭৭৬ টি ভ্যাকসিনের বিপরীতে ৩২৮৮৯ টি ভ্যাকসিন দেওয়া হয়। ১৩৮৮৭টি ভ্যাকসিন দেওয়া হয়নি।

কুকুরের কামড়ে আক্রান্ত মো. দ্বিন ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, আমি কুকুরের কামড়ে আক্রান্ত হয়ে ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়েছি। কর্তব্যরত চিকিৎসক সমস্যা শুনার পর বললেন ভ্যাকসিন দিতে এবং সেই ভ্যাকসিন বাহির থেকে নিয়ে আসতে হবে। কোন উপায়ন্তর না পেয়ে ভিক্টোরিয়া হাসপাতালের গেইটের সামনে ফার্মেসী দোকান থেকে ভ্যাকসিন সংগ্রহ করে নিয়ে গেলে চিকিৎসক সেটা গ্রহণ করে আমাকে চিকিৎসা প্রদান করেন। মো. দ্বীন ইসলাম আরো বলেন, হাসপাতালে ভ্যাকসিন নাই অথচ ফার্মেসীর দোকানে আছে বিষয়টা বড়ই উদ্বেগজনক। হাসপাতালে ভ্যাকসিন থাকলেও কর্তৃপক্ষ সেই ভ্যাকসিন জনসাধারণদের খুব কমই প্রদান করেন।

নারায়ণগঞ্জ ১০০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. আসাদুজ্জামান সংবাদচর্চাকে বলেন, বাংলাদেশের সব জায়গায় কুকুরের কামড়ে আক্রান্তদের ভ্যাকসিন দেওয়া হয়। এছাড়া রোগীরা ভ্যাকসিন পায় না কথাটা ঠিক নয়। স্ব্যাস্থ বিভাগ থেকে যে পরিমান ভ্যাকসিন আমাদের দেওয়া হয় সেগুলো দিয়ে আমারা রোগীদের সেবা দিয়ে থাকি। এছাড়া সরকার থেকে বছরে যে পরিমান ভ্যাকসিন সাপলাই দেয় তার চেয়ে রোগীর সংখ্যা অনেক বেশী তাই যখন ভ্যাকসিন না থাকে তখন রোগীদের বাহিরে থেকে ভ্যাকসিন কিনে নিয়ে আসতে হয়। একজন রোগীকে চারবার ভ্যায়াল দিতে হয় হাসপাতাল থেকে যখন সাপলাই না থাকে তখন এক থেকে দুইবার ভ্যায়াল দেওয়া হয়ে থাকে তবে বাকি ভ্যায়াল গুলো বাহিরে থেকে কিনে নিয়ে আসতে হয়। আর এই ভ্যাকসিন দিলে মৃত্যু ঝুকি নেই। আগে ১৪ টি ভ্যায়াল দিতে হত এখন ৪ টি ভ্যায়াল দিতে হয়। আর বন্ধ্যাত্বকরণ বা নিধন সিটি কর্পোরেশন দায়িত্ব পালন করে থাকেন।

এ ব্যাপারে নারায়ণগঞ্জ সিটি কপোরেশনের আবাসিক চিকিৎসক শেখ মোস্তফা আলী বলেন, কুকুর নিধোনের জন্য পাইলট প্রকল্পের মাধ্যামে নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, নিলফামারী এলাকা গুলোতে কুকুরকে এন্টিবায়েটিক ভ্যাকসিন দেওয়ার কার্যক্রম চলেছে তবে এ কার্যক্রম বছরে দুই বার করা হয়। গত বছরের জুলাই মাসে নারায়ণগঞ্জে করা হয়েছে। কুকুর নিধনের বিষয়টি এখন আমাদের সরাসরি সর্ম্পকিত নয়। এখন এ বিষয়টি জেলা সিভিল সার্জনের মাধ্যমে আমরা দায়িত্ব পালন করে থাকি তবে পাইলট প্রকল্পের একটি সংস্থার মাধ্যামে করে থাকি। এছাড়া নারায়ণগঞ্জ সিটি কপোরেশনের নিজস্ব উদ্যোগে কুকুর বিষয়ে কোন প্রকল্প গ্রহন করা হবে কিনা তা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বলতে পারবেন।

নারায়ণগঞ্জ উপজেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা ডা. নারায়ণ চন্দ্র সরকারের সাথে মুঠো ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, কুকুরের বংশ বিস্তার নিয়ন্ত্রনের জন্য আমাদের নিজস্ব কোন কর্মসূচী নেই। তবে কিছুদিন পূর্বে একটি বেসরকারি এনজিও কুকুরের মাধ্যমে কোন রোগ জীবনু না ছড়ায় সে জন্য কুকুরকে ভ্যাকসিন দেওয়া কাজ করেছে।

এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ সিটি কপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এহেতেশামুল হক বলেন, কুকুর বংশবিস্তার যাতে করতে না পারে সে জন্য সরকারের নির্ধারিত কর্তৃপক্ষ কাজ করছে। এ ছাড়াও কুকুরের বংশ বিস্তার নিয়ন্ত্রনে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন ও দক্ষিন সিটি কর্পোরেশনের পর নারায়ণগঞ্জে একটি বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে তিনটি ওয়ার্ডে কাজ করেছে। আমরা পাইলট প্রকল্পের ফলাফল দেখবে এবং আগামীতে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নিজস্ব তহবিলে এ সকল এনজিওগুলোকে সচল ভূমিকায় রাখা যায় সে বিষয়টি চিন্তা করছে।

স্পন্সরেড আর্টিকেলঃ