আজ বৃহস্পতিবার, ১২ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৫শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

চিকিৎসার নামে ভোগান্তির আরেক নাম খানপুর হাসপাতাল

খানপুর

 

খানপুর
সৈয়দ মো: রিফাত
অনেকের ভাষ্যমতে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের অন্যতম চিকিৎসা কেন্দ্র নারায়ণগঞ্জের খানপুরে অবস্থিত ৩০০শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল। শহরের প্রাণ কেন্দ্রে এই বিশেষায়িত হাসপাতালটির অবস্থান হওয়ায় মানুষের মিছিল শুরু হয় প্রতিদিন আলো ফোটার আগেই। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে। নারায়ণগঞ্জের খানপুরে অবস্থিত সরকারি হাসপাতালটিতে লোকবল কম থাকায় প্রতিনিয়তই রোগীরা ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। নতুন পুরাতন রোগী এবং পরীক্ষা করতে আসা, রিপোর্ট নেয়া, সর্বক্ষেত্রেই রোগীকে দীর্ঘ লাইনে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকে চরম দুর্ভোগের শিকার হতে হচ্ছে।
গতকাল শনিবার সরজমিনে সারাদিন ব্যাপি ঘুরে দেখা যায়, একটি টিকিট কিনতেই রোগীদের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সেই সাথে রয়েছে টিকিট কাউন্টারের সামনে ভ্যাপসা গরম। আবার টিকিট কিনেও ভোগান্তি শেষ হচ্ছে না তাদের। ডাক্তারের চেম্বারের সামনেও দাঁড়াতে হচ্ছে লম্বা সিরিয়ালে। প্রতিদিন হাসপাতালে প্রবেশ করলেই দেখা যায় অসংখ্য রোগীর ভীড়। কারণ মাত্র ২০ টাকার টিকিটে এখানে পাওয়া যায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের চিকিৎসা। সেই সাথে রয়েছে বিনা মূল্যের ঔষধ সহ স্বল্প মূল্যে পরীক্ষা নিরীক্ষা করার সুবিধা। অসুস্থ রোগীরা এমনিতেই দুর্বল তার উপরে দীর্ঘ লাইনে দাড়িয়ে ডাক্তার দেখানোর জন্য অপেক্ষা করতে করতে অনেক রোগীই আরও বেশি অসুস্থ হওয়ার ঘটনা ঘটছে অহরহ।
তাছাড়া, হাসপাতালটিতে রয়েছে জনবল সংকট। যে কারণে রোগীদের পোহাতে হচ্ছে এমন দুর্ভোগ। রোগীরা হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসলেও প্রচন্ড ভিড় আর ভ্যাপসা গরমে আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। এত কষ্ট করে টিকিট নিলেও কখনো কখনো ডাক্তারের চেম্বারের সামনে লম্বা সিরিয়ালের কারণে চিকিৎসা নিতে পারছেন না অনেক রোগী। তাই বাধ্য হয়ে অনেকে বাইরের ক্লিনিকগুলোতে বাড়তি টাকা দিয়ে নিচ্ছেন প্রাইভেট চিকিৎসকের চিকিৎসা।
হাসপাতালটিতে প্রতিদিন গড়ে প্রায় তিন থেকে ৪’শ রোগী চিকিৎসা নিতে আসে। কিন্তু সেই তুলনায় নেই পর্যাপ্ত জনবল। এত লোকের কাছে টিকিট বিক্রির জন্য কাউন্টারে রয়েছে মাত্র ২জন। যে কারণে টিকিট বিক্রি করতে হিমসিম খেতে হচ্ছে তাদের। ফলে টিকিট কাউন্টারের সামনে বাধছে লম্বা সিরিয়াল। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অনেকে করছে টিকেট কালোবাজারি।
জনসাধারনের কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়া যায়, কাউন্টারে কর্মরত তিন জন কর্মকর্তাই প্রতিদিন এক ঘন্টা দেরী করে আসেন। হাসপাতালের কাউন্টারে সকাল সাড়ে ৮ টায় উপস্থিত থাকার নিয়ম থাকলেও প্রতিদিন তারা আসেন ৯ টা কিংবা সাড়ে ৯টা বাজে বা তারও পরে। কাউন্টারের সামনে রোগীদের দীর্ঘ লাইন বাধার অন্যতম কারণ হচ্ছে সময়মত টিকিট কাউন্টার না খোলা।
এ সময় আরও জানা যায়, কাউন্টারের কর্মকর্তাদের যোগসাজসসেই চলে টিকিট কালোবাজারি। দালালদের সাথে আগে থেকে করা চুক্তি অনুযায়ী টাকার বিনিময়ে দালালরা টাকার বিনিময়ে কাউন্টারের সামনে টিকিট বিক্রি করে। এতে সাধারণ রোগীদের ভোগান্তি চরমে পৌছে গেছে।
কব্জিতে ব্যাথা নিয়ে শিবু-মার্কেট থেকে আসা ফজলুল করীম (৬৮) বলেন, ‘এত কষ্ট কইরা আসি কিন্তু কষ্টের ফল পাইনা। আসছি সেই কখন, অনেক কষ্ট কইরা টিকিট পাইছি তাতে কী? ডাক্তার দেখাইতে আবার সিরিয়াল দিছি। আবার ওষুধ আনতে আনতে জানটা মনে হয় শেষ হইয়া যাইবো। সরকারের এইসব বিষয়গুলা একটু দেখা দরকার। আমরা সাধারণ মানুষরা যদি ঠিকমত চিকিৎসা সেবা না পাই তাইলে স্বাধীন দেশে থাইকা লাভ হইলো কী?’
সাইনবোর্ড থেকে আসা হাবিবুর রহমান আক্ষেপ ও অভিযোগ করে বলেন, অধিক মুনাফা লাভের কারণে কর্তৃপক্ষ এর বিকেন্দ্রীকরণ করছেন কি না জানি না। তবে, প্রতিদিন হাসপাতালটিতে অপেক্ষমান মানুষের ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকা ভোগান্তির চিত্র কর্তৃপক্ষ দেখেও যেন না দেখার ভান করছে। এটা তো আসলে কোন নিয়মের মধ্যে পড়ে না। একবিংশ শতাব্দীতে এসে আমাদের এই সব বিষয়ে আর কথা বলতে ভালো লাগে না। সরকারের অবশ্যই উচিৎ এই বিষয়টার দিকে একটু নজর দেয়ার পাশাপাশি ৩’শ থেকে হাসপাতালটি ৫’শ শয্যা করা অতীব জরুরী।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, ২০১৩ সালের ২ সেপ্টেম্বর হাসপাতালটি ৩০০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। এখন হাসপাতালটিকে ৫০০ শয্যায় উন্নীতকরণের কাজ চলছে। সেই সাথে হুহু করে বেড়েছে শহরের জনসংখ্যা ও চিকিৎসা প্রত্যাশী। কিন্তু হাসপাতালের বেড সংখ্যা বাড়লেও এখনো বাড়ানো হয়নি জনবল। তারা বলেন, আমরা চাইলেই সরকারি হাসপাতালে কাউকে নিয়োগ দিতে পারি না, এর অনেক নিয়ম কানুন আছে। যে কারণে ফাঁকা জায়গা পূরণ হচ্ছে না, প্রতিনিয়ত কমছে লোকবল । কিন্তু আমাদের কিছুই করার নেই। লোকবলের অভাবে অবশ্যই রোগীরা সেবা বঞ্চিত হচ্ছে।
আরও জানা যায়, হাসপাতালের ডাক্তার নার্স ও কর্মচারীরাও সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে। কিন্তু আমরা কাউকে কিছু বলতে পারছি না, সবাই এসে আমাদের দোষ দেয়। কিন্তু আমাদের ক্ষমতাটাও তো দেখতে হবে। ডাক্তাররা সকাল ৮ টা থেকে ১১ টা পর্যন্ত রোগী দেখেন, ১০ মিনিট বিশ্রামের সময় পান না। তারাও তো মানুষ, তাদেরও তো ক্লান্তি আছে। এরকম পরিশ্রম করেও যদি গালি শুনতে হয়, তাহলে আর কিবা করার থাকে। ৫০০ শয্যার জন্য যে লোকবল লাগবে তার সংখ্যাও আমরা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি।
দিনের পর দিন অসহায় মানুষগুলো স্বাস্থ্যসেবা নিতে এসে হয়রানির শিকার হলেও তা সমাধানে কারোরই কোন মাথা ব্যাথা নেই। নতুন রোগী এলে কোথায় রক্ত টেস্ট করাবেন, কখন আসতে হবে, পরীক্ষা করতে কোন ডাক্তার দেখাবেন সর্বক্ষেত্রেই বিড়ম্বনা আর ভোগান্তির অন্ত নেই হাসপাতালটিতে।

স্পন্সরেড আর্টিকেলঃ