বিশ্বকাপ মঞ্চ থেকে বিদায় নিচ্ছেন এক ক্রিকেট মহানায়ক। আজ শুক্রবার পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে দ্বাদশ বিশ্বকাপের অভিযান শেষ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। আর এ ম্যাচ দিয়ে বিশ্বকাপ মঞ্চ থেকে বিদায় নিতে যাচ্ছেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের মহানায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা। বিদায়ের পর্বটা ভালো হলো না বাংলাদেশ অধিনায়কের।
বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে খেলার স্বপ্ন নিয়ে ইংল্যান্ডের মাটিতে পা দিয়েছিলেন মাশরাফি। কিন্তু দুর্ভাগ্য পিছু ছাড়েনি বাংলাদেশের। বাজে ফিল্ডিং, বৃষ্টিতে পয়েন্ট নষ্ট, জয়ের কাছে গিয়েও হেরে যাওয়া— দুর্ভাগ্য ছাড়া কিছুই নয়। তাই তো সংবাদ সম্মেলনে একটা কথা প্রায়ই মাশরাফি বলেন, ‘ভাগ্য অনেক বড় ফ্যাক্টর। আপনি যতই ভালো খেলুন না কেন, ভাগ্যের সহায়তা থাকতে হয়।’
দুর্ভাগ্য মাশরাফি ও বাংলাদেশের। সেমিফাইনালের স্বপ্ন পূরণ হয়নি। কিন্তু আজ তো অন্তত ভাগ্যের সহায়তা চাইতেই পারেন মাশরাফি। কারণ, আজই যে বাংলাদেশ অধিনায়কের বিশ্বকাপে শেষ ম্যাচ।
বয়স ৩৬ ছুঁইছুঁই। আগামী বিশ্বকাপ ২০২৩ সালে। সেখানে মাশরাফির খেলা দুরূহ। সেটি নিজেও জানেন মাশরাফি। তাই দেশ ছাড়ার আগে এবং ইংল্যান্ডে এসেও বলেছেন, ‘এবারের আসরই আমার শেষ বিশ্বকাপ।’
মাশরাফির শেষ বিশ্বকাপটা রঙিন হলো না। তবে বিশ্বকাপের শেষ ম্যাচটা রঙিন করতে মুখিয়ে থাকবেন তিনি।
বিশ্বকাপে সময়টা মোটেও ভালো যাচ্ছে না মাশরাফির। দুর্দান্ত ফর্ম নিয়ে বিশ্বকাপের মঞ্চে এসেছিলেন তিনি। কিন্তু এখন পর্যন্ত সাত ইনিংসে বল করে মাত্র একটি উইকেট পেয়েছেন। ৪৯ ওভার বল করে ৬ দশমিক ৪২ ইকোনমি রেটে ৩১৫ রান দিয়েছেন। এমন পারফরম্যান্সে মাশরাফি নিজেও হতাশ। তাই মন খারাপ নিয়েই বলেছিলেন, ‘আমার নিজেরও খুব খারাপ লাগছে।’
খারাপ লাগছে ভক্তদেরও। তাই তো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মাশরাফিকে নিয়ে হাহাকার তাদের। তবে যারা সমালোচনায় পটু, তারা ঠিকই তাদের কাজটি করছে। মাশরাফিকে নিয়ে সমালোচনা করতে ভুল করেনি তারা। কিন্তু তারা হয়তো ভুলে গেছে, পায়ে সাতটি অস্ত্রোপচার নিয়ে এখনো ক্রিকেট খেলে যাচ্ছেন ‘ম্যাশ’। অধিনায়কত্ব ও বোলিং দিয়ে দলকে সেরা অবস্থানে আনতে বড় ভূমিকা ছিল গত ৩০ ডিসেম্বর সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া মাশরাফির।
২০১৪ সালের শেষদিকে বাংলাদেশের ক্রিকেট যখন টালমাটাল অবস্থায়, তখনই দলের দায়িত্ব নেন মাশরাফি। বিশ্বকাপের আগে দেশের মাটিতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে পাঁচ ম্যাচের সিরিজে বাংলাদেশের ওয়ানডে অধিনায়ক হন তিনি। দায়িত্ব নিয়ে দলকে পাল্টে দেন ক্যারিশমাটিক মাশরাফি। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে পাঁচ ম্যাচ সিরিজের সবকটিতেই জয় পায় বাংলাদেশ। এই সাফল্য নিয়ে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপের এগারোতম আসরে খেলতে নামে টাইগাররা।
সে আসরে বড় কোনো লক্ষ্য ছিল না বাংলাদেশের। কিন্তু মাশরাফির নেতৃত্বে বিশ্বকাপের মঞ্চে সেরা সাফল্যই পায় বাংলাদেশ। গ্রুপ পর্ব পেরিয়ে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে প্রথমবারের মতো খেলে টাইগাররা। শেষ আট থেকে বিদায় নিলেও থেমে যায়নি বাংলাদেশের পথচলা। মাশরাফির নেতৃত্বে এরপর ভারত, পাকিস্তান ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দলকে নাকানিচুবানি দেয় বাংলাদেশ। এসব সাফল্যে আইসিসি ওয়ানডে র্যাংকিংয়ে সাত নম্বরে উঠে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে সরাসরি খেলার সুযোগ পায় বাংলাদেশ। সেখানে চমক দেখায় বাংলাদেশ। দলের খেলোয়াড়দের দুর্দান্ত পারফরম্যান্স এবং মাশরাফির বুদ্ধিদীপ্ত অধিনায়কত্ব বাংলাদেশকে সেমিফাইনালে তোলে। কিন্তু সেখানেই থেমে যায় বাংলাদেশের পথচলা।
বিশ্বকাপ ও চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সাফল্যে বাংলাদেশকে আরো বড় স্বপ্ন দেখান মাশরাফি। দ্বাদশ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে খেলার পণ করে ইংল্যান্ডে আসেন তিনি। কিন্তু ওই যে ভাগ্য সহায় হয়নি দলের। ভাগ্য সহায় হয়নি মাশরাফির। নয়তো বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি বিশ্বকাপের মঞ্চে মাত্র একটি উইকেট পাবেন, সেটা বেমানানই বটে।
২০০৭ সালের বিশ্বকাপে প্রথম খেলতে নামেন মাশরাফি। নয় ম্যাচে ৯ উইকেট নিয়েছিলেন তিনি। ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের জয়ে প্রধান ভূমিকা ছিল মাশরাফির। ৯.৩ ওভারে ৩৮ রান দিয়ে ৪ উইকেট নিয়ে ম্যাচসেরা হয়েছিলেন তিনি।
২০০৭ সালের বিশ্বকাপে দুর্দান্ত খেলা মাশরাফি ২০১১ সালের বিশ্বকাপ মিস করেন। দেশের মাটিতে ওই বিশ্বকাপের জন্য দল ঘোষণার এক মাস আগে ঘরোয়া ক্রিকেট খেলার সময় হাঁটুর ইনজুরিতে পড়েন তিনি। তাই মাশরাফিকে ছাড়া দেশের মাটিতেই বিশ্বকাপ খেলতে হয় বাংলাদেশকে।
তবে অধিনায়ক হিসেবে ২০১৫ বিশ্বকাপ খেলেছেন মাশরাফি। পাঁচ ম্যাচে অংশ নিয়ে ৭ উইকেট নিয়েছিলেন টাইগারদের নেতা। ২০১৫ বিশ্বকাপের পর আজ পর্যন্ত ৭২ ম্যাচে ৭৬ উইকেট নিয়েছেন মাশরাফি। দ্বিতীয়বার অধিনায়ক হওয়ার পর নেতা হিসেবেও বাংলাদেশকে এনে দিয়েছেন বড় বড় সাফল্য।
বাংলাদেশের ওয়ানডে ক্রিকেটের সেরা অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা। ৮৪ ম্যাচে দলকে নেতৃত্ব দিয়ে ৪৭টি জয় পেয়েছেন তিনি, হেরেছেন ৩৫টি ম্যাচ।
আজ বিশ্বকাপের মঞ্চে বাংলাদেশের ক্রিকেটের মহানায়কের ম্যাচকে স্মরণীয় করে রাখার আভাস দিলেন টাইগার কোচ স্টিভ রোডসও, ‘মাশরাফির শেষ বিশ্বকাপ ম্যাচের বাস্তবতা বুঝেই ক্রিকেটে মূল মনোযোগ দলের। আশা করি, ছেলেরা তাঁর শেষ বিশ্বকাপ ম্যাচে যথোপযুক্ত সম্মান দেবে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ম্যাচে ভালো খেলা।’