আজ সোমবার, ৩০শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৩ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

শ্বেতপত্রে ‘ধর্ম ব্যবসায়ী’ ফেরদাউস

সংবাদচর্চা রিপোর্ট :

অজপাড়াগাঁও আলীরটেক থেকে উঠে আসা মাওলানা ফেরদাউসুর রহমানের শান শওকত চোখে পড়ার মতো। সমাজের উুঁচতলার মানুষের সঙ্গে তার বেশ সখ্যতা। চলেন অন্তত ত্রিশ লাখ টাকার দামের গাড়ি হাঁকিয়ে। ওয়াজিন হিসেবেও তার রয়েছে সুখ্যাতি। নানা কারণেই সারাবছরই আলোচনায় থাকেন প্রায় চল্লিশ বছর বয়সী এই হেফাজত নেতা। তবে তিনি নিজেও আলোচনায় থাকতে খুব পছন্দ করেন। পক্ষে কিংবা বিপক্ষে যাহোত পত্রিকার শিরোনামে এলেই তিনি খুশি।
প্রভাবশালী সাংসদ শামীম ওসমানের সঙ্গে তার বেশ দহরম-মহরম, এমন অভিযোগ অনেকেরই। কারো কারো মতে, এই সাংসদের আশীর্বাদ থাকায় কোনো রকম জুটঝামেলার গ্যাড়াকলে পড়তে হয় না তাকে। সাধারণ মানুষকে উস্কানি দিয়ে হট্টগোল সৃষ্টির ক্ষেত্রেও তার অবদান গুরুত্বপূর্ণ। কারো কারো মতে, বিতর্ক এবং ফেরদাউসুর রহমান যেন এক সুতোয় গাঁথা। সম্প্রতি তিনি নারাণগঞ্জ নগরীর ফুসফুসে খ্যাত শেখ রাসেল পার্ককে মিনি পতিতালয় বলে নতুন বিতর্ক সৃষ্টি করেছেন। এ ঘটনায় অবশ্য তার ওপর যারপরনাই ক্ষুব্ধ নগরবাসী।
এদিকে মাওলানা ফেরদাউসুর রহমান ইতোমধ্যেই ‘ধর্ম ব্যবসায়ী’ হিসেবে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সমন্বয়ে গঠিত গণকমিশনের ‘শে^তপত্রে’। গেল ২০২২ সালের ১১ মে মাসে এক হাজার মাদরাসার তথ্য-উপাত্তের ওপর তদন্ত করে শতাধিক ‘ধর্ম ব্যবসায়ী’র দুর্নীতির তদন্ত চেয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) জমা দেয়া তালিকার ৭৯ নম্বরে রয়েছে মাওলানা ফেরদাউসুর রহমানের নাম। এদিন দুদক চেয়ারম্যান মঈনউদ্দীন আবদুল্লার কাছে শ্বেতপত্র ও সন্দেহভাজন ১১৬ ব্যক্তির তালিকা তুলে দেওয়া হয়। গণকমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও সদস্য সচিব ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধিদল এ সময় উপস্থিত ছিল।
দুদকে শ্বেতপত্র জমা দেওয়ার পর ঢাকায় দুদক কার্যালয়ের সামনে উপস্থিত সাংবাদিকদের গণকমিশনের চেয়ারপারসন বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক জানান, তারা ৯ মাস তদন্ত করে ২ হাজার ২০০ পৃষ্ঠার শ্বেতপত্র তৈরি করেছেন। তাতে বহু ভুক্তভোগীর সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। তদন্তে ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর দুর্নীতি ও মানি লন্ডারিংয়ের প্রমাণ পাওয়া গেছে। জঙ্গিবাদ ছড়াতে জামায়াতে ইসলামী ও ধর্ম ব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে অর্থায়ন করার তথ্যও মিলেছে। তাদের সন্ত্রাসী তৎপরতা ও দুর্নীতির তথ্য দুদকে জমা দেওয়া হয়েছে। তাদের আর বাড়তে দেওয়া যায় না।
দেশের বিভিন্ন স্থানের ডিসি, এসপি, ইউএনওসহ বেশ কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে এ শ্বেতপত্রে জানানো হয়েছে, তারা মৌলবাদী ধর্ম ব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে উস্কানি দিচ্ছেন।
সাংবাদিকদের অন্য এক প্রশ্নের জবাবে গণকমিশনের চেয়ারপারসন দুদক চেয়ারম্যানকে উদ্ৃব্দত করে বলেন, তিনি জানিয়েছেন, অর্ধশতাধিক ‘ওয়াজ’ ব্যবসায়ীর দুর্নীতির অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। শ্বেতপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দুদক আইন অনুযায়ী অপরাধীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেবে। জেলে আটক মাওলানা মামুনুল হকসহ যারা মৌলবাদী তৎপরতা ও ধর্মীয় সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধেও তদন্ত চলমান।
গণকমিশনের সদস্য সচিব ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ সাংবাদিকদের বলেন, ১ হাজার মাদ্রাসা ও ওয়াজকারীদের নাম-পরিচয় শ্বেতপত্রে বিস্তারিত দেওয়া হয়েছে। এখানে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী ও হেফাজতের কর্মকাণ্ড উঠে এসেছে। তাদের অর্থনৈতিক জবাবদিহিতার আওতায় আনার জোর দাবি জানানো হয়েছে।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও গণকমিশনের সমন্বয়ক কাজী মুকুল বলেন, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ বিনির্মাণে এই শ্বেতপত্র তৈরি করা হয়েছে। তদন্তে দেখা গেছে, মৌলবাদী গোষ্ঠীর অর্থের প্রবাহ চলমান রয়েছে। এতে তরুণ সমাজ বিপথে যাচ্ছে। গণকমিশন সব মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক শক্তির চেহারা উন্মোচন করছে।
গেল ১০ ফেব্রুয়ারি শেখ রাসেল পার্কে ঢুকে হামলা ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। অভিযোগ মাওলানা ফেরদাউসুর রহমান ঘটনার দিন নারায়ণগঞ্জ না থেকেও এই হামলা ও লুটপাটের ঘটনার নায়ক ছিলেন। তার নির্দেশেই তার অনুসারিরা ওই হামলা চালিয়েছিলেন বলেও শোনা যায়। এই ঘটনায় নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে একটি মামলা করা হয়। মামলা মাওলানা ফেরদাউসুর রহমানকেও আসামি করা হয়। এতে করেই তিনি যারপরনাই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন। সিটি মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীকে ঘিরে অশালীন কথাবার্তায় ভরপুর বক্তব্য দিতে শুরু করেন। পাশাপাশি তিনি চারুকলা ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেওয়ার হুমকির পাশাপাশি মেয়রকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে বক্তব্য রাখেন। শুধু তাই নয়; মেয়রের বিরুদ্ধে ধর্মপ্রাণ মুসুল্লীদের ক্ষেপিয়ে দিতে যাচ্ছেতাই বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন গেল কিছুদিন ধরে। তার সঙ্গে রয়েছেন তার মুরুব্বী হিসেবে খ্যাত ডিআইটি মসজিদের আলেম হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের নায়েবে আমীর মাওলানা আবদুল আউয়াল।
হেফাজতে ইসলামের জেলা সভাপতি মাওলানা আব্দুল আউয়াল ও মহানগরের সভাপতি মাওলানা ফেরদাউসুর রহমান ‘নারায়ণগঞ্জর গডফাদারের অনুসারি’ বলে মন্তব্য করেন নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোটের উপদেষ্টা রফিউর রাব্বি। তিনি বলেন, ‘ফেরদাউস, আউয়াল নারায়ণগঞ্জের গড়ফাদারের অনুসারি। তারা বিভিন্ন সময় তার কাছ থেকে অর্থ সহযোগিতা নিয়ে থাকে। বিভিন্ন অপকর্মে তার লাঠিয়াল বাহিনী, সহযোগি হিসেবে কাজ করে।’
এর আগে শুক্রবার ডিআইটি এলাকায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে মাওলানা ফেরদাউসুর রহমান বলেছেন, ‘আমরা রাজপথের লোক। আগেও ছিলাম এখনোও আছি। কারও রক্তচক্ষুকে আমরা ভয় পাই না আগেও প্রমান দিছি এখনোও প্রমাণ দেই। কারও রক্তচক্ষুকে অন্তত আমরা ভয় পাইনা। কে কি কয় এগুলা হুননের (শোনার) সময় আমাদের নাই।’
তিনি আরও বলেন, ‘সেদিনকার ঘটনা কী হয়েছে আব্দুল আউয়াল সাহেব বলেছেন। এগুলা ভুয়া মামলা, মিথ্যা মামলা সবাই জানে। ওই ঘটনার মামলায় ১৪জনকে এরেস্ট করেছে। মামলা দিবে ঠিকাদার বা মামলা করবে রেস্টুরেন্টের মালিক। এখানে সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা মামলা দেয় কিভাবে। মামলাই তো অবৈধ।’

স্পন্সরেড আর্টিকেলঃ