আজ শুক্রবার, ১২ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৭শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

অবৈধ উপায়ে চলছে হাসেম ফুড

স্টাফ রিপোর্টার :
নারী-শিশুসহ একে একে ৫৪ জন শ্রমিকের প্রাণহানীর পরও লাইসেন্স ছাড়াই পরিচালিত হচ্ছে রূপগঞ্জের হাসেম ফুড কারখানা। পর্যাপ্ত সেফটি ব্যবস্থা নিশ্চিত না করে প্রশাসনিক অনুমোদন ছাড়া পুরোদস্তর চলছে পন্য সামগ্রী উৎপাদন কার্যক্রম। তা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিলেও আইন প্রয়োগকারী সংশ্লিষ্ট দপ্তরের দায়িত্বশীলরা আছেন নীরব ভূমিকায়। এতে প্রশ্ন উঠেছে সচেতন মহলে।
এদিকে, নারায়ণগঞ্জ কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (স্বাস্থ্য) আসাদুজ্জামান রনি দৈনিক সংবাদচর্চাকে বলেছেন, ‘প্রতিষ্ঠানটি পূনরায় চালু করার পর লাইসেন্সের আবেদন করা হলেও উপযুক্ত না হওয়ায় তা বন্ধের জন্য নোটিশ দেয়া হয়েছে।’
অন্যদিকে হাসেম ফুড কারখানার প্রশাসনিক কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন (অবঃ) মামুন দৈনিক সংবাদচর্চাকে জানিয়েছেন, ‘তারা লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেছেন এবং কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর থেকে কোনো ধরনের নোটিশও দেয়া হয়নি তাদের! এতে দুই প্রতিষ্ঠানের ওই দুই কর্মকর্তার কথায় অমিল পাওয়া গেছে মোটা দাগে।
সূত্র বলছে, দুর্ঘটনার আগেও প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা না নিয়ে এমন নোটিশ চালাচালির কথা বলেই দায় সেরেছিল কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের তৎকালিন কর্মকর্তা সৌমেন বড়ুয়া। শেষ পর্যন্ত অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারালো ৫৪ জন শ্রমিক। এবারও কী সেই নোটিশ চালাচালিতে সীমাবদ্ধ থেকে আরও একটি ট্র্যাজেডির অপেক্ষায় থাকবেন বর্তমান কর্মকর্তারা? এমন প্রশ্নই উঠছে সচেতন মহলে।
এদিকে, ফায়ার সার্ভিসের (নারায়ণগঞ্জ জোন-২) উপ-সহকারী পরিচালক আলমগীর হোসেন দৈনিক সংবাদচর্চাকে বলেছেন, ‘নতুন ভবন করে কারখানা পরিচালনা করে গেলেও সেখানেও শতভাগ ফায়ার সেফটি ব্যবস্থা নিশ্চিত করেননি মালিক পক্ষ। কারখানাটি পরিদর্শনের পর হেড অফিসে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। তা পর্যালোচনা করে সনদপত্র দেয়া না দেয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারা।’
তবে, ৫৪ জন শ্রমিক নিহত হওয়ার পরও সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর সনদপত্র ছাড়া কিভাবে পরিচালিত হচ্ছে রূপগঞ্জের হাসেম ফুড কারখানা? সেই প্রশ্নই এখন ভারি হচ্ছে।
জানা গেছে, অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া ভবনটি সিলগালা এবং পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকলেও একই জায়গায় নতুন করে ভবন সম্প্রসারণের মাধ্যমে উৎপাদন অব্যাহত রাখা হয়েছে। আইন অনুযায়ী, ভবন সম্প্রসারণ বা স্থানান্তরের ক্ষেত্রেও কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন কার্যালয় থেকে অনুমোদন নিতে হবে। তবে কোনো অনুমোদ বা ছাড়পত্রের কিছুই তোয়াক্কা করছেন না হাসেম ফুড কর্তৃপক্ষ।

জানা গেছে, ২০২১ সালের ৯ জুলাই রূপগঞ্জের কর্ণগোপ এলাকায় অবস্থিত সজিব গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান হাসেম ফুড কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে নারী ও শিশুসহ ৫৪ জন শ্রমিকের কয়লা সাদৃশ্য মরদেহ উদ্ধার করা হয়। বিভীষিকাময় এই ট্র্যাজেডিতে শোকে নিস্তব্ধ হয়ে উঠে গোটা দেশবাসী। ওই ঘটনার পর প্রায় ৩ মাস যাবত কারখানার উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ ছিলো। তবে দূর্ঘটনা পরবর্তী তদন্ত কমিটির তদন্ত কার্যক্রম শেষ না হতেই সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কাউকে না জানিয়ে পন্য উৎপাদন করা শুরু করে প্রতিষ্ঠানটির মালিক পক্ষ।
মর্মান্তিক এই ঘটনায় রূপগঞ্জ থানার তৎকালিন পুলিশ কর্মকর্তা নাজিম উদ্দিন আহাম্মেদ বাদী হয়ে প্রতিষ্ঠানের মালিক আবুল হাসেম ও তার চারপুত্র সহ মোট ৮ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন। এই মামলাটি তদন্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে সিআইডি। কলকারখানা অধিদপ্তরের আইন না মেনে পরিচালিত হওয়া, বিল্ডিং কোড বাস্তবায়ন না করা, পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা ও ফায়ার সেফটি নিশ্চিত না করার পরও হাসেম ফুডের মালিক আবুল হাসেম, তার চার পুত্র হাসান বিন হাসেম, তারেক ইব্রাহিম, তাওশীফ ইব্রাহিম ও তানজিম ইব্রাহিমকে সিআইডির অভিযোগপত্র থেকে বাদ দেয়া হয়।
অন্যদিকে, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন কার্যালয় নারায়ণগঞ্জ এর তৎকালিন উপমহাপরিদর্শক সৌমেন বড়ুয়ার দায়িত্বে গাফলতির প্রমাণ মিললেও তাকে অভিযুক্ত না করে মামলায় স্বাক্ষী করা হয়েছে! পাশাপাশি ইন্সপেকশন অফিসার নেছার উদ্দিন আহমেদ দূর্ঘটনার আগেই সেখানে নোটিশ পাঠানো এবং পরবর্তীতে শ্রম অধিদপ্তরে মোট ৫০টি মামলার বাদি হলেও তাকে পুলিশের দায়েরকৃত ওই মামলায় আসামী করে এজাহার দাখিল করা হয়েছে। ফলে মামলা এবং তদন্ত সংস্থা সিআইডির দেয়া অভিযোগপত্র নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠে সচেতন মহলে। ব্যপক ক্ষোভ প্রকাশ করেন নিহতের স্বজনরাও। অভিযোগপত্র থেকে প্রকৃত দোষিদের আড়াল করা হয়েছে বলে অভিযোগ তোলেন তারা।
তবে ৫৪ জন শ্রমিকের প্রাণ হারানো, মামলা ও চার্জশীট নিয়ে সমালোচনার পরও আইন বা নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে পূনরায় প্রতিষ্ঠানটি চালিয়ে যাচ্ছে কারখানা কর্তৃপক্ষ। অগ্নি দূর্ঘটনা পরবর্তী কারখানাটি স্থায়ী ভাবে বন্ধের বিষয়ে কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। কারখানা অভ্যন্তরে নতুন নির্মিত ভবনগুলোতে কার্য পরিচালনার জন্য স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নিকট থেকে অনুমতি নেয়া হয়নি। নতুন ভবনগুলো নির্মাণে মানা হয়নি বিল্ডিং কোডও।
সরেজমিনে দেখা যায়, কারখানার প্রধান ফটকে শ্রমিক নিয়োগ বিজ্ঞাপন টানিয়ে দেয়া হয়েছে। কারখানায় নিয়োগকৃত শ্রমিকরা ভিতরে আসা-যাওয়া করছে। কারখানায় উৎপাদিত পন্য নিয়ে পন্যবাহী গাড়ি বের হচ্ছে। কারখানায় দৈনন্দিন কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। তবে কারখানার আশেপাশের বাসিন্দারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন মালিকের পেটুয়া বাহিনীর ভয়ে কেউ কোন কথা বলতে চায় না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাসেম ফুড কারখানায় নিহত এক নারী শ্রমিকের বাবা জানান, ‘নিয়ম না মেনে কারখানা পরিচালনার পরও মালিক এবং তার সন্তানদেরকে মামলার দায় থেকে আড়াল করা হয়েছে। এমনকি প্রতিষ্ঠানটি পূনরায় নির্মাণ করে পরিচালনা করা হলেও সেখানে কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন নেয়া হয়নি। এরপরও তা দিব্যি চলমান রয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। মালিক পক্ষ প্রভাবশালী হওয়ায় তার কাছে আইনের পরাজয় ঘটছে। এটা মেনে নেয়া যায় না।’
জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক আসাদুজ্জামান রনি দৈনিক সংবাদচর্চাকে বলেন, ‘আমরা নোটিশ করেছি। নোটিশের পরেও যদি তারা নির্দেশনা না মানে, তাহলে আমরা পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে মামলায় যাবো। দূর্ঘটনার আগেও আমরা নোটিশ করেছিলাম। মামলায় যাওয়ার জন্য ১৪ দিন পর পর দুটো নোটিশ করতে হয়। আমরা আইনী পক্রিয়ায় যাবো, কারণ তারা লাইসেন্স ছাড়াই প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে যাচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘হাসেম ফুড কর্তৃপক্ষ বলছে তারা অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্থ ভবনটা বাদ দিয়েছে। নতুন করে ভবন করে প্রোডাকশনে গিয়েছে। আমাদের কাছে লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেছে। আমরা পরিদর্শনে গিয়ে দেখেছি যে, তারা নতুন ভবন করলেও সেখানে লাইসেন্স দেয়ার মত উপযুক্ত নয়।’