মোঃ মুন্না খান , নির্বাহী সম্পাদক: মাদক দ্রব্য হলো একটি ভেষজ দ্রব্য যা গ্রহণে মানুষের স্বাভাবিক শারীরিক ও মানসিক অবস্থার উপর প্রভাব পড়ে এবং যা আসক্তি সৃষ্টি করে। মাদক দ্রব্যে বেদনানাশক কর্মের সাথে যুক্ত থাকে তন্দ্রাচ্ছন্নতা, মেজাজ পরিবর্তন, মানসিক, আচ্ছন্নতা রক্তচাপ পরিবর্তন ইত্যাদি । মাদক দ্রব্য গ্রহণ করলে মানুষের শারীরিক ও মানসিক অবস্থার উল্লেখযোগ্য নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটে এবং দ্রব্যের উপর নির্ভরশীলতা সৃষ্টির পাশাপাশি দ্রব্যটি গ্রহণের পরিমাণ ক্রমশ বাড়তে থাকে ব্যক্তির এই অবস্থাকে বলে মাদকাসক্তি এবং যে গ্রহণ করে তাকে বলে মাদকাসক্ত।
মাদক দ্রব্য আসলে কি কি সেটার নির্দিষ্ট সংখ্যা বা নাম বলা সম্ভব নয়। মানুষ নেশার জন্য যা ব্যবহার করে তাই মাদক দ্রব্য। সেটি হতে পারে ইনজেকশন , ধূমপান বা যে কোন মাধ্যম।
বিভিন্ন ধরণের মাদক দ্রব্যের মধ্যে রয়েছে হিরোইন , কোকেন , ইয়াবা, আফিম , মারিজুয়ানা , গাজা ফেনসিডিল , বিয়ার , কেটামিন , স্পিড , বিভিন্ন রকমের ঘুমের ওষুধ থেকে শুরু করে জুতা লাগানোর আঠা পর্যন্ত।
নিওরো কেমিক্যাল পরীক্ষায় দেখা গেছে ,মাদক সেবনের পরপরই ব্যক্তির মস্তিষ্কের কিছু কিছু জায়গায় অতি দ্রুত এবং বেশি পরিমাণে ডোপামিন নামক নিওরোট্রান্সমিটার বৃদ্ধি পায়,যা একজন ব্যাক্তিকে মাদকের আনন্দ দেয়। এবং পরবর্তী কালে ব্যবহারে উৎসাহিত করে। কিন্তু যারা দীর্ঘদিন ধরে মাদকে আসক্ত তাদের বেলায় আবার উল্টোটা দেখা যায়। অর্থাৎ দীর্ঘদিন মাদক নেয়ার ফলে যে ডোপামিন একজন মানুষকে নেশার আনন্দ দিত তা আস্তে আস্তে কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে।
প্রকৃতপক্ষে দেখা যাচ্ছে, মাদকাসক্ত ব্যক্তি আসলে একটা সময়ে আর আনন্দের জন্য নেশা নিচ্ছে না। এটা তার অভ্যাসে পরিণত হয় এবং এটা থেকে একসময় বের হয়ে আসা অসম্ভব হয়ে পড়ে। প্রথম পর্যায়ে মাদক মানুষকে এমন একটি আনন্দ দেয় যার কাছে মজাদার জিনিসগুলো যেমন খাদ্য , পানীয় এবং যৌন মিলনের আনন্দের মত আনন্দের জিনিসগুলো ম্লান হয়ে পড়ে। কারণ এই ছোট ছোট আনন্দগুলো মানুষ একই নিওরোট্রান্সমিটার অর্থাৎ ডোপামিন এর মাধ্যমে পেয়ে থাকে। মাদকের আনন্দের সাথে পাল্লা দিয়ে এই আনন্দগুলো কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে এবং মাদকই হয়ে পড়ে মাদকাসক্ত ব্যক্তির একমাত্র চিন্তা চেতনা।
দীর্ঘদিন মাদক ব্যবহারকারীদের ডোপামিন এর কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে মস্তিষ্কের যে সমস্ত জায়গা ডোপামিন এর মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে তথ্য আদান প্রদান করে থাকে সেই জায়গাগুলো অকার্যকর হয়ে পড়ে। ফলে একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।
মাদক গ্রহণের পরিমাণের ভিন্নতার কারণে দেহে ও মস্তিষ্কে এর প্রভাব ভিন্ন হয়। খুব অল্প পরিমাণে মাদক উদ্দীপক বস্তু হিসেবে কাজ করে। বেশি পরিমাণে মাদক গ্রহণ করা হলে তা যন্ত্রণাদায়ক হিসেবে কাজ করে। বেশি পরিমাণে গ্রহণ করা হলে শরীরে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে যার পরিণতি হয় মৃত্যু ।
কিছু কিছু মাদক দ্রব্য সরাসরি মনকে আক্রমণ করে।এতে করে মাদক গ্রহণকারী তার চারপাশে কি ঘটছে তার উপলব্ধি হারিয়ে ফেলে। মাদক একজন ব্যাক্তির সকল ইন্দ্রীয় চেতনাকে সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেয়। যার ফলে ব্যক্তি স্বাভাবিকভাবে চিন্তা করতে পারেনা। তার চিন্তাধারা নেতিবাচক হয়ে পড়ে ।
# মাদকাসক্তির বড় কারণ হলো মাদকের সহজলভ্যতা।
# বন্ধুদের চাপে পড়ে অনেকে মাদক নিয়ে থাকে।
# বাবা-মায়ের আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গির কারণে অনেকে মাদক গ্রহণ করে থাকে।
# অনেকের মাঝে মাদক নিয়ে স্মার্ট হওয়ার প্রবণতা থাকে যা তাকে ঠেলে দেয় মাদকের জগতে।
# মানসিক সমস্যা যেমন: হতাশা, একাকীত্ববোধ, বিষণ্ণতার কারণে এসব থেকে রেহাই পেতে মাদককে বেছে নেয় ।
# এন্টি সোশ্যাল পারসোনালাটি, শৈশবে বিকাশে সমস্যা থাকলেও অনেকে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে ।
# ভালোবাসার সম্পর্ক ভেঙ্গে যাওয়ায় মানসিক কষ্ট থেকে মুক্তি পেতে মাদক গ্রহণ করে
# পারিবারিক কারণেও আপনার সন্তান মাদকে জড়িয়ে পড়ে।
মাদক গ্রহণের ফলে একজন ব্যক্তির মাঝে বিরাট শারীরিক ও আচরণগত পরিবর্তন হয়। সেই পরিবর্তনগুলো একটু ভালোভাবে লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারবেন আপনার পরিবার মাদক নিচ্ছে কি না।
(১) খাওয়ার প্রবণতা এবং ঘুমের সময়সীমার পরিবর্তন চলে আসলে। ওজন হঠাৎ করে বেড়ে গেলে বা কমে গেলে।
(২) চোখ লাল হয়ে থাকলে এবং চোখের মণি স্বাভাবিকের চেয়ে বড় বা ছোট দেখালে ।
(৩) নাক দিয়ে প্রায়ই রক্ত পড়লে। সাধারণত কোকেইন বা নিঃশ্বাসের সাথে গ্রহণ করতে হয় এমন মাদকের বেলায় এই লক্ষণ দেখা যায়।
(৪) চেহারা এবং পোশাকের পরিধান ও যত্নে অবনতি দেখা দিলে।
(৫) শরীরে এমন কোন ক্ষত বা কাটা ছেড়া দেখা গেলে যা সম্পর্কে তারা জানে না বা কীভাবে আঘাত পেলো তা আপনাকে বলতে না চাইলে।
(৬) তাদের মুখে বা শরীরে বা পোষাকে অদ্ভুত বা অপরিচিত কোন গন্ধ পেলে।
(৭) মাদকাসক্ত ব্যাক্তির চেহারায় কালো ছোপ ছোপ দাগ তৈরি হয় ।
৮) যৌন ক্রিয়ায় অনীহা বা ক্ষমতা হ্রাস পেলে।
(৯) ক্লাস বা অফিসে ঘনঘন যেতে না চাওয়া বা প্রতিষ্ঠানে কোন ঝামেলায় জড়িয়ে পড়া
(১০) কাজে অমনযোগী হলে, ব্যাক্তিগত শখ বা খেলাধুলায় আগ্রহ হারিয়ে ফেললে ।
(১১) তার সহকর্মী, শিক্ষক বা বন্ধুদের কাছ থেকে ঘনঘন নালিশ আসতে থাকলে ।
(১২) বাসায় রাখা টাকার হিসাব না মিললে। কারণ নেশার দ্রব্য কিনতে টাকা লাগে। তাই সাধারণত নেশার দ্রব্যের মুল্য পরিশোধের জন্য আপনার সন্তান টাকা , মুল্যবান সামগ্রী, অলংকার চুরি করতে পারে ।
(১৩) পড়াশোনার নাম করে ঘনঘন টাকা চাওয়ার প্রবণতা বেড়ে গেলে ।
(১৪) পরিবাররে সদ্যসদের সাথে ব্যবহারের পরিবর্তন আসলে। সাধারণত মাদকাসক্তির সময়গুলোতে তারা খিটখিটে মেজাজের হয়ে থাকে ।
(১৫)বেশিরভাগ সময়ই একা থাকলে বা প্রাইভেসি সচেতন হয়ে পড়লে। বেশির ভাগ সময়ই রুমের দরজা বন্ধ রাখলে ।
(১৬)অকারণে বিরক্তিবোধ করলে ।
(১৭) অতিরিক্ত মিষ্টি খেতে আরম্ভ করলে ।
(১৮) পুরনো বন্ধুদের পরিবর্তে নতুন নতুন বন্ধু চোখে পড়লে ।
(১৯) ঘরে বা বিছানায় পাউডার জাতীয় জিনিস পাওয়া ।
(২০) প্রায়ই কারো না কারো সাথে মারামারি বা ঝগড়া ইত্যাদিতে জড়িয়ে পড়া।
(২১) সব সময় রুমে এবং শরীরে পারফিউম বা এয়ারফ্রেশনার ব্যবহার করা ।
(২২) চোখের লাল ভাব কাটানোর জন্য ড্রপ ব্যবহার শুরু করলে ।
(২৩) অকারণে রেগে গেলে ।
আপনার পরিবারের কারো মাঝে এধরনের শারীরিক ও আচরণগত পরিবর্তনের কয়েকটি লক্ষণ একসাথে থাকলে বুঝে নিবেন নিঃসন্দেহে সে একজন মাদকাসক্ত।
এছাড়া ক্লিনিক্যালি কিছু পরীক্ষা নিরিক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যায় সে মাদকাসক্ত কি না।মাদকাসক্ত নির্ণয়ের জন্য সাধারণত রক্ত পরীক্ষা, মূত্র পরিক্ষা এবং মাদকাসক্ত ব্যাক্তির চুল ও মুখের লালা পরীক্ষা করা হয় ।
মাদক প্রতিরোধে পরিবার ও সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রয়েছে । পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতা শিক্ষা, পরিমিত জীবন যাপন ,বন্ধু নির্বাচন, দায়িত্বশীলতা ইত্যাদি মাদকাসক্তি প্রতিরোধ ও প্রতিকারের পথ।
সন্তান তার পরিবারের পরিবেশ দ্বারা অনেক প্রভাবিত হয়। তাই পারিবারিক পরিবেশ হতে হবে ধূমপান মুক্ত। সন্তানদের কার্যকলাপ ও সঙ্গীদের ব্যাপারে খবর রাখতে হবে। সন্তানরা যেসব জায়গায় যাওয়া আসা করে সে জায়গাগুলো সম্পর্কে জানতে হবে। সন্তানদের সাথে খোলামেলা ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। যাতে তারাই নিজ থেকে তাদের বন্ধুবান্ধব ও কার্যাবলী সম্পরকে আলোচনা করে । ধৈর্য ধরে তাদের সব কথা শুনতে হবে ।পরিবারের সকল সদ্যসদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। সন্তানদের মাঝে নিরাপত্তা বোধ তৈরি করতে হবে। পিতামাতার গুড প্যারেন্টিং বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতে হবে।
মাদকাসক্ত হয়ে গেলে পরিবাররে প্রতিটি সদ্যসকে মাদকাসক্ত ব্যাক্তিকে সেই অবস্থা থেকে বের করে আনার সর্বাত্মক প্রয়াস চালাতে হবে।প্রয়োজনে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে এবং সঠিক চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে।
সন্তান মাদকাসক্ত থেকে সুস্থ্য হয়ে ফিরে আসলে পুনরায় যেন মাদকে জড়িয়ে না পড়ে পিতামাতাকে সর্বদা সচেতন থাকতে হবে।
সন্তানদের জন্য নির্মল পরিবেশ তৈরি করতে হবে ।চিকিৎসকদের সকল পরামর্শ অনুযায়ী সন্তানকে লালন পালন করতে হবে।
প্রত্যেক পিতামতাই চায় তাঁর সন্তানের সুস্থ্য ও সুন্দর জীবন ।সেজন্য পিতামাতাকে বুঝে নিতে তাঁর সন্তানের জন্য কোনটি সঠিক, কোনটি ভুল ।