আজ শনিবার, ৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

করোনার পর সর্বোচ্চ মৃত্যু সড়কে

স্টাফ রিপোর্টার

ঢাকা- চট্টগ্রাম- ঢাকা সিলেট ও এশিয়ান হাইওয়ে সড়কে দূর্ঘটনায় গত ১ বছরে নারী শিশুসহ ১২৭ জন প্রাণ হারিয়েছে। তাছাড়া জেলার বিভিন্ন এলাকায় ছোট বড় দূর্ঘটনায় সড়কে মৃত্যু হয়েছে আরও ২২ জনের। করোনার পর নারায়ণগঞ্জে সর্বচ্চ মৃত্যু হয়েছে সড়ক দূর্ঘটনায়। এরপর রয়েছে আগুনে দগ্ধ হয়ে মৃত্যু। পরিসংখ্যান ঘেটে দেখা গেছে গেল বছর করোনায় আক্রান্ত হয়ে এ জেলায় ৩২৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। বিস্ফোরণ ও আগুনে দগ্ধ হয়ে গত দুই বছরে মারা গেছেন নারী শিশু সহ ১১৮ জন। সড়ক দূর্ঘটনায় অপমৃত্যু কিংবা সড়ক আইনে মামলার সংখ্যাও কম নয় নারায়ণগঞ্জের আদালতে। দূর্ঘটনার পর পুলিশ ও নিহতের স্বজনরা বাদী হয়ে মামলা করেন সংশ্লিষ্ট থানা গুলোতে।

হাইওয়ে পুলিশের তালিকায় বলা হয়েছে, ২০২১ সালের ১ জানুয়ারী থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ড থেকে মেঘনা ও ঢাকা সিলেট মহাসড়কের কাচপুর থেকে পুরিন্দা বাজার ও এশিয়ান হাইওয়ে সড়কের মদনপুর থেকে কাঞ্চন এলাকা পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জের অংশে ১৩১ টি ছোট-বড় দূর্ঘটনায় নারী শিশুসহ ১২৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। যাত্রী ও পথচারীসহ আহত হয়েছেন আরও অর্ধশতাধিক মানুষ।

শুধু মহাসড়ক নয় জেলার বিভিন্ন সড়কগুলোতে ঘটেছে আরও প্রানহানি। থানা পুলিশের তালিকায় বলা হয়েছে, জেলার বিভিন্ন সড়কে চলতি বছরের ১ জানুয়ারী থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দূর্ঘটনায় আরও ২২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এসব ঘটনায় জেলার সাতটি থানায় মামলাও রয়েছে। তবে হাসপাতালে বা বাড়িতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাওয়া ব্যক্তিদের তথ্য নেই পুলিশের কাছে।

জেলার পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম জানান, সড়কে চলাচলরত যানবহানের চালকদের সর্তক থাকতে হবে। তাদের প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি যাত্রী সহ পথচারীদেও সচেতন হতে হবে। দূর্ঘটনা রোধে সড়কগুলোতে ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা কাজ করে থাকেন প্রয়োজন হলেও তাদের পরিসর বৃদ্ধি করা হবে।

কাচঁপুর হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাজ্জাদ করিম খান জানান, তিনটি মহাসড়কে যানবাহনের বেপরোয়া গতি রোধে হাইওয়ে পুলিশের টহল থাকে। তবুও অনাকাঙ্খিত ভাবে দূর্ঘটনাগুলো ঘটছে। ২০২১ সালে তিনটি মহাসড়কে ছোট বড় মিলিয়ে আড়াইশতাধিক দূর্ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ১৩১ টি বড় দূর্ঘটনায় ১২৭ জনের প্রাহহানি ঘটেছে।
তিনি জানান, বেপরোয়া গতির যানবাহন, যান্ত্রিক ক্রুটি সম্পূর্ণ যান, মোটরসাইকেল চালকের অসাবধানতা ও পথচারীর অসচেতনতার কারণে দূর্ঘটনা গুলো বেশি ঘটছে। এসব সমস্য সমাধান হলে দূর্ঘটনা কমে আসতে পারে।

হাইওয়ে পুলিশের ওসি বলেন, সড়কে প্রাণহানির ঘটনায় মামলা হয়ে থাকে তবে অধিকাশং ক্ষেত্রে গাড়ি ফেলে চালক পালিয়ে যায়। আমরা যানটি জব্দ করি পাশাপাশি চালক আটকের চেষ্টা করে থাকি। যেসব ঘটনায় চালক ও যান পলাতক থাকে আমরা তাও খুজে বের করার কাজ অব্যহত রাখি।

আদালত পুলিশের পরির্দশক আসাদুজ্জামান জানান, এ বছরের ২০ ডিসেম্ববার পর্যন্ত সড়ক আইনের ১১১ টি মামলার নথি আদালতে উঠেছে। ২০২০ সালে ১৪৯ ও ২০১৯ সালে ১১৩ টি মামলা আসে আদালতে। ওইসব মামলা গুলোর মধ্যে কিছু মামলার বিচারকার্য শেষ হলেও অনেক মামলা আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।

নারায়ণগঞ্জ আদালতের সরকারি কৌশুলি এ্যাডভোকেট মনিরুজ্জামান বুলবুল জানান, করোনা সহ নানা সংকটের কারণে সড়ক দূর্ঘটনার অধিকাশং মামলার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। তিনি জানান, সেসব ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা যায় সেসব ঘটনাতে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে পুলিশ তবে চালক, হেলপার ও গাড়ি শনাক্ত করা না গেলে আদালতে চুড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেন মামলা তদন্ত কর্মকর্তা।

রাষ্টপক্ষের আইজীবী আরও বলেন, ঘটনার সময়ের প্রত্যাক্ষদর্শী, সহ বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করে পুলিশ জড়িতদের আইনের আওতায় আনলে তাহলে মামলাগুলোতে অভিযোগ দেয়া সম্ভব হয়। এজন্য প্রতিটি সড়ক আইনের মামলায় পুলিশের ভূমিকা মূখ্য। মামলাগুলোকে তাদের আরও বেশি গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা প্রয়োজন। কারণ দূর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো স্বজন হারিয়ে দোষীদের বিচারের অপেক্ষায় থাকে।

সড়ক দূর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্থদের পরিবারের মতো দোষীদের শাস্তির দাবি জানিয়ে আসছে বিভিন্ন সংগঠনও। সভা ও মানববন্ধন করছে বছর জুড়ে। সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজনের নারায়ণগঞ্জের সাধারণ সম্পাদক ধিমান সাহা জুয়েল জানান, অদক্ষ ও বেপরোয়া গাড়ি চালক, ফিটনেসবিহীন গাড়ি, যানবাহন চলাচলে অযোগ্য রাস্তা ও জনসচেতনার অভাবে দুর্ঘটনা বেশি ঘটছে।

তিনি জানান, সড়কে প্রানপ্রানির ঘটনার পর মামলা হলেও তদন্ত বেশি দূর গড়ায়না ফলে যেসব ঘটনায় চালক ধরা পড়ে তাদের আদালতের মাধ্যমে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। তবে বেশির ভাগ ঘটনায় যানবাহনের চালক পালিয়ে আত্ম গোপন করে। মামলা হলেও পুলিশ তাদের ধরতে পারেনা। ফলে ওই সব ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলো বিচার না পেয়ে হতাশায় ভুগে। আমরা পুলিশ সহ সংশ্লিষ্ট সকলের কাছে দাবি করছি যারা সড়ক নিরাপদ রাখার দায়িত্বে থাকেন তারা প্রতিটি ঘটনার তদন্ত নিশ্চিত করুন। ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে আইনের আওতায় আনুন। কারণ প্রশাসন কঠোর হলে অপরাধী পালিয়ে থাকতে পারে না। পাশাপাশি দূঘর্টনার রোধে নানা মুখি পরিকল্পনা সহ জনসতেনতা আরও বাড়ানো প্রয়োজন।

নিরাপদ সড়ক চাই সংগঠনের নারায়ণগঞ্জের সভাপতি ডা. আল ওয়াজেদুর রহমান জানান, আমরা ২৮ বছর ধরে মানুষকে সচেতন করা সহ প্রশাসনের কাছে সড়ক দূর্ঘটনা রোধে বিভিন্ন দাবি করে আসছি। ঘটনার সাথে জড়িদের শাস্তি দাবি করছি নানা কর্মসূচির মাধ্যমে।

বছরের পর বছর ঘুরেও বিচার শেষ না হওয়াকে নিয়েও ক্ষোভ রয়েছে নিহত ও আহতদের স্বজনদের। নিজের একমাত্র সন্তান হারিয়ে ন্যায় বিচারের জন্য নারায়ণগঞ্জের আদালতপাড়ায় ঘুড়ে বেড়াচ্ছেন আইনজীবী মা আয়েশা সিদ্দিকী। আয়েশা সিদ্দিকী ও তার মেয়ে বেলী আক্তার সদূর আমেরিকা থেকে নারায়ণগঞ্জে আসেন অসুস্থ মায়ের খোঁজ নিতে। ছুটির দিন শুক্রবার বাবার সাথে এক আত্মীয়ের বিয়ে অনুষ্ঠানে যোগদিতে বেলী আক্তার ও তারা বাবা আলতাফ হোসেন রিক্সা যোগে জামতলা থেকে চাষাঢ়ায় যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে নগরীর কলেজ রোড এলাকায় আসতেই ইটবাহী ট্রাকের ধাক্কায় সড়কেই মৃত্যু হয় তাদের দুজনের। গেল বছর ১০ ডিসেম্বর নগরীর চাষাঢ়া কলেজ রোড এলাকায় মর্মান্তিক এই সড়ক দূর্ঘটনাটি সংঘটিত হয়।

সড়ক দূর্ঘটনায় কলেজ শিক্ষক বাবাকে হারিয়ে প্রতি রাতেই কাঁদেন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেয়ে তাসনিম। ৫ বছর বয়সী তার ছোট্ট মেয়েটির কাছে আড়াল করতে হয় চোখের জল। স্বামী হারা মাকেও দিতে হয় সান্তনা অথচ কিছুদিন আগেই সুখের সংসার ছিলো তাদের। তাসনিম বলেন, সব কিছু ঠিকি ছিলো। কেন সেই (দূর্ঘটনার) দিনটি আমাদের জীবনে এলো। রাস্তার পাশে দাড়িয়ে ছিলেন বাবা, হঠাৎ একটি গাড়ির ধাক্কায় ছিটকে পড়েন তিনি। হাসপাতলে নেয়ার দুইদিন পর ডাক্তার জানান বাবা আর নেই। বাবাকে হারিয়ে মনে হয় যেন সবকিছুই হারিয়েছি।

দূর্ঘটনার স্মৃতি নিয়ে এখনো বেঁচে আছেন এক সময়ের পোশাক কারখানার শ্রমিক বিদেশী চন্দ্র বিশ্বাস। মর্মান্তিক এক সড়ক দূর্ঘটনায় নিজের দু’পা হারিয়ে শোকে পাথ হয়ে এখনো বিলাপ করেনে সেই দিনের (দূর্ঘটনার) কথা মনে করে। বিদেশী চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, আমার দুই পাও নাই, থাকালে হয়তো ভালোভাবে বাঁচতে পারতাম। এখন আর পা হারানোর কষ্ট লাগেনা, এখন শোকে পাথর হয়ে গেছি। যে গাড়িটি ধাক্কা দিয়ে ছিলো তাকে ধরতে পারেনি কেউ, হয়তো ধরতে পারবেও না।

স্পন্সরেড আর্টিকেলঃ