আজ সোমবার, ১০ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৫শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

সারা বিশ্বে বিরল

নিজস্ব প্রতিবেদক

আগ পিছ ভাবেননি। চিন্তা করেননি নিজের আর পরিবারের লোকদের কথা। করোনার মতো মহামারী ভাইরাসের সময়ে অনেক জনপ্রতিনিধি যখন চুপটি করে বাসায় বসে ‘ইয়া নফসি-ইয়া নফসি’ করেছেন তখন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছেন রোজিনা আক্তার। এ পর্যন্ত ৪৮ জন নারীকে গোসল করিয়েছেন তিনি। আম্পানের মতো ঘুর্নিঝড়ের রাতে কবরস্থান কাটাতে হয়েছে এ নারীকে।
পদ বিবেচনায় এক্কেবারে তৃণমূল পর্যায়ের একজন জনপ্রতিনিধি রোজিনা আক্তার। নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার এনায়েতনগর ইউনিয়নের ৭,৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য তিনি। এ পর্যন্ত দুই দুইবার নির্বাচিত হয়েছেন। এলাকার মানুষ কেউ ডাকেন রোজিনা মেম্বার বলে কেউবা বলেন মেম্বারনি। স্থানীয়রা জানান, এতদিন তার পরিচিতি শুধু ওয়ার্ড আর ইউনিয়নেই সীমাবদ্ধ ছিলো। করোনাকালে তা ছাড়িয়ে যায় অনেক দূর পর্যন্ত। শুরুতে কেউ মারা গেলে লাশ গোসল-দাফন তো দূরের কথা পরিবারের সদস্যরাও ছুঁয়ে দেখতো না। চিরচেনা মানুষ করোনায় আক্রান্ত না হয়েও মারা গেলে ঘন্টার পর ঘন্টা মরদেহ পরে থাকতো। সেই বিভীষিকাময় সময়ে কিছু মানুষ সাহস করে এগিয়ে আসেন। রোজিনা আক্তার তাদের মধ্যে অন্যতম। বলা চলে, সারা বাংলাদেশে তিনিই একমাত্র নারী জনপ্রতিনিধি যে এ পর্যন্ত ৪৮ জন নারীকে গোসল করিয়েছেন। জানামতে, এ রেকর্ড বিশ্বেও বিরল।
শুরুতেই তিনি ঘোষণা দেন কোন মা বোন যদি মারা যায় তাদের গোসলের দায়িত্ব নিবেন তিনি। এরপর শুরু হয় কর্মকান্ড। একের পর এক মৃত নারীকে গোসল করাতে শুরু করেন তিনি। রোজিনা আক্তার জানান, প্রতিটি গোসলে নতুন নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন হয় তার। ঢাকায় বিশালাকার বাড়ির এক ফ্ল্যাটের একজন নারী যখন করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন তখন আশপাশের কেউ এগিয়ে আসেননি। ওই বাড়ির নীচে গোসল করাতে গেলেন তখনও এলো বাঁধা। শেষতক ওই নারীর ফ্ল্যাটের ওয়াশরুমে গোসল করাতে হয়েছে। আম্পান ঝড়ের সময়ে রাত আড়াইটা পর্যন্ত ফতুল্লায় এক নারীকে গোসলে ব্যস্ত ছিলেন। আম্পানের আরেক রাতে মাসদাইর কবরস্থানে সারা রাত ছিলেন।
রোজিনা আক্তার আরেক আলোচিত করোনা যোদ্ধা মাকসুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ টিম ও তার এমকেজেএস কোভিড নাইনটিন রোজিনা আক্তার টিম এ পর্যন্ত ৪৮ নারীকে গোসলসহ ১১৮ জনকে দাফন করেছেন। রোজিনা আক্তার জানান, তার টিমের সদস্যরা কবরের মাটি খোঁড়ার কাজটি স্বেচ্ছাশ্রমে করেন। এজন্য কোন টাকা নেননা তারা।
ঝুঁকি জেনেও কেন এমন কাজে এগিয়ে এলেন এমন প্রশ্নের জবাবে রোজিনা আক্তার জানান, স্বামী মারা গেছে, সন্তানরা বিয়ে করে সংসারী হয়েছে। পরিবারে আমার দায়িত্ব যতখানি আমি মনে করি একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে মানুষের প্রতি আরও বেশী দরদ থাকা দরকার। এই বোধদয় থেকেই করোনা ভয়কে উপেক্ষা করে মানবসেবায় এগিয়ে এসেছি। কোন আক্ষেপ আছে কী- না এমন প্রশ্নের জবাবে রোজিনা আক্তার বলেন, মানুষকে ভালোবেসে মহান আল্লাহকে খুশী করতে কাজ করেছি। তাই কোন কিছু নিয়ে আক্ষেপ নেই। তবে যখন দেখি কেউ কাজ না করেও কাজের স্বীকৃতি পায়, সম্মাননা পায় তখন কিছুটা রাগ লাগে। তার মতে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী বলে তাকে অবহেলার চোখে দেখে কেউ কেউ। তবে এসবে ভ্রুক্ষেপ নেই তার। তিনি বলেন, যতদিন বেঁচে আছি ততদিন মানবসেবা করে যাবো।