আজ শুক্রবার, ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ, ২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

আজ বাংলা নববর্ষ, বর্ণিল উৎসবে মেতেছে গোটা বাঙালি জাতি

আজ বাংলা নববর্ষ,

আজ বাংলা নববর্ষ,

নবকুমার:

কয়েক দিন ধরেই প্রস্তুতি নিয়েছে নিজেদের শিকড়সন্ধানী উৎসবের। জাতিসত্তার সুন্দরতম আনন্দ প্রকাশের সেই দিন এলো বাঙালির জীবনে।আজ শনিবার পহেলা বৈশাখ, ১৪২৫ বঙ্গাব্দ।  পহেলা বৈশাখে বর্ণিল উৎসবে মেতেছে দেশ। সকালে ভোরের প্রথম আলো রাঙিয়ে দেয় নতুন স্বপ্ন, প্রত্যাশা আর সম্ভাবনাকে।

আজ থেকে আরেকটি নতুন বছরের পরিক্রমা শুরু হলো বাঙালির নিজস্ব বর্ষপঞ্জিতে। বাংলাভাষীর জীবনে এলো এক অমলিন আনন্দের দিন। বাঙালি আজ সকালে জেগে উঠেছে নতুন সূর্যের আলোয়; আজ সবাই দিনভর মেতে রইবে নাচে-গানে, উৎসবে-আমোদে।

পহেলা বৈশাখ জাতির এক অনুপ্রেরণার দিন। সবচেয়ে বৃহত্তম অসাম্প্রদায়িক ও সর্বজনীন উৎসবও। আজ সর্বস্তরের মানুষ হৃদয়ের টানে, বাঙালিয়ানার টানে মিলিত হবে এ উৎসবে। তাতে থাকবে না কোনো ধর্ম-বর্ণের ভেদাভেদ, থাকবে না ধনী-গরিবের বৈষম্য। উৎসবে শামিল হয়ে বাঙালি তার আপন ঐতিহ্য, সাংস্কৃতিক নিজস্বতা ও গৌরবময় জাতিসত্তার পরিচয়ে আলোকিত হবে। বাঙালির এ চেতনাই গোটা জাতিকে মিলিত করেছিল, মহান মুক্তিযুদ্ধে নিজস্ব অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে প্রেরণা জুগিয়েছিল। পহেলা বৈশাখে তাই বাঙালি আনন্দ-উৎসবের মধ্য দিয়ে আবার জেগে ওঠে, এক সুরে গেয়ে ওঠে বাঙলির জয়গান।

রাজধানী জুড়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে বর্ষবরণের নানা আয়োজন। নববর্ষকে স্বাগত জানিয়ে রাষ্ট্রপতি মো: আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃখক বাণী দিয়েছেন।আজ বাংলা নববর্ষ,

এছাড়াও আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা এবং অভিনন্দন জানিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড মো. আখতারুজ্জামান বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার সহ সবাইকে বাংরা নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।

কৃষিকাজ ও খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য বাংলা সন গণনার শুরু মোঘল সম্রাট আকবরের সময়ে। হিজরি চান্দ্রসন ও বাংলা সৌরসন ভিত্তি করে প্রবর্তন হয় নতুন এই বাংলা সন।

১৫৫৬ সালে কার্যকর হওয়া বাংলা সন প্রথমদিকে পরিচিত ছিল ফসলি সন নামে, পরে তা পরিচিত হয় বঙ্গাব্দ নামে। কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজের সঙ্গে বাংলাবর্ষের ইতিহাস জড়িয়ে থাকলেও এর সঙ্গে রাজনৈতিক ইতিহাসেরও সংযোগ ঘটেছে।

পাকিস্তান শাসনামলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয় বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের। আর ষাটের দশকের শেষে তা বিশেষ মাত্রা পায় রমনা বটমূলে ছায়ানটের আয়োজনের মাধ্যমে।

দেশ স্বাধীনের পর বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতীকে পরিণত হয় বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। উৎসবের পাশাপাশি স্বৈরাচার-অপশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদও এসেছে পহেলা বৈশাখের আয়োজনে। ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে বের হয় প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা।যা ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ইউনেস্কো এ শোভাযাত্রাকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মর্যাদা দেয়।

বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে নববর্ষ উদযাপন পরিণত হয়েছে বাংলাদেশের সার্বজনীন উৎসবে। পহেলা বৈশাখের ভোরে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর আয়োজনে মেতে ওঠে সারাদেশ। কাল বর্ষবরণের এ উৎসব আমেজে মুখরিত থাকবে বাংলার চারদিক। গ্রীষ্মের খরতাপ উপেক্ষা করে বাঙালি মিলিত হবে তার সর্বজনীন এই অসাম্প্রদায়িক উৎসবে। দেশের পথে ঘাটে, মাঠে-মেলায়, অনুষ্ঠানে থাকবে কোটি মানুষের প্রাণের চাঞ্চল্য, আর উৎসব মুখরতার বিহ্বলতা।
পহেলা বৈশাখ বাঙালি সংস্কৃতির প্রধান উৎসব উল্লেখ করে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান বলেন, বাংলা নববর্ষে মহামিলনের আনন্দ উৎসব থেকেই বাঙালি ধর্মান্ধ অপশক্তির কূট ষড়যন্ত্রের জাল ভেদ করবার আর কুসংস্কার ও কুপমন্ডুকতার বিরুদ্ধে লড়াই করবার অনুপ্রেরণা পায় এবং জাতি হয় ঐক্যবদ্ধ।

তিনি বলেন, নতুন বছর মানেই এক নতুন সম্ভাবনা, নতুন আশায় পথ চলা। বুকভরা তেমনি প্রত্যাশা নিয়ে নতুন উদ্যমে ও চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে জাতি কাল আরো সোচ্চার হবে সাম্প্রদায়িক অপশক্তি মৌলবাদ ও জঙ্গি নিধনের দাবিতে।

নববর্ষ উপলক্ষে কাল সরকারি ছুটির দিন। জাতীয় সংবাদপত্রগুলো বাংলা নববর্ষের বিশেষ দিক তুলে ধরে ক্রোড়পত্র বের করবে। সরকারি ও বেসরকারি টিভি চ্যানেলে নববর্ষকে ঘিরে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানমালা প্রচার করা হবে।

বাঙালির এই প্রাণের উৎসবকে ঘিরে রমনা পার্কসহ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার পুরোটাই ঢেকে দেয়া হয়েছে নিরাপত্তা চাদরে। শুধু রাজধানী ঢাকাই নয় এ উপলক্ষে সারাদেশেই নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশ ও র‌্যাবের পাশাপাশি গোয়েন্দা সংস্থা ও তাদের আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে যৌথভাবে কাজ করছে সব সংস্থা। সার্বিক নিরাপত্তা ও নজরদারি নিশ্চিত করতে বসানো হয়েছে কন্ট্রোল রুম, অবজারভেশন পোস্ট ও চেক পোস্ট। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের পাশাপাশি থাকছে গোয়েন্দা দলের সদস্য, বোমা ডিসপোজাল টিম ও মেডিক্যাল টিম।

বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ উদযাপন ১৪২৫ উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ, ইনস্টিটিউট এবং ক্যাম্পাসের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বর্ণাঢ্য কর্মসূচী গ্রহণ করেছে।

পহেলা বৈশাখ সকাল ৯টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামানের নেতৃত্বে চারুকলা অনুষদ থেকে বের করা হবে মঙ্গল শোভাযাত্রা। “মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি” প্রতিপাদ্য ও মর্মবাণী ধারণ করে অনুষ্ঠিত হবে এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রা।

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট দুই বছর বিরতি দিয়ে এবার পহেলা বৈশাখে বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহন করেছে।

জাতীয় প্রেসক্লাব বর্ষবরণে তাদের সদস্য ও পরিবারবর্গের জন্য সকাল থেকেই খৈ, মুড়ি মুড়কি, বাতাসা ও বাঙালি খাবারের আয়োজন রেখেছে। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিও অনুরূপ আয়োজন রেখেছে তাদের সদস্য ও পরিবারের সদস্যদের জন্য।বাসস।

পহেলা বৈশাখে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের নানা বয়সের মানুষ উৎসবের আলোয় রঙিন হয়ে উঠছে। পোশাক-পরিচ্ছদ, খানাপিনা, গানবাদ্যসহ সব কিছুতে থাকবে বাঙালিয়ানার প্রাধান্য। দিনভর ঘোরাঘুরি, আড্ডা, আমন্ত্রণ ও তুমুল উচ্ছ্বাসে মেতে উঠবে জাতি। যান্ত্রিক শহর ঢাকার মানুষ সাতসকালেই বের হয়েছে ঘর থেকে। নারীরা পরছে লাল-সাদা শাড়ি, ছেলেদের পরনে থাকবে রংবেরঙের পাঞ্জাবি, ফতুয়াসহ বৈশাখের সাজসজ্জা। মা-বাবার সঙ্গে বেরিয়ে পরবে শিশু-কিশোরের দল। রাজধানীতে আজ বসবে নানা সাংস্কৃতিক উৎসব। মানুষ দল বেঁধে তাতে অংশ নেবে।

রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ : বাঁশিতে ভোরের রাগালাপে এবার বাংলা নববর্ষ বরণ করবে ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ছায়ানট। বাংলা নববর্ষ ১৪২৫-এর প্রথম প্রহরে সকাল সোয়া ৬টায় বাঁশিতে ভোরের রাগালাপ দিয়ে বরণ শুরু হবে বর্ষবরণের এ প্রভাতি আয়োজন। ১৬টি একক গান, ১২টি সম্মেলক গান, দুটি আবৃত্তি এবং সব শেষে ছায়ানটের সভাপতি সন্জীদা খাতুনের নতুন বছরের আবাহনী কথন দিয়ে শেষ হবে এ বছরের অনুষ্ঠান। প্রভাতি এ আয়োজনে দেড় শতাধিক শিল্পী অংশ নিচ্ছেন। ছায়ানটের বর্ষবরণের এবারের প্রতিপাদ্য ‘বিশ্বায়নের বাস্তবতায় শিকড়ের সন্ধান’। সকাল সোয়া ৬টায় শুরু হয়ে সোয়া দুই ঘণ্টার ব্যাপ্তিকালের এ আয়োজন শেষ  সকাল সাড়ে ৮টায়।

চারুকলার ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ : নববর্ষ বরণে চারুকলা অনুষদের আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয় ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। সকাল সাড়ে ৮টায় চারুকলা অনুষদ থেকে ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’ প্রতিপাদ্যের এই শোভাযাত্রা শুরু হয়। শোভাযাত্রায় থাকবে পাঁচ শতাধিক শিল্পকর্ম। শোভাযাত্রাটি চারুকলা থেকে বের হয়ে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল (সাবেক রূপসী বাংলা) হয়ে পুনরায় চারুকলায় এসে শেষ হয়।

শিল্পকলার আয়োজনে পাঁচ মঞ্চে উৎসব : বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন উপলক্ষে শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে রাজধানীর পাঁচ মঞ্চে হবে অনুষ্ঠান। সকাল ৭টায় মিরপুর, সকাল ৯টায় উত্তরার রবীন্দ্র সরণি বটতলায়, বিকেল ৩টায় পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সাড়ে ৪টায় শিল্পকলা একাডেমির উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে লোকজ সাংস্কৃতিক পরিবেশনা এবং বিকেল ৫টায় একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার মূল মিলনায়তনে আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।

চ্যানেল আই-সুরের ধারার আয়োজন : নতুন বছরকে গ্রহণ করে নিতে আজ পহেলা বৈশাখের প্রভাতের প্রথম প্রহরে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার নেতৃত্বে সারা দেশ থেকে নির্বাচিত হাজারও শিল্পীর কণ্ঠে পরিবেশিত হবে বর্ষবরণের গান। অনুষ্ঠানস্থলে থাকবে বাঙালির হাজার বছরের বিভিন্ন ঐতিহ্যের উপাদান দিয়ে সাজানো বৈশাখী মেলার হরেক রকম স্টল। উৎসব চলবে দুপুর ২টা পর্যন্ত।

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আয়োজন : সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আয়োজনে ধানমণ্ডি রবীন্দ্রসরোবর মঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে সম্মিলিত পহেলা বৈশাখের বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানমালা। বিকেল ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত বর্ষবরণ অনুষ্ঠান।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর : সকাল ৯টায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হবে বাংলা নববর্ষ বরণের অনুষ্ঠান। এতে নৃত্য পরিবেশন করবে নৃত্যজন ও সংগীতাঙ্গন মণিপুর। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করবে কল্পরেখা, ইউসেপ স্কুল, আগারগাঁও আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় ও বধ্যভূমির সন্তানদল এবং বাউল গান পরিবেশন করবেন রঞ্জিত দাস বাউল ও মমতা দাসী।

বাংলা একাডেমি : বক্তৃতানুষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে বাংলা একাডেমি। সকাল সাড়ে ৭টায় একাডেমির রবীন্দ্র চত্বরে নববর্ষ বক্তৃতা প্রদান করছে প্রাবন্ধিক-গবেষক আবুল মোমেন। বক্তৃতা পর্ব শেষে অনুষ্ঠিত হবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানমালা। একাডেমি প্রাঙ্গণে শুরু হচ্ছে ১০ দিনের বইয়ের আড়ং ও বৈশাখী মেলা। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত মেলার কার্যক্রম চলবে। প্র্রতিদিন সন্ধ্যায় মেলা মঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

বেঙ্গল ফাউন্ডেশন : নববর্ষ উপলক্ষে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের আয়োজনে থাকছে ‘পরান ভরি দাও’ গানের আসর। লালমাটিয়ার বেঙ্গল বই ঘরের এই অনুষ্ঠানে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকবে পথিক বাউলের বাঁশি ও গান।

 

স্পন্সরেড আর্টিকেলঃ