আজ মঙ্গলবার, ১০ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৩শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

আজ বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মদিন

আজ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মদিন। সেই সঙ্গে শুরু মুজিববর্ষেরও। বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকীর দিন ১৭ মার্চ ২০২০ থেকে ২০২১ সালের ২৬ মার্চ পর্যন্ত বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে এ বর্ষ উদযাপন করা হবে। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা  ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার তৎকালীন গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়ার সম্ভ্রান্ত শেখ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম শেখ লুত্ফর রহমান ও মাতার নাম সায়েরা খাতুন। পিতা-মাতার চার কন্যা এবং দুই পুত্রের সংসারে তিনি ছিলেন তৃতীয়। এই দিনটি জাতীয় শিশু কিশোর দিবস হিসেবেও উদযাপিত হয়।

খোকা নামের সেই শিশুটি পরবর্তীতে হয়ে ওঠেন নির্যাতিত-নিপীড়িত বাঙালির ত্রাতা ও মুক্তির দিশারী। গভীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, আত্মত্যাগ এবং জনগণের প্রতি মমত্ববোধের কারণে পরিণত বয়সে হয়ে ওঠেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা। এক রাজনৈতিক সংগ্রামবহুল জীবনের অধিকারী এই নেতা বিশ্ব ইতিহাসে ঠাঁই করে নেন স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার হিসাবে। বাঙালি জাতির ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর অবদান চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকবে।

মহাকালের আবর্তে অনেক কিছুই হারিয়ে যায়। হারিয়ে যাওয়া এ নিয়মের মধ্যেও অনিয়ম হয় কিছু স্মৃতি, গুটিকয়েক নাম। বাংলা ও বাঙালীর কাছে বঙ্গবন্ধু নামটি তেমনই। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ এ বাঙালীর অবদানের পাশাপাশি তাঁর জন্মের তিথিও চিরজাগরুক থাকবে বাঙালীর প্রাণের স্পন্দনে। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ হাজার বছরের শৃঙ্খলিত বাঙালীর মুক্তির দিশা নিয়ে জন্ম হয় মুজিব নামের এক দেদীপ্যমান আলোক শিখার। এ আলোক শিখা ক্রমে ক্রমে ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র, নিকষ কালো অন্ধকারের মধ্যে পরাধীনতার আগল থেকে মুক্ত করতে পথ দেখাতে থাকে পরাধীন জাতিকে। অবশেষে বাংলার পুব আকাশে পরিপূর্ণ এক সূর্য হিসেবে আবির্ভূত হয়, বাঙালী অর্জন করে মুক্তি। স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু আজ নেই, কিন্তু সে সূর্যের প্রখরতা আগের চেয়েও বেড়েছে অনেকগুণ। তাঁর অবস্থান এখন মধ্যগগনে। সেই সূর্যের প্রখরতা নিয়েই বাঙালী জাতি আজো সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে। এই দেশ ও এই ভূখণ্ড যতদিন থাকবে, পদ্মা-মেঘনা-যমুনায় যতদিন স্রোতধারা বহমান ততদিন বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারিত হবে এর সর্বত্রই, সবখানে।

আজীবন সংগ্রামী বঙ্গবন্ধুর যখন জন্ম হয় তখন ছিল বৃটিশ রাজত্বের শেষ অধ্যায়। গ্রামের স্কুলে তাঁর লেখাপড়ার হাতেখড়ি। ১৯২৭ সালে শেখ মুজিব গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। নয় বছর বয়সে তথা ১৯২৯ সালে গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে ভর্তি হন এবং এখানেই ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। ১৯৩৭ সালে গোপালগঞ্জ মাথুরানাথ ইনস্টিটিউট মিশন স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হন। কিশোর বয়সেই বঙ্গবন্ধু সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে তত্কালীন বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে যোগদানের কারণে বঙ্গবন্ধু প্রথমবারের মতো গ্রেফতার হয়ে কারাবরণ করেন। এরপর থেকে শুরু হয় তার বিপ্লবী জীবন। গোপালগঞ্জ মিশন স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করার পর তিনি কলকাতার ইসলামীয়া কলেজে (বর্তমান নাম মাওলানা আজাদ কলেজ) ভর্তি হন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত এই কলেজটি তখন বেশ নামকরা ছিল। এই কলেজ থেকে সক্রিয়ভাবে তিনি ছাত্র রাজনীতি শুরু করেন। ১৯৪৭ সালে অর্থাৎ দেশবিভাগের বছর এ কলেজ থেকে বিএ ডিগ্রী লাভ করেন। সহকর্মীদের নিয়ে ১৯৪৮ সালে গঠন করেন ছাত্রলীগ।

পাকিস্তান-ভারত পৃথক হয়ে যাওয়ার পর শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠা করেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ যার মাধ্যমে তিনি উক্ত প্রদেশের অন্যতম প্রধান ছাত্রনেতায় পরিণত হন। ১৯৩৮ সালে আঠারো বছর বয়সে বঙ্গবন্ধুর সাথে বেগম ফজিলাতুন্নেসার বিয়ে হয়। এই দম্পতির ঘরে দুই কন্যা এবং তিন পুত্রের জন্ম হয়। কন্যারা হলেন বর্তমান শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা। আর পুত্ররা হলেন শেখ কামাল, শেখ জামাল এবং শেখ রাসেল। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী ছিলেন বঙ্গবন্ধু। কালের পরিক্রমায় কখনো ভাষার জন্য, কখনো স্বাধিকারের জন্য চলতে থাকে আন্দোলন। এসবের আড়ালে গড়ে উঠে স্বাধীনতার আন্দোলন। ৬৬’র ছয় দফা আন্দোলন, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান পেরিয়ে ৭০ সালের নির্বাচনে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি বাঙালির অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হন। ১৯৪৮ সাল থেকে ৫২’র মহান ভাষা আন্দোলন, ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬’র ঐতিহাসিক ৬ দফা, স্বায়ত্তশাসনের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে, কথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধু কারারুদ্ধ হন। ৭০’র নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর ৬ দফার পক্ষে অকুণ্ঠ সমর্থন জানায় বাঙালি জাতি। এতে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দলের ম্যান্ডেট লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাঙালির এই নির্বাচনে বিজয়কে মেনে নেয়নি।

সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসাবে আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে তারা নানা ষড়যন্ত্র শুরু করে। ৭১’র মার্চে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নজীরবিহীন অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। ৭ই মার্চ তত্কালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু বজ্রকন্ঠে ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বঙ্গবন্ধুর এই ঐতিহাসিক আহ্বানে সাড়া দিয়ে সেদিন গোটা বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ৭১’র ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ‘অপারেশন সার্চ লাইট’র নামে নিরস্ত্র বাঙালির উপর আক্রমণ শুরু করলে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু তাঁর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসভবন থেকে ওয়ারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এ ঘোষণার পর বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কারাগারে আটক রেখে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী তাঁর প্রথম বিচার শুরু করে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা মোতাবেক ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বীর বাঙালি ৭১’র ১৬ ডিসেম্বর বিজয় ছিনিয়ে নেয়। জন্ম হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। ৭২’র ১০ জানুয়ারি বিশ্ব নেতৃবৃন্দের চাপে পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করে তিনি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। দেশে ফিরেই তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে মনোনিবেশ করেন। কিন্তু সেই সুযোগ বেশিদিন পাননি তিনি। ১৯৭৫ সালে জাতির অর্থনৈতিক মুক্তি তথা একটি শোষণমুক্ত ও সুখী-সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্যে তিনি জাতীয় কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এর কিছুদিনের মধ্যেই ৭৫’র ১৫ আগস্ট কালরাতে ঘাতকদের তপ্ত বুলেটে সপরিবারে নিহত হন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

বিশ্ব গণমাধ্যমের চোখে বঙ্গবন্ধু ক্ষণজন্মা পুরুষ। অনন্য সাধারণ এই নেতাকে ‘স্বাধীনতার প্রতীক’ বা ‘রাজনীতির ছন্দকার’ খেতাবেও আখ্যা দেয়া হয়। বিদেশী ভক্ত, কট্টর সমালোচক এমনকি শত্রুরাও তাদের নিজ নিজ ভাষায় তাঁর উ”চকিত প্রশংসা করেন। বিগত বিংশ শতাব্দীর কিংবদন্তী কিউবার বিপ্লবী নেতা প্রয়াত ফিদেল ক্যাস্ট্রো বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হিমালয়ের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। ক্যাস্ট্রো বলেন, ‘আমি হিমালয়কে দেখেনি, তবে শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসে এই মানুষটি ছিলেন হিমালয় সমান। সুতরাং হিমালয় দেখার অভিজ্ঞতা আমি লাভ করেছি। ১৯৭৩ সালে আলজেরিয়ায় জোট-নিরপেক্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ক্যাস্ট্রোর সাক্ষাত ঘটে। শ্রীলংকার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী লক্ষ্মণ কাদির গামা (নৃশংস হত্যার শিকার) বাংলাদেশের এই মহান নেতা সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়া গত কয়েক শতকে বিশ্বকে অনেক শিক্ষক, দার্শনিক, দক্ষ রাষ্ট্রনায়ক, রাজনৈতিক নেতা ও যোদ্ধা উপহার দিয়েছে। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান সবকিছুকে ছাপিয়ে যান, তাঁর স্থান নির্ধারিত হয়ে আছে সর্বকালের সর্বোচ্চ আসনে।

বঙ্গবন্ধুর জীবন ও বাংলাদেশ একই সূত্রে গাথা। এজন্যই তাকে বাংলাদেশের জাতির পিতা ও স্বাধীনতার স্থপতি বলা হয়। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ঘোষণা করা হয়েছে মুজিববর্ষ। দিবসটি পালনে বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করা হলেও করোনা ভাইরাসজনিত বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে কর্মসূচি পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে। দিন গণনা শেষ হলো। বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকীর দিন আজ ১৭ মার্চ ২০২০ থেকে ২০২১ সালের ২৬ মার্চ পর্যন্ত বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে এ বর্ষ উদযাপন করা হবে। রাত আটটায় বঙ্গবন্ধুর জন্মক্ষণে রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আতশবাজির মধ্যদিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর কর্মসূচির উদ্বোধন করা হবে। রাষ্ট্রপতি তার ভাষণের পরপর আতশবাজির মাধ্যমে জন্মশতবার্ষিকীর কর্মসূচির উদ্বোধন করবেন।

দিবসটি উপলক্ষে বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করা হলেও করোনা ভাইরাসজনিত বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে মুজিববর্ষের কর্মসূচি পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে। মঙ্গলবার রাত ৮টায় বঙ্গবন্ধুর জন্মক্ষণে রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আতশবাজির মধ্যদিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষের কর্মসূচির উদ্বোধন করা হবে। রাষ্ট্রপতি তার ভাষণের পরপর আতশবাজির মাধ্যমে জন্মশতবার্ষিকীর কর্মসূচির উদ্বোধন করবেন।

স্পন্সরেড আর্টিকেলঃ