আজ শনিবার, ৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

ইটপাথরের শহরে নাগলিঙ্গম

সংবাদচর্চা অনলাইনঃ

প্রাচ্যের ড্যান্ডি খ্যাত নারায়ণগঞ্জ শহরের আনাচে কানাচে লুকিয়ে আছে না জানা কত রহস্য। শিল্প, বাণিজ্যের যান্ত্রিক এই ইট পাথরের শহরে লুকানো সেই রহস্য উন্মোচন করে কে? কার এত সময়। তাই সৌন্দয্য মন্ডিত হলেও তা রয়ে লোকচক্ষুর আড়ালে। এমনই এক বিস্ময় গত ২০ বছর যাবৎ আড়ালে রয়েছে শহরের কালিরবাজার এলাকায়। প্রায় সময় তা মানুষের চোখে পড়ে। তার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয় সবাই কিন্তু চেনা হয় না কারো। প্রত্যেকবার প্রশ্ন নিয়ে ফিরে আসে সবাই।

নারায়ণগঞ্জ রেলওয়ের স্টেশন মাস্টারের ডাক বাংলোর শেষ প্রান্তে রয়েছে সেই বিষ্ময় বিলুপ্তপ্রায় নাগলিঙ্গম গাছ। মনমুগ্ধকর লাল টুকটুকে সাপের ফনার মত ফুল আর বেলের মত ফল। নাগলিঙ্গম ফুলের সুবাস অনেকটা গোলাপ ও পদ্মের সংমিশ্রণ। যার তীব্র ঘ্রাণের মাদকতা পথচারীদের আকৃষ্ট করবেই। ঔষধি এই গাছটির আদি নিবাস মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার গভীর বনাঞ্চলে। তবে কবে এবং কিভাবে বাংলাদেশে গাছটি এসেছিলো তা জানা নেই কারো। দুষ্প্রাপ্য নাগলিঙ্গম গাছটি ৮০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। নাগলিঙ্গম গাছের ইংরেজি নাম ‘ক্যাননবল ট্রি’ এবং বৈজ্ঞানিক নাম । নাগলিঙ্গম ফুল দেখতে অপেক্ষা করতে হয় প্রায় ১০ বছর। গোটা পৃথিবীতে গাছটি এখন বিলুপ্তির পথে।

আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, নারায়ণগঞ্জ শহরের এই ছোট্ট গন্ডির মধ্যে নাগলিঙ্গম গাছ আছে ৪ টি এবং জেলায় দশের অধিক। এরপরও নাগলিঙ্গমের নাম শুনলে কপাল কুচকে তাকিয়ে থাকেন অনেকে।
শহরের প্রাণকেন্দ্র চাষাঢ়া শহীদ মিনারে কতবারই না যাওয়া হয়েছে। কিন্তু একবারও দেখা হয়নি ১৭ বছর বয়সী নাগলিঙ্গম গাছের সঙ্গে। শহীদ মিনার প্রাঙ্গনে গিয়ে ১০ মিনিট খোঁজাখুজির পর গাছের পাতা দেখে নিশ্চিত হওয়া গলো এই সেই নাগলিঙ্গম। জানা যায়, ২০১৭ সালে একবার ফুলে সুসজ্জিত হয়েছিল গাছটি। ফুল ছিড়তে গিয়ে কিছু পথশিশু গাছের একটি বড় ডাল ভেঙ্গে ফেলে। যার চিহ্ন এখনো রয়েগেছে গাছটির গায়ে। এরপর থেকে আর ফুল, ফল আসেনি গাছটিতে।

২০০৩ সালে গাছটি রোপন করেছিলেন গাছ প্রেমী, সাংবাদিক আফসার বিপুল। তিনি জানান, বিলুপ্ত গাছটি বাঁচাতে এবং নতুন প্রজন্মকে এর সাথে পরিচিত করতে ২০০৩ সালে চাষাঢ়া শহীদ মিনারে একটি, রামকৃষ্ণ মিশনে দু’টি এবং খানপুর বার একাডেমী প্রাঙ্গণসহ একাধিক স্থানে নাগলিঙ্গমের চারা রোপণ করেছিলেন তিনি। যার মধ্যে রামকৃষ্ণ মিশনের একটি গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। রক্ষনাবেক্ষণের অভাবে আরেকটিতে এবছর কোনো ফুল হয়নি।

আফসার বিপুল বলেন, ‘আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর নাগলিঙ্গম গাছ ছিলো ফতুল্লা স্টেডিয়ামের পাশে একটি বাড়ির সামনে। গোড়া থেকে আগা পর্যন্ত ফুলে মোড়ানো ছিল গাছটি। ফুলের মুগ্ধকর ঘ্রাণ এখনো মাতাল করে তোলে আমাকে।’

জানা যায়, নাগলিঙ্গম গাছের রয়েছে ব্যাপক ঔষধি গুণ। এর ফুল, পাতা ও বাকলের নিযার্স থেকে বিভিন্ন ধরনের ওষুধ তৈরি হয়। এন্টিবায়োটিক, এন্টিফাঙ্গাল, এন্টিসেপটিক হিসেবে ব্যবহার করা হয় এর নিযার্স। এই গাছ থেকে তৈরি ওষুধ পেটের পীড়া দূর করে। পাতার রস ত্বকের নানা সমস্যায় কাজ দেয়। ম্যালেরিয়া রোগ নিরাময়ে নাগলিঙ্গমের পাতার রস ব্যবহার হয়।
লেখক, সাংবাদিক শরিফ উদ্দিন সবুজ জানান, এর বাইরে নাগলিঙ্গম গাছ রয়েছে রূপগঞ্জ এবং আড়াইহাজার উপজেলায়ও। তিনি বলেন, ‘আড়াইহাজার জমিদার বাড়িতে প্রথম দেখা হয়েছিলো নাগলিঙ্গম গাছের সঙ্গে। সেই মনমুগ্ধকর দৃশ্যটি আমার এখনো মনে পরে। এরপর রূপগঞ্জ উপজেলার জিন্দা পার্কে দ্বিতীয়বার আমি এই গাছটির দেখা পেয়েছিলাম।’

রয়্যাল বোটানিক গার্ডেন ও স্টকহোম বিশ^বিদ্যালয়ের এক গবেষণার তথ্যমতে, গত ২৫০ বছরে প্রায় ৬০০ প্রজাতির উদ্ভদ পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। যা একই সময়ে বিলুপ্ত পাখি, স্তন্যপায়ী প্রাণী ও সরীসৃপের মিলিত সংখ্যার দ্বিগুণ। বিজ্ঞানীদের ভাষ্যমতে, সাধারণ ধারণার চেয়ে ৫০০ গুণ দ্রুত গতিতে গাছ বিলুপ্তির ঘটনা ঘটছে। কিন্তু বিষয়টি সেভাবে মনোযোগ পাচ্ছে না। অনেকেই বলতে পারবে না, কোন গাছটি এখন আর দেখা যায় না। ফলে প্রতিবছর পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে যাচ্ছে অনেক উদ্ভিদ।

গাছপ্রেমীদের শঙ্কা, নতুন প্রজন্মের সঙ্গে গাছের পরিচয়, সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ এবং সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া না হলে হয়তো একদিন অন্যান্য উদ্ভিদের মত বাংলাদেশের বুক থেকে হারিয়ে যাবে বিলুপ্তপ্রায় নাগলিঙ্গমও।

স্পন্সরেড আর্টিকেলঃ