আজ শনিবার, ২৭শে পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১১ই জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

ডাক্তারের পাশে দালাল !

সাইফুল সুমন

শহরের খানপুরে ৩শ’ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে নেই অনিয়মের শেষ। ডাক্তারের পাশের টেবিলে বসেই নিজেদের বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের প্রচার চালাচ্ছে দালাল চক্র। প্রতিটি পরিক্ষার জন্য ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো কমিশন দেয়। তাই দেখে বোঝার উপায় নেই কে ডাক্তার আর কে দালাল!
বৃহস্পতিবার সকাল ১০ থেকে ১২টা পর্যন্ত হাসপাতালে দুই ঘন্টা অবস্থান নিয়ে দেখা যায়, একদল প্রধান ফটক থেকে হাসপাতালের বহির্বিভাগ পর্যন্ত অসহায় রোগীদের ফাঁদে ফেলছে। আরেক দল হাসপাতালের কর্মী বেশে ডাক্তারদের রুমে অবস্থান নিয়ে রোগীদের ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করছে।
একজন ডাক্তারের কক্ষে বসে থাকা এক ব্যক্তির পরিচয় জানতে চাইলে তিনি প্রথমে এ প্রতিবেদকের কাছে হাসপাতাল স্টাফ বলে পরিচয় দেন। তবে এক পর্যায়ে সে ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দালাল বলে জানায়। ওই দালাল জানান, এই হাসপাতালের অনেক ডাক্তার আমাদের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে বসেন। রোগীরা যাতে বাইরে তাদের কাছে চিকিৎসার জন্য যায় সেজন্য আমরা এখানে কাজ করি। এসব ডাক্তারের নাম প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক এই দালাল আরও বলেন, প্রতিটি রোগী নিয়ে যাওয়ার জন্য আমরা ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে কমিশন পাই। রোগীর খরচ যত বেশি হয় আমাদের কমিশন তত বেশি হয়।
বেলা ১১টার দিকে হাসপাতালের নাক কান গলা বিভাগে এক ভুক্তভোগী নারী ও একজন দালালের মধ্যকার কথাবার্তা শুনে অনেকেই ভিড় করে। এ প্রতিবেদক ওই নারীর সাথে আলাপ করে জানতে পারে, কিছু দিন আগে সে নাকের সমস্যা নিয়ে নাক কান গলা বিভাগের ডাক্তার মো. আতিকুল বারীর কাছে আসেন। তখন তার অল্প কথা শুনেই ডাক্তার কয়েকটি পরীক্ষা করতে দেন। ডাক্তারের সামনে বসা একজন দালাল ওই পরীক্ষা করার জন্য একটি ডায়োগনিস্টক সেন্টারের ভিজিটিং কার্ড ধরিয়ে দেন ও একজন লোক দিয়ে ঠিকানা মতো পাঠিয়ে দেন। সেখানে পরীক্ষা করেন ওই নারী। সুস্থ্য না হওয়ায় গতকালও তিনি একই বিভাগের একই ডাক্তারের কাছে আসেন। ভুক্তভোগী নারী জানান, ডাক্তার আমাকে সেই আগের টেস্টই করতে বলেন এবং আগের মতোই ডাক্তারের পাশে একজন ব্যক্তি ডায়াগনোস্টিক সেন্টারের ভিজিটিং কার্ড ধরিয়ে দেন। আমি তখন ডাক্তার সাহেবকে বলি, স্যার আমাকে তো এ টেস্ট আগেও করিয়েছেন। ভুক্তভোগী নারী জানান, ডাক্তার সাহেব আমার কথা আমলেই নেয়নি। ডাক্তারের কক্ষ থেকে বের হওয়ার পর ডায়াগনোস্টিক সেন্টারের দালালকে একই কথা বললে সেও ওই নারীকে পাত্তা দেয়নি। তাকে অনেকটা জোর করেই ফের টেস্ট করাতে নিয়ে যায়।
এ বিষয়ে ডা. আতিকুল বারীর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার সাথে কথা বলতে হলে আমার ঊর্ধ্বতন মহলের কাছে দরখাস্ত করে আসবেন।
বিষয়টি ৩শ’ শয্যা হাসপাতালের তত্ববধায়ক মো. আবু জাহেরকে জানালে তিনি ডা. আতিকুল বারীকে সাথে সাথে ডেকে নেন। ওই সময় আতিকুল বারী হাসপাতাল তত্ববধায়ককে জানান, শহরে নাক কান গলা রোগের টেস্ট করানোর জন্য ভালো ডায়েগনোস্টিক সেন্টারের খুব অভাব। ওই সেন্টারটি ভালো তাই ওখানে রোগী পাঠাই। তিনি আরও জানান, রোগীরা না চেনার কারনে আমি হাসপাতালের লোক সঙ্গে দেই।
তবে হাসপাতাল তত্ববধায়ক আবু জাহেরের দেয়া তথ্য মতে, এ হাসপাতালে ১২৯ জন স্টাফ কম নিয়ে তারা কাজ করছেন। প্রশ্ন উঠেছে, স্টাফ কম থাকার পরও ডা. আতিকুল বারী রোগীদের ডায়াগনোস্টিক সেন্টারের ঠিকানা চিনিয়ে দেয়ার জন্য বাড়তি লোক পান কোথায় ?
৩শ’ শয্যা হাসপাতালের তত্ববধায়ক মো. আবু জাহের এ প্রতিবেদককে বলেন, আমি একটু পর পর হাসপাতাল ঘুরে দেখি। আমার জানা মতে, হাসপাতালে কোন দালাল নেই। আর যদিও থাকেও আমি ব্যবস্থা নিবো।
দালাল রুখতে বিভিন্ন সময় এ হাসপাতালে র‌্যাব অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানে দালাল চক্রের সদস্যদের আটক করা হলেও কিছুদিন পর জেল থেকে বেড় হয়ে তারা আবারো দালালি করে থাকে।
গত ১৮ জুলাই ৩শ’ শয্যায় র‌্যাবের দালাল বিরোধী অভিযানে হাসপাতালে উপস্থিত হয়ে সেলিম ওসমান ঘোষণা দিয়েছিলেন দালালদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। হাসপাতালের অভ্যন্তরে দালালদের দৌরাত্ম্য ও অনিয়ম ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ভ্রাম্যমান আদালতের এমন অভিযান অব্যাহত থাকবে। প্রথমাবস্থায় প্রাথমিক ভাবে শাস্তি কম দেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে আরো কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। আর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কেউ যদি কোন প্রকার অনিয়মের সাথে জড়িত থাকেন এবং অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া যায় তাহলে তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। যে কোন কিছুর বিনিময়ে হাসপাতালটিকে দালাল ও অনিয়ম মুক্ত করতে হবে।
র‌্যাব-১১’র এডিশনাল এসপি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ডাক্তারাই যদি দালালদের সাথে রাখে তাহলে আমাদের আর কিছু করার থাকে না। কারন আমরা যখন অভিযান চালাই তখন এই দালালরা ডাক্তারদের আপনজন পরিচয় দেয়। আমাদের কাছে যদি কেউ অভিযোগ না করে তাহলে আমাদের পক্ষে এসব দালালদের খুঁজে বেড় করা কষ্টকর হয়ে যায়। এসব বিষয়ে নজর রাখতে হবে হাসপাতালের ডাক্তার ও র্কতৃপক্ষের। তারা যদি আমাদের তথ্য দিয়ে সাহায্য করে তাহলে হয়তো এসব সরকারি হাসপাতালগুলো দালাল মুক্ত করা যাবে। তবে আমরা আবারো এসব বিষয়ে নজর রাখবো । দরকার হলে আবারো অভিযান চালাবো।