আজ সোমবার, ২৪শে আষাঢ়, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৮ই জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

জলবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের নাভীতে ৭ কিমি কার দখলে?

সংবাদচর্চা রিপোর্ট:

টানা কয়েক বছরের জলাবদ্ধতা নিরসনে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে ঢাকা নারায়ণগঞ্জ ডেমরা (ডিএনডি) প্রকল্প নামে বিশাল এক প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডে আওতায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্ববধানে কাজ শুরু হয়। কাজের শুরুতেই সেনাবাহিনীর প্রকৌশলী বিভাগ ঢাকা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের কাজে হাত দেয়। ঢাকা নারায়ণগঞ্জ ডেমরার বেশিরভাগ অঞ্চলের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে তাক লাগিয়ে দেয় সাধারন মানুষের চোখে। নারায়ণগঞ্জের নাভীতে ভান্ডারী পুল এলাকা থেকে হাজীগঞ্জ রেল লাইন পর্যন্ত প্রায় ৭ কিলোমিটার লম্বা খালের উপর স্কুল, মসজিদ, মাদ্রাসা, বসাবাসের জন্য ৫ থেকে ৬ তলা বিশিষ্ট ভবন, ব্যবসায়ীক কার্যালয়, ঝুটের গোডাউন, কলকারখানা, রোলিং মিল, গার্মেন্টস শিল্প গড়ে উঠেছে অবলীলায়। তবে এলাকাবাসীর প্রশ্ন হচ্ছে ঢাকা নারায়ণগঞ্জ ডেমরা পুরো এলাকায় উচ্ছেদ পরিচালনা করা হলেও কেন এই অঞ্চলে অবৈধ স্থাপনা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে?

এমন প্রশ্নের জবাব অনুসন্ধান করতে গত ৯ ডিসেম্বর রোববার থেকে সংবাদচর্চার অনুসন্ধানী দল বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও জনসাধারনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বহুল কাঙ্খিত ঢাকা নারায়ণগঞ্জ ডেমরা (ডিএনডি) প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শুরু হওয়ায় আসন্ন বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা দূর হওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী এলাকাবাসী। এরই মধ্যে চিহ্নিত করা হয়েছে পানি নিষ্কাশন খালগুলো। শেষ হয়েছে কয়েকটি মূল খালেরও খনন কাজ। এছাড়া উচ্ছেদ করা হয়েছে বেশিরভাগ অংশের অবৈধ স্থাপনা। ভেঙ্গে চুরে পরিস্কার করা হয়েছে খালের আশপাশে সরকারি জায়গায় গড়ে তোলা ভবনসহ বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা।

বর্ষাকালে জলাবদ্ধতা আর বছর জুড়ে পচা পানির দুর্গন্ধই ছিলো ডিএনডি এলাকায় প্রায় ৪০ লাখ এলাকাবাসীর নিত্য দুর্ভোগ। কিন্তু গত বছরের শেষের দিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধানে ডিএনডি প্রকল্পের কাজ দ্রুত গতিতে দৃশ্যমান হওয়ায় অনেকটাই স্বস্তিতে এলাকার মানুষ। তবে প্রকল্পের আওতায় জমি অধিগ্রহণে ভোগান্তিও আছে।

১৯৬২ সালে ঢাকার শ্যামপুর, যাত্রাবাড়ি, ডেমরা আর নারায়ণগঞ্জ সদর মিলে গঠন করা হয় ডিএনডি সেচ প্রকল্পটি। কিন্তু অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণে কলকারখানা আর বাসা বাড়ির বর্জ্যে ভরে গেছে সেচ প্রকল্পের পানি নিষ্কাষণ খালগুলো। আর রাসায়নিক বর্জ্যরে সংস্পর্শে এসে সেচ পাম্পগুলো হয়ে পড়ে বিকল। সাধারন মানুষের দুঃখ লাঘব করতে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী এ প্রকল্পের বিল পাশ করেন। তখন থেকেই এ অঞ্চলের সংসদ সদস্য একেএম শামীম ওসমান এ প্রকল্পটি তার অবদান বলে দাবী করে আসছেন। এ বছরের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ সার্কিট হাউজে এক মতবিনিময় সভায় তিনি বলেন, ডিএনডি প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ঢাকা আমাদের চেয়ে পিছিয়ে পড়বে। সেই ডিএনডির কাজ শুরু করেছি। সারা পৃথিবীতে দেশের সুনাম এনে দিয়েছে দেশের সেনাবাহিনী। তাই ডিএনডি প্রকল্পের কাজ করানো হচ্ছে সেনাবাহিনী দিয়ে। আমি চাই এই প্রকল্পের কাজের বিষয়ে কেউ যাতে আমার কাছে কোনো তদবির নিয়ে না আসে। আমরা চাই না সেনাবাহিনীকে নিয়ে কোনো বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টা হোক। তারা ইচ্ছে করলে অবৈধ দখলদারদের স্থাপনা ভেঙ্গে দিতে পারতো। কিন্তু তারা জনগণের দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে ধীরে সুস্থে এগুচ্ছে। এজন্য প্রতিটি মসজিদে জুমার খুতবার সময়ে জনগণকে সচেতন করতে হবে। প্রতিটি এলাকায় মাইকিং করতে হবে। ঢাকা নারায়নগঞ্জ ডেমরা (ডিএনডি) সেচ প্রকল্প এলাকায় নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়নে এবং জলাবদ্ধতা সমস্যার স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৫৫৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘ডিএনডি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন (ফ্রেজ-২)’ শীর্ষক প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে সেনাবাহিনী। এ মতবিনিময় সভায় ডিএনডির জলাবদ্ধতা নিষ্কাশন প্রকল্পের পরিচালক লে. কর্নেল মাশফিক আলম ভূঁইয়া বলেন, ঢাকা নারায়নগঞ্জ ডেমরা (ডিএনডি) বাধ এলাকায় পানি নিষ্কাশন প্রকল্পটি আমরা গেল বছরের ডিসেম্বরে ওয়ার্ক অর্ডার পেয়েছি। আমরা চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে প্রকল্পের কাজ শুরু করেছি। প্রকল্পটির মেয়াদ ২০২০ সালের জুন মাসের মধ্যে শেষ করার কথা থাকলেও আমরা ২০১৯ সালের জুলাই মাসে প্রকল্পটির কাজ শেষ করার প্ল্যান নিয়ে কাজ শুরু করেছি। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার এক বছর আগেই আমরা প্রকল্পটির কাজ শেষ করতে পারবো। তবে শুধু প্রকল্পের কাজ শেষ করাও নয় হাতিরঝিলের প্রকল্পের কাজকে মাথায় রেখেই আমরা এগুচ্ছি। খালগুলো দখলমুক্ত করার পরে এর পাড়গুলো বাধাই করে দেয়া হবে। দুই পাশে ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হবে। খালগুলোতে চলবে ওয়াটার ট্যাক্সি। ওই ওয়াটার ট্যাক্সিতে চড়ে ঢাকায় যাওয়া যাবে। ইটিপির মাধ্যমে পানি নিষ্কাশন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্ল্যান্ট নিয়েও আমরা পরিকল্পনা করছি। তবে খালের পানিতে ময়লা ফেলা যাবে না। আশা করছি প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে ডিএনডির চেহারা বদলে যাবে। এই বছর ডিএনডি অধিবাসীরা কিছুটা দুর্ভোগ পোহালেও আগামীতে তাদের জন্য সুদিন অপেক্ষা করছে। সভাটি জেলা প্রশাসক রাব্বি মিয়ার সভাপতিত্বে অন্যদের মধ্যে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার মঈনুল হক, সদর ইউএনও হোসনে আরা বেগম বিনা বক্তব্য রাখেন। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন দফতরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ, জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক শীর্ষ নেতারা।

প্রকল্পের বর্তমান অবস্থায় আমাদের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সিদ্ধিরগঞ্জের ভান্ডারী পুল, ২ নং ঢাকেশ্বরী, তাঁতখানা, চৌধুরী বাড়ি, এনায়েত নগর পুল, পাঠানটুলি ও হাজীগঞ্জ রেললাইন পর্যন্ত এলাকার কয়েক হাজার অবৈধ স্থাপনা ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। এলাকাবাসী বলছে সাংসদ শামীম ওসমানের ছত্রছায়ায় সন্ত্রাসীরা ওই এলাকায় অবৈধ স্থাপনাগুলো পরিচালনা করছেন। এলাকাবাসী যাদের নাম বলছেন তারা হলে পাঠানটুলি আইলপাড়ার শাহজাহান ও তার ভাই শহিদুল্লাহ ওরফে কালো মানিক। যে কারণে ওই এলাকায় অবাধে গড়ে উঠে বহুতল ভবনসহ বিভিন্ন ধরনে কলকারখানা গার্মেন্টস।

এ বিষয়ে জানতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রকল্প প্রকৌশলী মেজর মাহতাবের সাথে যোগাযোগ করা হয়। তিনি বলেন, আমাদের প্রকল্প অত্যন্ত সুন্দরভাবে চলছে। যে জায়গাটুকুর কথা জানলাম। সেই অংশটুকু আমাদের প্রকল্পের মধ্যে নেই। ওই জায়গার অবৈধ স্থাপনা পানি উন্নয়ন বোর্ড উচ্ছেদ করবে। রক্ষনাবেক্ষন করবে।

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধিগ্রহণকৃত সম্পত্তি রক্ষনাবেক্ষন করে (পওর) শাখা। বোর্ডের (পওর) শাখার নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল আউয়াল বলেন, নারায়ণগঞ্জে প্রভাবশালীদের বসবাস। আমরা উচ্ছেদ করতে গেলে অনেক সমস্যা। তাছাড়া জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সার্ভেয়ারের সংকট রয়েছে। ওই খাল সার্ভেয়ার দিয়ে মেপে তারপর উচ্ছেদ করতে হবে। আমরা জেলা প্রশাসকের কাছে চিঠি দিয়েছি। তবে কোন জবাব পাই নি। জেলা প্রশাসক সার্ভেয়ার দিতে পারলে আমরা উচ্ছেদ পরিচালনা করবো। তবে আশা করি আর্মি কাজ শেষ করার আগেই আমরা সব পরিস্কার করে ফেলবো।

এ বিষয়ে জানতে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে যোগাযোগ করলে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) জসিম উদ্দিন সার্ভেয়ারের কোন সংকট নেই বলে জানান। তারা পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোন চিঠি পাওয়ার কথা স্বীকার করেন নি।

দখল নেতৃত্ব দেয়া পাঠানটুলির শাহজাহানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ এলাকার খালের পাড় ডিএনডির অধীনে। এখানে কেন আমি দোকান পাট বসাতে যাবো? এলাকায় আসেন? কে বা কারা তথ্য কিংবা অভিযোগ দিয়েছে বলেন। ভালোভাবে তথ্য নিয়ে তারপর আমাকে বলেন।

স্পন্সরেড আর্টিকেলঃ