আজ শুক্রবার, ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ, ২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

বির্তক পিছু ছাড়ছেনা নারায়ণগঞ্জের

এস.এম. রিফাতঃ

একই জেলায় মেয়র-সাংসদের দ্বন্দ্ব, মেধাবী ছাত্র ত্বকী হত্যা, ভয়ংকর সেভেন মার্ডার, বিমান ছিনতাই, বালিশ দুর্নীতি থেকে শুরু করে ধারাবাহিক চুরি, ছিনতাই ও খুন। তার উপরে নতুন করে যোগ হয়েছে ধর্ষণের পর মৃত মেয়ে জীবিত উদ্ধারের মতো আশ্চর্যজনক ঘটনা। সবমিলিয়ে বিতর্ক যেনো পিছুই ছাড়ছেনা প্রাচ্যের ডান্ডি খ্যাত নারায়ণগঞ্জের।

সূত্রানুযায়ী, ২০১১ সালে শুরু হওয়া নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) নির্বাচনে সাংসদ শামীম ওসমানকে বিপুল ভোটে হারিয়ে জয়লাভ করে মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী। আর সেই থেকেই শুরু। একে ওপরকে প্রকাশ্যে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য, ঝগড়া-বিবাদ, কোন্দল এমনকি হকার ইস্যুকে কেন্দ্র করে দু’জনই নেমে এসেছিলেন রাজপথে। বিশ্লেষকদের মন্তব্য, ক্ষমতাসীন দলটির হাইকমান্ডও ব্যর্থ হয়েছেন এ দুই জনপ্রতিনিধিকে মেলাতে।

২০১৩ সালের ৬ মার্চ নিজ বাসার কাছ থেকে অপহরণ হয় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রফিউর রাব্বির ছেলে মেধাবী ছাত্র তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী। নিখোঁজের ঠিক দু’দিন পর অর্থ্যাৎ ৮মার্চ তার লাশ পাওয়া যায় শীতলক্ষ্যা নদীতে। পরবর্তীতে উচ্চ আদালত র‍্যাবকে এই মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেন। ২০১৪ সালে ত্বকী হত্যার এক বছর পূর্ণ হওয়ার দিনে র‍্যাবের তৎকালীন অতিরিক্ত মহাপরিচালক (এডিজি) জিয়াউল আহসান বলেছিলেন, শিগগিরই মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হবে। তবে, এতো বছর পেরিয়ে গেলেও সেই অভিযোগপত্র এখনও পর্যন্ত দেয়া হয়নি বলে জানা গেছে।

২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড থেকে অপহৃত হন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন সরকারসহ মোট সাতজন। তার তিন দিন পর ৩০ এপ্রিল শীতলক্ষ্যা নদীতে একে একে ভেসে ওঠে ছয়টি মৃতদেহ, পরদিন মেলে আরেকটি মৃতদেহ। ভেসে ওঠা লাশের বাকিরা হলেন, নজরুলের বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, লিটন, গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম ও চন্দন সরকারের গাড়িচালক মো. ইব্রাহীম। সারাদেশ ব্যাপী আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়া চাঞ্চল্যকর সেই সেভেন মার্ডারের নেপথ্যে

ছিলেন নরঘাতক নূর হোসেন। আর এ ঘটনার সাথে র‌্যাব কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতা থাকায় সেসময় সারাদেশে ‘টক অব দ্যা টাউন ছিলো’ নারায়ণগঞ্জ।

২০১৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি বিমান ছিনতাই করতে গিয়ে কমান্ডো অভিযানে নিহত হন পলাশ আহমেদ ওরফে মাহিবি জাহান। রাজধানী ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট বিজি-১৪৭ উড্ডয়নের পরপরই পলাশ নামের ওই যুবক অস্ত্র ঠেকিয়ে জিম্মি করেন পাইলটসহ ফ্লাইটে থাকা যাত্রী ও ক্রুদের। ওই অবস্থায় বিমানের পাইলট চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে বিমানটি নামান। যাত্রী ও ক্রুদের নামিয়ে আনার পর কমান্ডো অভিযানে মারা পড়েন পলাশ। পরবর্তীতে জানা যায়, নিহত পলাশ নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁয়ের ছেলে।

একই বছর ১৯ মে সরকারের মেগা উন্নয়ণ প্রকল্প রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থেকে ন্যাক্কার জনক দুর্নীতির ঘটনায় জড়িয়ে পরেন মহানগরী সিদ্ধিরগঞ্জের সন্তান মাসুদুল আলম। সেসময় জানা যায়, মাসুদুল আলমের বাবা সিদ্ধিরগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ২১০ মেগাওয়াটের সাবেক সহকারী প্রকৌশলী মৃত আব্দুল খালেক। তিনি চাকরীর সুবাদে সিদ্ধিরগঞ্জের পাওয়ার হাউজে দীর্ঘকাল বসবাস করেছেন। আর তার বড় সন্তান মাসুদুল আলম সিদ্ধিরগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্র উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ১৯৯০ সালে এসএসসি পাশ করেন। জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদের তথ্যানুযায়ী, বালিশ দুর্নীতির ওই ভবনের জন্য এক হাজার ৩২০টি বালিশ কেনা হয়েছিলো।

যার প্রতিটির মূল্য দেখানো হয়েছে ৫ হাজার ৯৫৭ টাকা। আর সেই প্রতিটি বালিশ নিচ থেকে ভবনের ওপরে তুলতে খরচ দেখানো হয়েছে ৭৬০ টাকা! সেসময় সর্বমোট ৯৬৬টি ফ্ল্যাটের জন্য আসবাবপত্র কিনেছিলেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। এর মধ্যে ২০ তলা একটি ভবনের ১১০টি ফ্ল্যাটের আসবাবপত্র কেনা ও তা ভবনে ওঠাতে সব মিলে ব্যয় দেখানো হয় ২৫ কোটি ৬৯ লাখ ৯২ হাজার ২৯২ টাকা। ওই ১১০টি ফ্ল্যাটের জন্য কেনা টিভি, ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন ও মাইক্রোওয়েভ কেনা হয়। সেসব আসবাবের ক্রয়মূল্য ও সেগুলোকে ফ্ল্যাটে তুলতে অস্বাভাবিক ব্যয় দেখানো হয় ওইসময়। সেই ঘটনা মুহুর্তেই ছড়িয়ে পরে দেশ ও দেশের বাইরে আর সমালোচনা হয় নারায়ণগঞ্জকে নিয়ে।

গত ৪ জুলাই ১৫ বছর বয়সী এক কিশোরী শহরের দেওভোগের বাসা থেকে বের হয়ে নিখোঁজ হয়। তাকে না পেয়ে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় জিডি ও মামলা করে তার পরিবার। ওই মামলায় পুলিশ আব্দুল্লাহ, রকিব ও নৌকার মাঝি খলিলুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ৯ আগস্ট তারা আদালতে জবানবন্দি দেন। সেখানে ‘অপহরণ, ধর্ষণ ও হত্যা করে লাশ শীতলক্ষ্যা নদীতে ভাসিয়ে দেওয়ার’ দায় স্বীকার করেন গ্রেপ্তারকৃতরা। ওই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন এসআই শামীম আল মামুন। এদিকে ঘটনার ৫১ দিন পর ২৩ আগস্ট ওই কিশোরী মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলে তাকে এনে পুলিশ সোর্পদ করে পরিবারের লোকজন। আদালতের নির্দেশে মেয়েটি এখন পরিবারের জিম্মাতেই আছে। গ্রেপ্তারকৃতদের পরিবারের লোকজনের অভিযোগ, রিমান্ড কমানোর কথা বলে সর্বমোট ৪৭ হাজার টাকা নেয়া হয় পরিবারের কাছে। আর মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে স্বীকার করানো হয় ধর্ষণ আর হত্যার কথা। যদিও পরবর্তীতে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই শামীমকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে। আর অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আসাদুজ্জামান ও মামলার বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা (ওসি) অপারেশন আব্দুল হাইকে আদালতে তলব করা হয়।

এছাড়াও চুরি-ছিনতাই, ধর্ষণ-খুন যেনো এ জেলার প্রায় নিত্যদিনের ঘটনা। প্রতিনিয়তই জেলায় বিভিন্ন জায়গায় ঘটে চলেছে অনাকাঙ্খিত সব ঘটনা। যা কোনভাবেই আর মেনে নিতে পারছেনা নগরীর সচেতন মহলের লোকজন। তাদের মতে, নরঘাতক নূর হোসেন থেকে শুরু করে এসআই শামীম পর্যন্ত সকলেই নারায়ণগঞ্জকে কলঙ্কিত করেছে, করেছে বিতর্কিত। এদের কারণেই আজ পুরো দেশব্যাপি নারায়নগঞ্জ জেলাকে নিয়ে সমালোচনার ঝড় বইছে।

একের পর এক বিতর্কিত ঘটনাকে ঘিরে উদ্বিগ্ন আপামর জনসাধারণ। নগরবাসীর মতে, বিগত সময়ে নারায়ণগঞ্জের অন্যান্য আলোচিত ঘটনার পর সারা দেশ ও বিশ্বের মধ্যে এ জেলাকে নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া করতে দেখা গেছে। যাদের কারণে সমালোচিত এ জেলা তাদের বেশিরভাগই নারায়ণগঞ্জের সন্তান কিংবা তারা এ জেলায় কর্মরত ছিলেন। দেশের অন্যতম শীর্ষ ধনী এবং প্রাচ্যের ডান্ডিখ্যাত নারায়ণগঞ্জে রূপ পুনরায় ফিরিয়ে আনতে সুষ্ঠ তদন্ত, প্রকৃত দোষীদের চিহ্নিত এবং বিতর্কিত ঘটনার সাথে জড়িতকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। সেই সাথে আগামী দিনগুলোতে যাতে আর কোন বিতর্কিত ঘটনার স্বাক্ষী নারায়ণগঞ্জকে না হতে হয় সেই লক্ষ্যে প্রশাসনকে এখন থেকেই আরও বেশি তৎপর থাকতে হবে।

স্পন্সরেড আর্টিকেলঃ