আজ শনিবার, ৪ঠা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৮ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

রূপগঞ্জে মুচি সম্প্রদায় ভীষণ কষ্ট ও দুর্বিপাকে দিন কাটাচ্ছে

বিপ্লব হাসান : নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বসবাসরত মুুচি সম্প্রদায় নানা সমস্যার বেড়া জালে আটকে ভীষণ কষ্ট ও দুর্বিপাকে দিন কাটাচ্ছে। তবে মুচি বলা হয় যারা জুতা তৈরি এবং জুতা মেরামতের কাজ করেন। ক্রটিযুক্ত বা পুরনো জুতা সেন্ডেল মেরামত করে রং মাখিয়ে চাকচিক্য সৃষ্টি করাও এদের কাজ। এছাড়া মুচিদের মূলত দুটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়, যথা কাশ্যপ এং শান্ডিল্য।

নিকট আত্মীয়দের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্কে বাধানিষেধ নেই। এ সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যভিচারের অভিযোগে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে এবং বিবাহ বিচ্ছেদপ্রাপ্ত বা বিধাবা মহিলাদের পুনঃবিবাহের বিধান আছে। তবে হিন্দু সমাজের নিচুজাত বলে তাদের বিবাহের কোন নথি বা রেজিস্ট্রেশন হয় না। ফলে বাল্য বিয়ে, বহুবিবাহ, যৌতুক সমস্যা এদের যেন নিত্যসঙ্গী হয়েই আছে। অধিকাংশ মুচি শিব সম্প্রদায়ভূক্ত, তবে তাদের একটা বড় অংশ বৈষ্ণত। ধর্মীয় উৎসবাদিতে তারা শূদ্রদের অনুকরণ করেন। মুচিদের জন্ম সূত্র পেশা- বিভিন্ন পশুর চামড়া ক্রয় বিক্রয় , জুতা সেলাই করাই প্রধান কাজ। সকাল থেকে শুরু করে গভীর রাত পর্যন্ত তারা এ কাজ করে। সারাদিন কাজ করে তারা দুইশত বা তিনশত টাকার বেশী আয় করতে পারে না।

ফলে তাদের পরিবারে আর্থিক অভাব অনটন লেগেই থাকে। এভাবেই যুগের পর যুগ ধরে চলছে তাদের জীবন যাত্রা। এধরনের নানা মুখী সমস্যার বেড়াজালে আটকে মুচি সম্প্রদায় আজও অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে। আগেকার দিনে মুসলিম ও হিন্দু যে কোনো সম্প্রদায়ের বিয়ে শাদীতে মুচিদের প্রয়োজনীয়তা ছিল বেশি। বিয়ের মিষ্টি বহন, বরের জুতা খোলা-পরানোসহ অনেক কাজ ছিল নির্ধারিত। এ কাজ মুচি ছাড়া কেউ করত না।

এছাড়া আগে মুচিরা কোরবানীর ঈদে জবাইকৃত পশুর চামড়া সামান্য কিছু টাকা দিয়ে নিয়ে যেত। বর্তমানে চামড়া ব্যবসায়ীরা চড়া দামে কিনে নিয়ে যাওয়ায় মুচিরা এ থেকে বঞ্চিত। আগের আমলে গো মোড়ক ছিল বেশি। প্রতিবছর প্রতি গ্রামে ২০/৪০ টা গবাদি পশু রোগাক্রান্ত হয়ে মারা যেত। মরা গরুর চামড়া বিনা পয়সায় ছিলে নিয়ে শোধন করে তারা বিক্রি করত। বর্তমানে অত্যাধুনিক চিকিৎসায় ভেকসিনের ফলে গো -মোড়ক বন্ধ হয়ে গেছে। আগেকার দিনে মুচি সম্প্রদায়ের লোকেরা বেগ, জুতা, লেদার সেলাই করে ভালো আয় রোজকার করত। বর্তমানে প্লাস্টিক ও উন্নত মানের জুতা সহ বিভিন্ন সামগ্রী বাজারে থাকায় মুচিদের কাজ কমে গেছে। এ যুগে জুতা কালি করে ও হালকা জুতা সেলাই করে সারাদিন যে টাকা উপার্জন হয় তাতে পেটের ভাত জোগাড় করা মুশকিল হয়ে পড়ে। তাই এদের মধ্যে অনেকেই এখন পৈত্রিক এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় যুক্ত হচ্ছেন। কাজের নির্দিষ্ট জায়গার অভাব , সামাজিক ভাবে নিম্ন মর্যাদা, লেখাপড়ার সুবিধা না পাওয়া , মুজরী বৈষম্যসহ নানামুখী সমস্যা প্রতিনিয়ত তাদের টিকে থাকতে বাধা হয়ে দাড়াচ্ছে। তাদের  দুরাবস্থা দেখার কেউ নেই। উপজেলার সাওঘাট এলাকার শ্রী অঙ্গত চন্দ্র দাস নামে এক মুচি সম্প্রদায়ের কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, আমাদের মুচি সম্প্রদায়ের জাতিগত কাজ ও সকল ব্যবসা এমনকি রোজগারের রাস্তা দিন দিন প্রায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তাই অনেকেই জাতিগত এই পেশা ছেড়ে দিয়ে কৃষি কাজ, দিন মুজুর , শেলুনসহ বিভিন্ন গার্মেন্টস ফেক্টরীতে কাজ নিতে বাধ্য হয়েছেন। আমরা বিভিন্ন প্রাকৃতিক দূর্যোগ ও অভাব অনটনের মধ্য দিয়ে বহু কষ্ট করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকি। আমাদের দিকে তাকানোর মতো কেউ নেই।

তিনি আরো জানান, ক্ষুদ্র নৃ- গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের জন্য বিভিন্ন সময়ে সরকারি ভাবে বিভিন্ন সাহায্য অনুদান প্রদান করলেও আমরা এ থেকে বঞ্চিত। এদেশ ও সমাজে আমরা অবহেলার পাত্র বৈ কিছু নই। হাতধরে হাতেখড়ি। ছোট জাতি হিসেবে মুচি ঘরে জন্মগ্রহণ করায় শিখেছি মুচির কাজ। প্রায় ২৮বছর ধরে এ পেশায় নিয়োজিত। অনেক লাঞ্ছনা মারধর উপেক্ষা করে এখন এ অবস্থায় আছি। তিনি আরো জানান মুচিদের বিবাহ , আত্মীয়তা , বিচার-শালিশ নিজেদের সম্প্রদায়ের মধ্যেই হয়ে থাকে। উপজেলার গোলাকান্দাইল বাস স্ট্যান্ডের পার্শ্বের মুচি দোকানদার শ্রী সত্য চন্দ্র রায় তিনি জানান, আমি ৪ছেলে মেয়ে স্ত্রীকে নিয়ে জীবন সংসার চালাচ্ছি এই কাজ করে। যদি কাজ ভালো হয় দিনে প্রায় ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা আয় রোজগার করেন তিনি । এ দিয়ে কোন মতো সংসার চালাতে হয়। মুচি সম্প্রদায়ের কিছু লোকজন জানান, স্বাধীনতার ৪৭বছর পেরিয়ে গেলেও আজও তারা বাংলাদেশের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়েছেন। মুচি সম্প্রদায়েরা নিম্ন জাতের মানুষ হওয়ায় ধর্মীয় কোনো সিদ্ধান্তের অধিকার নাই তাদের। পুরহিতের ইচ্ছায় চালাতে হয় ধর্মকর্ম ।

এমন কি পূজাপার্বনেও অনুমতি ছাড়া মন্দিরে যাওয়া হয় না। ধর্ম গুরুর ইচ্ছায় অনেকটা তাদের আচার্য। মুচি সম্প্রদায়ের বেশির ভাগ শিশুই শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। পরিবারের আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে বিভিন্ন কাজ করে তারা। ফলে স্কুলে যাওয়ার সময় হয় না। আবার অনেকেই পিতার কাজে সহযোগীতা করেন। আর এ কারণে স্কুলে বা পড়ালেখার সময় নেই তাদের। যাই হোক সমাজের একটি বড় দায়িত্ব তাদের উপর ন্যাস্ত। অবহেলায় নয় অধিকার সহকারে আমাদের উচিত সঠিক সময়ে তাদেরকে মূল্যায়ণ করা। আমাদের সমাজ থেকে নানা প্রতিকুলতায় এ পেশার মানুষগুলো অন্য পেশায় পাড়ি জমাচ্ছে। দৈনন্দিন আয় কমে যাওয়া ও অসম্মানজনক পেশা এমন নানাবিধ বিষয়কে সামনে রেখে উপজেলার অনেক মুচি সম্প্রদায়ের লোকেরা অন্য পেশা বেছে নিচ্ছে। তাদের মতো এমনও অনেক পেশার অনেক লোক আছে যারা সারাটা জীবনে অনেক লাঞ্ছনা বঞ্চনা সহ্য করে আমাদের কে ধন্য করেছেন । মনুষত্ববোধ নিয়ে আমরা যে যে পেশার মানুষই হই তাদের সকলকে শ্রদ্ধা সম্মান দেয়া মানুষ হিসেবে আমাদের উচিত। প্রাচীন ও প্রয়োজনীয় এ পেশাকে টিকিয়ে রাখতে এদের সমস্যাবলীর প্রতিকারের ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সমাজের সচেতন ও সরকারের উর্ধ্বতন মহলের সুদৃষ্টি কামনা করছেন সচেতন মহলের লোকজন।

স্পন্সরেড আর্টিকেলঃ