# হত্যাকান্ডের জন্য সামাজিক অস্থিরতা দায়ী : এসপি জায়েদুল
সংবাদচর্চা অনলাইন, সাবিত আল হাসানঃ
নারায়ণগঞ্জে রূপগঞ্জে ব্যবসায়ীকে হত্যার পর ড্রামে ভরে সিমেন্ট ঢালাই করে গুম করে ফেলার মত ঘটনা আতঙ্কিত করে তুলছে জেলার বাসিন্দাদের। প্রশ্ন উঠেছে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে। করোনা কালে মানুষ যখন অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত এবং ঘুরে দাঁড়াবার পথ খুঁজছে সেই সময়েও থেমে নেই নৃশংসতা। অপেশাদার খুনীদের হাতে এমন জঘন্য চিত্র ভীতির সঞ্চার করেছে মানুষের মনে। মনোবিদরা বলছেন, সামাজিক অবক্ষয় ও মূল্যবোধের ঘাটতির কারনেই ঘটে চলেছে এমন নৃশংস হত্যাকান্ড।
বৃহস্পতিবার রূপগঞ্জের কুশাবো এলাকা থেকে অপহরণের ৩ মাস পর নিখোঁজ ব্যবসায়ী হেকমত আলীর লাশ উদ্ধার করে পিবিআই। খুনীরা লাশটি ড্রামের ভেতরে সিমেন্ট দিয়ে ঢালাই করে পানিতে ফেলে দেয়। প্রায় ৮৮ দিন নিখোঁজ থাকার পর ক্লুলেস মামলার রহস্য উদঘাটন করতে সক্ষম হয় পুলিশ। হত্যাকারী রফিকুল ইসলামের স্বীকারোক্তি ও দেখানো তথ্য মোতাবেল উপজেলার কুশাবো এলাকার একটি জলাশয় থেকে ড্রামটি উদ্ধার করে পুলিশ। ব্যবসায়ী হেকমত আলীর মোটর পার্টসের দোকানে ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত ছিল রফিকুল। অর্থ আত্মসাৎ করার লক্ষ্যেই এই হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়।
গত ৪ এপ্রিল হেকমত আলী তার দোকানের ম্যানেজার রফিকুল ইসলাম সবুজের জন্য পাত্রী দেখতে বের হন। এরপর থেকেই সে নিখোঁজ ছিলেন। ১৪ এপ্রিল হেকমত আলীর স্ত্রী রোকসানা বেগম বাদী হয়ে ম্যানেজার রফিকুল ইসলাম সবুজসহ ৪ জনকে আসামী করে একটি অপহরন মামলা দায়ের করেন। মামলাটির প্রথম তদন্তের দায়িত্ব পান রূপগঞ্জ থানার এসআই আমিনুল ইসলাম। তিনি মামলার রহস্য উদঘাটনে ব্যর্থ হলে ১৮ জুন পিবিআইকে মামলার তদন্তের দায়িত্ব প্রদান করা হয়।
পিবিআই মামলার আসামী রফিকুল ইসলামকে রিমান্ডে নিলে বেরিয়ে আসে হত্যার লোমহর্ষক ঘটনার। হেকমত আলীকে রফিকুল ও তার সহযোগীরা হত্যা করে। পর তার লাশ তেলের ড্রামে ঢুকিয়ে ড্রামটি সিমেন্ট দিয়ে ঢালাই করে কুশাবো এলাকার জলাশয়ে ফেলে দেয়। বৃহস্পতিবার দুপুরে রফিকুলের দেখানো মতে সেই পুকুর থেকে ঢালাই করা লাশভর্তি ড্রাম উদ্ধার করে পুলিশ। নিহতের পোষাক ও শরীরের বিভিন্ন অংশ দেখে বাদী রোকসানা ও পরিবারের সদস্যরা পরিচয় নিশ্চিত করে।
আর্থিক লেনদেন নিয়েই এই ঘটনা ঘটে তা নিশ্চিত করে হেকমত আলীর স্ত্রী রোকসানা আক্তার জানান, ব্যবসার টাকা পয়সা নিয়ে প্রায় রফিকুলের সাথে ঝামেলা হতো। আর দোকানের অর্থসম্পত্তি আত্মসাতের জন্যই সে পরিকল্পিত ভাবে হত্যা করে।
শুধু রূপগঞ্জেই নয়। গত ১ মাসে অপেশাদার খুনীদের হাতে নৃশংস হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে আরও ৩টি। এর ভেতর বন্দরে ২টি এবং ফতুল্লায় ১টি হত্যার ঘটনা ঘটে। কাকতালীয় হলেও ৩টি ঘটনাই ঘটে একই দিনে।
১২ জুন বন্দরের আমিরাবাদ এলাকায় যৌতুকের জন্য সোনিয়া আক্তার তামান্না (২০) নামের এক গৃহবধূকে নির্যাতন করে হত্যার অভিযোগ উঠে স্বামীর বিরুদ্ধে। মৃত্যুর মাত্র ৮ মাস পূর্বে প্রেমের মাধ্যমে বিয়ে হলেও সেই সুখ বেশীদিন থাকেনি। ঘটনার ২দিন পুর্বে ভুক্তভোগী তামান্না তার ভাইকে ফোন করে যৌতুকের টাকার কথা জানায়। টাকা না দিলে তার শ্বশুর বাড়ির লোকজন তাকে মেরে ফেলবে বলেও খবর দেয়। ঠিক এর ২দিন পরেই তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তবে নিহতের শ্বশুরবাড়ির লোকজন এটিকে আত্ম হত্যা বলে ধামাচাপে দেয়ার চেষ্টা চালায়।
একই দিন ফতুল্লার জামতলা এলাকায় বকেয়া ভাড়া আদায় করার জন্য ভাড়াটিয়াকে পিটিয়ে হত্যা করে নারায়ণগঞ্জ জেলা যুবলীগ নেতার বাবা শাজাহান। তার নির্মম নির্যাতনে মৃত্যু বরন করেন বৃদ্ধ ভাড়াটিয়া সিরাজুল ইসলাম (৬৫) নামে তাদের বাড়ির ভাড়াটে এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে। ওই ঘটনার পর থেকে অভিযুক্ত শাজাহান পলাতক রয়েছেন। ঘটনার ২৫ দিন পেরিয়ে গেলেও যুবলীগ নেতা শাহ ফয়েজ উল্লাহ ফয়েজের বাবাকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
নিহতের স্বজনরা জানান, বাড়ির বিদ্যুত বিল বাবদ বকেয়া সাড়ে তিন হাজার টাকা পরিশোধ না করায় মৃত্যুর আগেরদিন পিটিয়ে আহত করে বাড়ির মালিক শাহজাহান। আহত অবস্থায় তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তাররা প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেয়। রাত থেকে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে ১২ জুন বিকেলে তার মৃত্যু হয়।
সকাল ও বিকেলে দুটি মৃত্যুর খবর আসতেই রাতে বন্দরের আমিন আবাসিক এলাকায় কিশোর গ্যাং এর হামলায় মৃত্যু বরন করে স্কুল ছাত্র অমিত। পূর্ব বিরোধের জের ধরে অমিত এবং তার ২ বন্ধুর উপর হামলা চালায় কিশোর গ্যাং এর সদস্যরা। পূর্ব বিরোধের জের ধরে পরিকল্পিত ভাবে হামলা চালায় শাহপরান, শাকিল, সঞ্জয়, সোহেল, ফয়সাল, শুভ, সানী, সোহাগসহ অজ্ঞাত নামা ১৪/১৫ জনের একটি সন্ত্রাসী গ্রুপ। হামলা থেকে বাঁচতে এক পর্যায়ে একটি বাল্কহেডের উপর উঠলে সেখানেও হামলা চালিয়ে তাদের নদীতে ফেলে দেয়। সাঁতরে অমিতের ২ বন্ধু তীরে উঠতে পারলেও স্রোতে তলিয়ে যায় অমিত।
এ ব্যাপারে নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম বলেন, এ ধরনের হত্যাকান্ডের পেছনে সামাজিক অবক্ষয় ও মূল্যবোধের অভাব দায়ী। এটিকে অপেশাদার খুন আমি বলবো না। আমি বলবো এগুলো সামাজিক অস্থিরতার কারণ বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এ ধরনের হত্যাকান্ড পরিকল্পিত ভাবে খুব কমই হলে। তাছাড়া সবগুলো ঘটনাই আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ঘাতকদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে।
তবে এমন নৃশংসতা থেকে উত্তরণের উপায় কি জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা সাধারনত সম্ভব হয়না। তবে সামাজিক অবক্ষয় রোধ করা গেলে এবং মানবিক গুনাবলীর শিক্ষা থাকলে এইধরনের ঘটনা অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব। এসকল দায়িত্ব গুলো সামাজিকভাবেই গ্রহন করা প্রয়োজন। পারিবারিক শিক্ষা ও সহিষ্ণুতা অনেক অপরাধ প্রশমনে অত্যান্ত জরুরী ভূমিকা রাখতে সক্ষম।