আজ শনিবার, ৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

সমান অধিকার

সমান অধিকার

সমান অধিকার
মাজহারুল ইসলামঃ আমাদের সমাজে অনেকেরই ধারনা স্ত্রীলোকের বিদ্যা মূল্যহীন।পুরুষশাসিত সমাজের কতজনই বা সাফল্যের শীর্ষে ওঠা নারীকে তার প্রাপ্য সম্মান আর স্বীকৃতি দিতে পারে?বিভিন্ন কৌশলে নারীর সাফল্যকে তুচ্ছ ও খাটো করার চেষ্টা করছি আমরা।সাফল্য ছাড়াও মেয়েদের যে আলাদা আইডেন্টিটি আছে,ধারণক্ষমতা আছে,নিজস্ব জগৎ আছে এটা কেউ মনে করতে চায়না।
নারীরা স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে, নারী জীবনের সহজ ও সাধারণ সত্যকে অবজ্ঞা আর তাচ্ছিল্যই করে এসেছে পুরুষ।অথচ নারী পিছিয়ে থাকার কারণে পুরুষরা ক্ষতিগ্রস্ত হয় সবচেয়ে বেশি,কারণ তারা উপযুক্ত সঙ্গিনী পায় না।নারীর উপযুক্ত হয়ে গড়ে ওঠার পেছনে প্রতিবন্ধকতার কথা কেউ বলেনা।আর উপযুক্ত হলেও পুরুষতন্ত্র যে নারীকে নিঁচুতেই নামিয়ে রাখতে চায় একথা বলার অপেক্ষা রাখেনা।

নারীর প্রতি পুরুষের লাঞ্ছনা, অবমাননার সামাজিক ভিত্তি হলো দুই হাজার ৩০০ বছর আগে অ্যারিস্টল বলেছিলেন,মেয়েরা পুরুষের তুলনায় অক্ষম ও স্বল্প বুদ্ধিসম্পন্ন।অ্যারিস্টলকে অনুসরণ করে যুগের পর যুগ পুরুষরা তোতাপাখির মতো একই কথার গুরুত্ব দিয়ে যাচ্ছে।
নারী প্রগতির এই সময়ে আজও আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ মেয়েদের অগ্রগতি,সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের সাফল্য,কৃতিত্ব রুখে দেওয়ার জন্য বেহুঁশ হয়ে আছে। দেশের শিক্ষিত সমাজ পশ্চাৎমুখী চিন্তাভাবনায় আজও আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে।পুরুষ পশ্চাৎমুখী চিন্তাভাবনায় আচ্ছন্ন এ-কথা বললে সমাজপতিরা ক্ষিপ্ত হয়,কারণ সমাজটা আজও তাদের নিয়ন্ত্রণে।
নারী আজ যখন সমস্ত প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে এভারেস্টের চূড়ায় পা রাখছে, শিক্ষা,বৈজ্ঞানিক গবেষণা,খেলাধুলা, সকল পেশায় সাফল্যের পরিচয় দিয়ে নিজেকে পুরুষের সমকক্ষ প্রমাণ করেছে তখনও আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষিত রক্ষণশীল সম্প্রদায় নারীর বিকাশকে সর্বপ্রকারে স্তব্ধ করতে মরিয়া হয়ে উঠে।
গত ৫০ বছরে সর্বক্ষেত্রে নারীর বিস্ময়কর অগ্রগতি সত্ত্বেও নারীকে হেয় প্রবণতা,নারীনির্যাতন,লাঞ্ছনা বেড়েই চলেছে।এখনো নারীর পরিচয় নির্ধারিত হয় পুরুষের উপভোগ্যতা সাপেক্ষে,নারীকে দেখা হয় পুরুষের পরিপ্রেক্ষিতে।
কুমারী নারী পিতৃপরিচয়,বিবাহিত হলে স্বামীর পরিচয়ে,প্রাচীন সামন্ত মূল্যবোধের সমাজে নারীর পরিচয়ে পুরুষের পটভূমিকা অত্যন্ত জরুরি এবং আবশ্যক।

সকলের দৃষ্টির আড়ালে,সারাদিনের কাজের শেষে সামান্যসম অবসর খুঁজে পেলেও আপনজনের ভালবাসা চায় নারী।মায়ের জাতি,বোনের জাতি,স্ত্রীর জাতিকে যতবেশী ভালবাসবে,সম্মান করবে এসমাজ ততবেশী উৎসাহ উদ্দীপনায় এগিয়ে যাবে।
উনিশ শতকের সূচনাকালে এদেশে মেয়েরা ছিল শিক্ষার আলোক থেকে বঞ্চিত,বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে সম্পর্ক শূন্য,মানবিক প্রায় সমস্ত অধিকার থেকেই বঞ্চিত।কন্যা সন্তান পৃথিবীর বুকে আগমন হলে শঙ্খধ্বনি দিয়েও স্বাগত জানানো হয়নি।অনাকাঙ্ক্ষিত জীবনের ভার সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হতো নারীকেই।উপযুক্ত না হলেও বিয়ে হয়ে যেত,কৈশোরে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাকে পুরুষের শয্যাসঙ্গী হতে হতো।
ফরাসি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ইউরোপের ইতিহাসে যে নতুন যুগের সূচনা হয়েছিল,টমাস পেইন ১৭৩৭ থেকে ১৮০৯ পর্যন্ত ছিলেন পুরোধা ব্যক্তি।তাঁর নিজের জীবনকাহিনী লেখার মধ্য দিয়ে তিনি স্বাধীনতা,সাম্য এবং মৈত্রীর আদর্শ পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।
নারীজাতি সমাজের সংখ্যাগুরু অংশ,অথচ তারাই সব থেকে বেশি বঞ্চিত এবং শোষিত।নারী নিজেকে বিলুপ্ত করবে না,সংসারের ঘূর্ণাবর্তে,মর্যাদা ও সম্মানের আসনে থেকে ক্রমাগত অনুশীলনের মধ্য দিয়ে আত্মবিকাশের পথে এগিয়ে যেতে চায়।সমাজে-সংসারে সম্মান ও আত্মমর্যাদার আসনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে,অর্থনৈতিক স্বাধীনতায় স্বাবলম্বী হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায় নারী।
স্বাধীন,স্বনির্ভর কোনো নারী আজও যদি তাঁর মুক্তবুদ্ধির নির্দেশ অনুযায়ী বাঁচতে চায় তবে তার বিরুদ্ধে কুৎসা,কলঙ্ক ছড়াতে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ আজও কি পিছিয়ে থাকে?
যে কোনো দেশে বঞ্চিত,শোষিত, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যাগুরু অংশ নারী।জীবনের উপলব্ধির আলোকে নারীর পক্ষে তাঁর এই অবস্থান পুরুষের সমর্থন পায়নি।উপরন্তু নানা ব্যঙ্গাত্মক বিশ্লেষণে তাঁকে ভূষিত করা হয়।বেঁচে থাকতে জীবনে সম্মান,সামাজিক প্রতিষ্ঠা কিছুই পায়না তারা।কোন একজন বিশেষ মানুষের প্রতি আনুগত্য কিংবা আসক্তি নারীর স্বাধীনতা, আত্মপ্রতিষ্ঠা,আত্মমর্যাদাবোধের পথে আসে অনেক বাধা।
উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই আধুনিক চিন্তাভাবনা আমাদের দেশেও মেয়েদের মনে প্রবেশ করেছিল।বেগম রোকেয়ার আবির্ভাব এক ঐতিহাসিক বিস্ময়কর ঘটনা। উনিশ শতকের শেষ দিকে জমিদার পরিবারে জন্মেছিলেন বেগম রোকেয়া।তার পিতা মেয়ের শিক্ষার ব্যাপারে মোটেই আগ্রহী ছিলেন না। রোকেয়ার যা কিছু শিক্ষা সবই বড় ভাইয়ের কাছে।
জৈবিক যে-কারণটি নারীকে পুরুষের থেকে নামিয়ে রাখে সেটি হলো তার ধারণক্ষমতা,নারী সন্তান ধারণ করে।এই একটি মাত্র প্রাকৃতিক ঘটনাই পুরুষকে কোথাও কোথাও বাড়তি সুবিধা দেয় যা নারী পায় না।নারীর এই শরীরকেন্দ্রিক ব্যাপারটিকে পুরুষ কাজে লাগায়।নারীর শরীরকে কাজে লাগিয়ে সে কিছু বাড়তি সুবিধা আদায়ের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে নারীর উপর।
এযাবৎকাল সবকিছুই পুরুষের স্বার্থে,সমাজ-ক্ষমতা সবকিছুই পুরুষের হাতে,পুরুষের প্রয়োজনে হয়ে এসেছে,নারীর জন্য শুধুই থেকেছে গৃহকোণ।
পুরুষতন্ত্র কখনো নারীকে বুঝতে দেয়নি পরিবার এবং সমাজে প্রকৃত এবং পবিত্র নারীদের জন্য নারী-পুরুষ উভয়ের সমান অধিকার।

স্পন্সরেড আর্টিকেলঃ