আজ বৃহস্পতিবার, ১৫ই কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৩১শে অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

শহরে পানি নিষ্কাশনে ধীরগতি

স্টাফ রিপোর্টার :

ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে সোমবার দিনভর প্রবল বৃষ্টিপাতের কারণে নারায়ণগঞ্জ শহরে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। এতে তলিয়ে যায় শহর ও শহরতলির বিভিন্ন এলাকার রাস্তাঘাটসহ ঘরবাড়ি। তবে মঙ্গলবার সকাল থেকে বৃষ্টি না হলেও ছিল জলাবদ্ধতা। দুর্বল ড্রেনেজ ব্যবস্থার কারণে যথা সময়ে পানি নিষ্কাশন না হওয়ায় সারাদিনই পানির নিচে ছিল রাস্তাঘাট। শহরের প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ বঙ্গবন্ধু সড়কটিও ছিল হাঁটু সমান পানির নিচে। ফলে দিনভর নানা ভোগান্তির পোহাতে হয়েছে নগরবাসীদের।
বৃষ্টি না থাকা সত্ত্বেও শহরের এই জলাবদ্ধার জন্য অপরিকল্পিত ও দুর্বল ড্রেনেজ ব্যবস্থাকে দুষছেন নগরবাসী। ফতুল্লা ইউনিয়নে দুর্ভোগ বেশি ও কাজ কম হয়েছে বলেও অভিযোগ অনেকের। এসব অভিযোগ স্বীকার করলেও কোনো আশার বাণী শোনা যায়নি জনপ্রতিনিধিদের কাছে। বিগত বছরগুলোতে ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নয়নে প্রকল্পের কথা জানালেও তা এখনো শুরু করতে পারেনি নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন (নাসিক)।
বিকেলে সরেজমিনে শহরের বঙ্গবন্ধু সড়ক, গলাচিপা, কলেজরোড, আমলাপাড়া, উকিলপাড়া, দেওভোগ, দেওভোগ আখড়া, মাসদাইর ঘুরে দেখা যায়, বেলা পরলেও এখনো পানি জমে আছে এলাকাগুলোতে। তলিয়ে আছে রাস্তাঘাট, বাড়িঘর, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও। হাটু সমান পানি দিয়ে চলাচল করছেন নগরবাসী। পর্যাপ্ত যানবাহন থাকলেও পানির কারণে চলাচল করতে অসম্মতি জানাচ্ছিলেন অনেক চালকরা। বিশেষ করে মটর চালিত ইজিবাইক ও অটোরিকশা। অন্যান্য কম থাকায় চাহিদা বেড়ে যায় পেডেল চালিত রিকশার। এ সুযোগে অতিরিক্ত ভারা আদায় করতে দেখা যায় অনেক চালকদের। ফলে বিপাকে পড়েন নগরবাসী।
শহরের মন্ডলপাড়া ব্রিজ থেকে চাষাড়া যাওয়ার জন্য রিকশা করার চেষ্টা করছিলেন গৃহিণী সুমাইয়া ফেরদৌসি। আশেপাশে পর্যাপ্ত যানবাহন থাকা সত্ত্বেও যাওয়ার জন্য রাজি হচ্ছিল না চালকরা। সুমাইয়া বলেন, অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছি কিন্তু রিকশা করতে পারছি না। কোনো মিশুক রাজি হচ্ছে না আর যেসব রিকশা যাওয়ার জন্য রাজি হচ্ছে তারা দ্বিগুণ ভাড়া চাচ্ছে। চাষাড়া নাকি অনেক পানি।
প্রায় একই কথা বলেন আরও বেশ কয়েকজন নগরবাসী। কথা হয় আব্দুল রউফ নামে একজন ইজিবাইক চালকের সঙ্গে। আব্দুল রউফ বলেন, দুই দিন ধইরা শহরে হাটু পানি। এত পানিতে গাড়ি চালাইলে গাড়ির ইঞ্জিন নষ্ট হইয়া যায়। তাই ওই দিকে যাই না।
অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক রিকশা চালক বলেন, পানির মইধ্যে রিকশা চালাইতে অনেক কষ্ট। গাড়ি আগাইতে চায় না। কষ্ট বেশি হয় একারণে ভাড়া একটু বেশি চাই।
ভারী বর্ষণে পানি উঠেছে শহরের অক্টো অফিস এলাকার বাসিন্দা কল্পনা রানীর বাড়িতে। উঠে ভিজে গেছে ঘরের আসবানপত্র, তলিয়ে বন্ধ হয়ে গেছে পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থাও। কল্পনা রানী বলেন, টানা বৃষ্টিতে ঘরে হাটু সমান পানি। সকাল থেকে কয়েক দফায় ঘর সেচে পানি ফেলেছি। তবু মাটি চুয়ে আবার পানি উঠে আসছে। বাচ্চা নিয়ে খুবই বিপাকে আছি, বাথরুমেও যেতে পারছি না।
শহরের জলাবদ্ধতার বিষয়ে নাসিক ১৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাকসুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ বলেন, অতিরিক্ত বর্ষণের কারণেই জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। শহরের প্রত্যেকটি ড্রেন পরিষ্কার এবং ড্রেনগুলো দিয়ে পানি নিষ্কাশন হচ্ছে কিন্তু পানি অনেক বেশি হওয়ায় সমস্যা হচ্ছে। সময়ের সঙ্গে পানি সরে যাবে।
শহরের ড্রেনেজ ব্যবস্থার দুর্বলতার কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, আমাদেরও ব্যর্থতা আছে। কিন্তু অতিরিক্ত বর্ষণে আমাদের কিছু করার নেই।
শহরের মতোই করুণ দশা শহরের বাইরে ফতুল্লা ও সিদ্ধিরগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায়। ফতুল্লার কাশীপুর, দেওভোগ মাদ্রাসা, পশ্চিম দেওভোগ, ইসদাইর, তল্লা, সবুজবাগ, গাবতলী, লালপুর, পৌষার পুকুরপাড় এবং সিদ্ধিরগঞ্জের কদমতলী, পাইনদি, মিজমিজিসহ অন্যান্য এলাকায় পানিবন্দি অবস্থায় মানুষজন। বিশেষ করে ফতুল্লা ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায়। এসব এলাকায় হাটু থেকে কোমড় পর্যন্ত পানিও দেখা যায়।
কাশিপুর ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ড এলাকার বাসিন্দা সানি হোসাইন বলেন, নূর মসজিদ সংলগ্ন এলাকার মূল সড়ক পানির নিচে চলে গেছে। আমরা চলাচল করছে পারছি না, দোকানিরা দোকান খুলছে না, কারো ব্যবসা হচ্ছে না। প্রয়োজনের তাগিদে হাঁটু সমান পানিতে পার করে বিভিন্ন জায়গায় যেতে হচ্ছে।
ফতুল্লার সবুজবাগ এলাকার বাসিন্দা সেলিম মিয়া বলেন, এলাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থার বেহাল দশা। এ অব্যবস্থাপনার কারণে আজ মানুষের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। অধিকাংশ এলাকায় ড্রেন নেই, যেসব এলাকায় আসে সেগুলো অনেক সরু। আমি কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, সঠিক ও যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে দ্রুত এলাকাবাসী ভোগান্তি নিরসন করুন।
ফতুল্লা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ফাইজুল ইসলাম বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ইউনিয়নে পানির সমস্যা রয়েছে। আজ আমি ইউনিয়নের ৩ ও ৪ নম্বর ওয়ার্ডসহ আশেপাশের এলাকাগুলো সরেজমিনে পরিদর্শন করেছি। একাধিক ওয়ার্ডের ড্রেনেজ ব্যবস্থা অনেকটা দুর্বল। এ বিষয়ে আমি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সেনা বাহিনীর কর্মকর্তাদের সাথে কথা হয়েছে। আমরা এ বিষয়ে কাজ করেছি।
তিনি আরও বলেন, কিছুদিন আগে আমাদের সংসদ সদস্য, ইউএনও স্যারের সঙ্গে মির্টি করে আমরা ইউনিয়নের খাল ও ড্রেনগুলো পরিষ্কার করে দিয়েছিল। কিন্তু তারপরও জলাবদ্ধতা রয়েছে। আমি এক মাস আগেই নির্বাচিত হয়েছিল। বর্ষাকাল চলে এসেছে তাই এ সমস্যা সমাধানে আমি উল্লেখযোগ্য কোনো সমাধান দিতে পারবো না। তবে এ বছর আমি সরেজমিনে সমীক্ষা করবো। কোন কোন এলাকা জলাবদ্ধতা কেমন। সে অনুযায়ী আগামী শীতে কাজ করবো।
রেল চলাচলেও জলাবদ্ধতার প্রভাব দেখা গেছে। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটের একাধিক স্পটে রেললাইনে পানি জমে থাকতে দেখা যায়। তবে রেললাইন পানির নিচে থাকলেও ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক ছিলো বলে জানান, নারায়ণগঞ্জ কেন্দ্রীয় স্টেশনের স্টেশন মাস্টার কারুমল ইসলাম।
কারুমল ইসলাম দৈনিক সংবাদচর্চাকে বলেন, বিভিন্ন স্থানে রেললাইনে পানি উঠেছে তবে তা অতিরিক্ত নয়। তাই সকাল থেকেই ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক ছিল।
সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, নারায়ণগঞ্জ শহরের ড্রেনেজ ব্যবস্থা একমুখী। অর্থাৎ সারা শহরের পানি একটি লাইন হয়ে শীতলক্ষ্যা নদীতে মিলিত হয়। তাই একটু বেশি বৃষ্টি হলেই অতিরিক্ত পানি প্রবাহিত হতে না পেরে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। তবে এ সমস্যা সমাধানে জাইকার অর্থায়নে ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে সিটি করপোরেশন।
এ বিষয়ে কাউন্সিলর মাকসুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ বলেন, এ প্রকল্পের আওতায় নদীমুখী আরও দুটি প্রবাহ লাইন তৈরী করা হবে। প্রকল্প শেষ হলে শহরের জলাবদ্ধতা আর থাকবে না। ঈদুল আযহার পর প্রকল্পটির ওয়ার্ক অর্ডার দেয়া হবে।
এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জাকির হোসেনের মুঠফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।