আজ শুক্রবার, ৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

অভিজিৎ নোবেল পাওয়ায় প্রশ্নবিদ্ধ বিজেপি

অনলাইন রিপোর্ট:

‘আরও এক বাঙালি দেশের মুখ উজ্জ্বল করলেন’— ঝটিতি টুইট মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। রাজ্য সরকারের শুভেচ্ছা বার্তা এবং গোলাপের স্তবকও খুব তাড়াতাড়িই পৌঁছল সদ্য নোবেলজয়ী অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বালিগঞ্জের বাড়িতে, তাঁর মায়ের কাছে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই অভিনন্দন টুইট করলেন সনিয়া গাঁধী, রাহুল গাঁধী। কিন্তু বছরভর সোশ্যাল মিডিয়ায় অত্যন্ত তৎপর নরেন্দ্র মোদীর টুইটার হ্যান্ডলগুলো নিশ্চুপ রইল ঘণ্টাচারেক। ভারতীয়ের নোবেলপ্রাপ্তি নিয়ে বেশ নির্লিপ্ত রইল ভারতের শাসক দলের সোশ্যাল মিডিয়া সেলও।

কারণ কী? অর্থনীতিতে আরও এক ভারতীয়ের নোবেল পাওয়াকে কি খুব বড় বিষয় হিসেবে দেখছে না ভারত সরকার বা ভারতের শাসক দল? নাকি মোদীর নোটবন্দির কঠোর সমালোচক অভিজিতের বিষয়ে ‘অ্যালার্জি’ রয়েছে? প্রশ্ন উঠে গিয়েছে নানা রকম।

দারিদ্র নিয়ে কাজ, দারিদ্র নিয়ে গবেষণা। দারিদ্রের সঙ্গে কী ভাবে যুঝছেন বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষ, অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় তা তুলে ধরেছেন নিজের লেখায় বা গবেষণাপত্রে। তাই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ভারতে নোটবন্দি ঘোষণা করতেই তীব্র সমালোচনা করেছিলেন অভিজিৎ। নোটবন্দি ব্যর্থ হবে— একেবারে শুরুতেই বলে দিয়েছিলেন প্রবাসী ভারতীয় অর্থনীতিবিদ। ভারতীয় অর্থনীতি বড়সড় ক্ষতির সম্মুখীন হবে বলেও পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। বলেছিলেন— ক্ষতির পরিমাপটা আমরা এখনও ঠিক মতো করতে পারিনি, হয়তো তা আমাদের আন্দাজের চেয়ে অনেক বেশি।

কেন এ কথা বলেছিলেন অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়? কারণ দীর্ঘ গবেষণার সুবাদে এবং অভিজ্ঞতার সূত্রে তিনি জানেন, ভারতে শ্রমজীবীদের ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশই অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন এবং ওই ক্ষেত্র প্রায় পুরোটাই নগদ নির্ভর। সুতরাং নোটবন্দির জেরে বাজারে নগদের জোগানে টান পড়লে বিপুল সংখ্যক অসংগঠিত শ্রমিকের রুটি-রুজিতে টান পড়বে।

‘‘সংগঠিত ক্ষেত্রের উপরে দাঁড়িয়ে আমরা অসংগঠিত ক্ষেত্রের আন্দাজ পাই। ফলে আমাদের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (জিডিপি) অনেক সময়ে পুরো ক্ষতির আন্দাজটা দিতে পারে না।’’ নোটবন্দির পরে এক সাক্ষাৎকারে এ কথাই বলেছিলেন অভিজিৎ। নোটবন্দির জেরে যে ক্ষতি চোখে দেখা যাচ্ছে, বাস্তবে ক্ষতির পরিমাণ তার চেয়ে অনেক বেশি— বলেছিলেন অভিজিৎ।

তা হলে সোমবার অর্থনীতির নোবেল পুরস্কার ঘোষিত হওয়ার পরে বিজেপি নেতৃত্বের ঠিক কী মনে হতে পারে? মনে হতে পারে— একা রামে রক্ষে নেই, সুগ্রীব দোসর! বলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এ রকম মনে হওয়ার কারণ কী? কারণ, ভারত থেকে এর আগে অর্থনীতিতে নোবেল পেয়েছেন যিনি, সেই অমর্ত্য সেন হলেন বিজেপি তথা মোদী সরকারের আর্থিক নীতির ঘোর সমালোচক। অমর্ত্য ঘোর সমালোচক বিজেপি তথা মোদীর রাজনীতিরও। এ হেন অমর্ত্যের পরে আবার এক ভারতীয় অর্থনীতিবিদ নোবেল পেলেন এবং তিনিও বিজেপি বা মোদী প্রসঙ্গে অমর্ত্য সেনের সুরেই কথা বলেন। হজম করা একটু কঠিন হতেই পারে।
নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেন বরাবরই বাম ঘেঁষা। তবে মোদী জমানা শুরু হওয়ার আগে ভারত সরকারের বিরুদ্ধে খুব শানিত সমালোচনার সুর অমর্ত্যর গলায় সে ভাবে শোনা যায়নি। তাঁকে সরব হতে দেখা গিয়েছে মোদী জমানা শুরু হওয়ার পর থেকেই। আর্থিক নীতি নিয়ে বা বৃদ্ধির হার কমে যাওয়া নিয়ে তিনি মোদী সরকারকে আক্রমণ তো করেছেনই। বিজেপির রাজনীতি বা মতাদর্শ নিয়েও অমর্ত্য আক্রমণ শানিয়েছেন বার বার। অসহিষ্ণুতার অভিযোগ তুলেছেন। সম্প্রতি বলেছেন যে, ভারতকে বোঝার মতো প্রসারতাই নেই মোদীর।

অমর্ত্য সেন যে আক্রমণ করে পার পেয়ে গিয়েছেন, তা কিন্তু নয়। পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি থেকে শুরু করে দলের সর্বভারতীয় নেতৃত্ব— অমর্ত্য সেনের তীব্র সমালোচনায় সরব হয়েছেন দেশের শাসক দলের নেতারা। অমর্ত্য সেন ভারত সম্পর্কে কতটুকু জানেন, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। অমর্ত্য সেন আগে ভারতে এসে থাকুন, তার পরে ভারত সম্পর্কে তার মন্তব্য শুনব— রাজ্য বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষ এ রকমও বলেছেন।
বিশ্ববরেণ্য অর্থনীতিবিদকে যে ভাষায় আক্রমণ করা হয়েছে, তা অনেক সময় সৌজন্যের সীমাও ছাড়িয়ে গিয়েছে। কিন্তু বিজেপির এই কৌশল কিছুটা হলেও কাজ দিয়েছে দলকে। অসৌজন্য নিয়ে বিতর্ক হয়েছে ঠিকই। কিন্তু অমর্ত্য সেনের কাজকে কখনও গভীর ভাবে জানার সুযোগ পাননি ভারতের যে অসংখ্য নাগরিক, তাঁদের অনেকের কাছেই অমর্ত্য সেনকে কিয়ৎ হেয় করাও গিয়েছে।

অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়কেও কি হেয় করার নীতিই বিজেপি তথা কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ে নিল? মোদীর তরফ থেকে অভিনন্দন বার্তা আসায় যত দেরি হয়েছে, ততই বড় হতে থেকেছে এ দিন এই প্রশ্নচিহ্ন। অভিজিৎ যে মোদীর আর্থিক নীতিকে পছন্দ করেন না, তা বিজেপির অজানা নয়। এ বারের লোকসভা নির্বাচনের ইস্তাহার প্রকাশ করতে গিয়ে রাহুল গাঁধী যে ‘ন্যায়’ প্রকল্প ঘোষণা করেছিলেন, সেই প্রকল্প বা সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির রূপরেখা অনেকটাই তৈরি অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে। সে কথাও বিজেপির অজানা নয়। এ দিন অভিনন্দন বার্তা টুইট করতে গিয়ে রাহুল গাঁধী নিজেও সে কথা নতুন করে মনে করিয়ে দিয়েছেন। সেই অভিজিৎ-ই নোবেল পেলেন। এর পর থেকে অভিজিতের মুখ থেকে আসা সমালোচনার গুরুত্ব আরও বেড়ে যাবে। অমর্ত্যের পরে অভিজিতকেও নতুন করে নিশানা করতে হবে। আর নিশানাই যখন করতে হবে, তখন আর অভিনন্দন জানিয়ে কী হবে? এমন প্রশ্নই কি ঘোরাফেরা করছিল গেরুয়া শিবিরে?

সোমবার সন্ধ্যা ৭টা ১৪ মিনিটে টুইটারে অভিনন্দন বার্তা দেন নরেন্দ্র মোদী। ৭টা ২৭ মিনিটে অভিনন্দন টুইট রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ। নরেন্দ্র মোদী না হয় হরিয়ানায় নির্বাচনী প্রচারে ব্যাস্ত ছিলেন। কোবিন্দের তো আর সেই ব্যস্ততা ছিল না। তা হলে টুইটটা করতে অত দেরি হল কেন? প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। অনেকে আবার রাহুল গাধীর উদাহরণ টেনেছেন। রাহুলও তো প্রচারে ব্যস্ত ছিলেন, কিন্তু তার ফাঁকেই তো অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়কে শুভেচ্ছাও জানিয়ে দিয়েছিলেন, মোদী কেন পারলেন না? উঠেছে এই রকম প্রশ্নও।

গেরুয়া শিবির পাল্টা বলছে, উপরাষ্ট্রপতি বেঙ্কাইয়া নায়ডু অনেক আগেই টুইটারে অভিনন্দন জানিয়েছেন অভিজিৎকে। পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষ বা বাংলার আর এক গুরুত্বপূর্ণ বিজেপি নেতা মুকুল রায়ও অভিজিতের নোবেল পাওয়ার খবর পেয়েই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন। সুতরাং অযথা সমালোচনা কাম্য নয়, বলছে বিজেপি।

কিন্তু দেশের প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির অভিনন্দন বার্তা সামনে আসতে কেন ঘণ্টাচারেক সময় লেগে গেল, সে প্রশ্ন জোর দিয়ে তুলে ধরার পথ থেকে সরতে চাইছে না বিজেপি বিরোধী শিবির। বিজেপি খুব দ্বিধায় ছিল অভিজিৎকে নিয়ে মত রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশেরও। তাঁরা বলছেন, রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী চুপ থাকবেন, শুধু উপরাষ্ট্রপতিকে দিয়ে একটা ছোট্ট টুইট করিয়ে নিয়ম রক্ষা করা হবে— প্রথমে সম্ভবত এই নীতিই নিয়েছিল বিজেপি। শুধু বাংলার আবেগের কথা মাথায় রেখে রাজ্য বিজেপির নেতাদের উচ্ছ্বাস দেখাতে বলা হয়েছিল বলে তাঁদের মত। কিন্তু পরে সিদ্ধান্ত বদল হয়েছে এবং কর্তব্য পালনে অবিচল থাকার বার্তা দিতে চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী— মনে করছেন বিশ্লেষকদের ওই অংশ।

ভারত সরকারের কাছ থেকে অভিনন্দন বার্তা পেয়ে ধন্যবাদও জানিয়েছেন অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে এর পরেও যে অভিজিৎ মুখ খুলতে পারেন এবং তেমনটা ঘটলে যে বিজেপি-ও তাঁর বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে পারে, সে বিষয়ে বিশ্লেষকদের কোনও সংশয় নেই।

স্পন্সরেড আর্টিকেলঃ