আজ শুক্রবার, ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

ভেজাল খেয়ে নিজেদেরকে ক্রমাগত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছি!

ভেজাল খেয়ে নিজেদেরকে

রণজিৎ মোদক : জীবনধারণের জন্য খাদ্যের বিকল্প নেই। সুস্বাস্থ্য ও সমৃদ্ধিশালী জাতি গঠনে প্রয়োজন বিশুদ্ধ খাদ্য, যা দেহে পুষ্টি জোগায়, রোগ প্রতিরোধ করে ও বেঁচে থাকতে সাহায্য করে। কিন্তু উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ীদের একটি শ্রেণি অধিক মুনাফার লোভে মনুষ্যত্ব ভুলে গিয়ে প্রাকৃতিক উপাদানে মিশিয়ে চলেছে প্রচুর মাত্রায় কেমিক্যাল, ক্যালসিয়াম কারবাইড, ফরমালিন, আর্টিফিশিয়াল রং, ইউরিয়াসহ বিষাক্ত সামগ্রী। ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান দিয়ে তৈরি করছে পানীয়। আর প্রয়োজনের তাগিদে মানুষ এসব খাদ্যসামগ্রী সংগ্রহ করে ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিচ্ছে জীবন।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, ভেজাল খাদ্যের ফলে ব্রেনস্টোক, হার্ট অ্যাটাক, ক্যান্সার, কিডনি, লিভার, ফুসফুস ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নষ্ট হওয়াসহ বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও খাদ্য এবং কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য মতে, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৪৫ লাখ মানুষ খাদ্যে বিষক্রিয়ার ফলে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।

যারা খাদ্যে ভেজাল মেশায় কিংবা জনস্বাস্থ্যকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়, তারা কি এ সমাজের বাইরের কেউ? তাদের কি শিশু-স্বজন নেই? তারা কি একবারও ভেবে দেখে না, যে খাদ্যে ভেজাল মেশাচ্ছি, সাময়িক মুনাফার আশায়, তা হতে পারে আমার জন্যও সর্বনাশা!

পরিবেশবাদীদের আন্দোলন, বিএসটিআই’র অভিযান আর মাঝে মধ্যে মোবাইল কোর্টের তৎপরতা চালিয়েও খাদ্যে ভেজাল থামানো যাচ্ছে না। সর্বত্রই ভেজালের ছড়াছড়ি, দিন দিনই এর মাত্রা আকাশচুম্বী হয়ে উঠছে। ভেজাল খাদ্যপণ্যে সয়লাব হয়ে পড়ছে শহর-বন্দর-জনপদ। খোলাবাজার, হোটেল-রেস্তোরাঁ, ফাস্টফুড থেকে শুরু করে চাইনিজ রেস্টুরেন্ট, কনফেকশনারি, ক্যান্টিন এমনকি মুদি দোকান পর্যন্ত বিস্তৃতি ঘটেছে ভেজালের। রীতিমতো ভেজাল আতঙ্কে ভুগছেন মানুষজন।

বিভিন্ন নাম না জানা কেমিক্যাল আর পিয়াজের রস মিশিয়ে তৈরি করা হয় এক নম্বর খাঁটি সরিষার তেল। দুধে আটা, ময়দা, ভাতের মাড়, এরারুট মেশানো হয়। দুধের মধ্যে রাসায়নিক কেমিক্যাল ফরমালিন, হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড, বোরিক এসিড, স্যালিসাইলিক, ইউরিয়া, চিনি, লবণ, সোডিয়াম বেনজোয়েট, সোডিয়াম কার্বনেট, ফেভার, ক্ষতিকর রং, আলকাতরার রং, আটা, ময়দা, ভাতের মাড়, শ্বেতসার ও স্কিম মিল্ক পাউডার মিশ্রণ করে বাজারজাত করা হচ্ছে। মরিচের গুঁড়ায় ব্যবহার করা হয় রাসায়নিক রং ও ইটের গুড়া।

কেউ নির্ভয়ে কিছু খেতে পারছেন না। খেতে গেলেই ভয়, না জানি কি খাচ্ছি। কোথায় নেই ভেজাল! হোটেল, রেস্তোরাঁ, হাসপাতালের ক্যান্টিনে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে রান্না করা পচা ও বাসি খাবার, সাইক্লোমেট দিয়ে তৈরি ব্রেড-বিস্কুট, বিষাক্ত উপকরণে তৈরি সেমাই, নুডুলস খেতে হচ্ছে। পশুর খাবার যোগ্যও নয় এমন গমের ব্যবহার চলছে সর্বত্র। ক্ষতিকর রং দেওয়া ডিম, মেয়াদোত্তীর্ণ আইসক্রিম, বিভিন্ন রকম মিষ্টিজাত দ্রব্য, ডিডিটি দেওয়া শুঁটকি, চাল, পোড়া মবিলে ভাজা নানা সামগ্রী তুলতে হচ্ছে মুখে। ভেজাল ঘি, পামওয়েল মিশ্রিত কনডেন্সড মিল্ক, ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান দিয়ে তৈরি প্যাকেটজাত জুস, মিনারেল ওয়াটার, মরা মুরগির মাংসেই চলছে ভূরিভোজ। ঢাকায় উৎপাদিত প্রায় সব ধরনের ঘি ভেজাল এবং নকল। এতে দুধের কোনো নামগন্ধ নেই। ডালডা, বনস্পতি, সয়াবিন তেলের সঙ্গে কিছু ঘি-এর ফ্লেভার এবং এক ধরনের একটু লালচে-হলদে রং ব্যবহার করে তথাকথিত ঘি প্রস্তুত করা হয়। ফলে ঢাকা শহরের হোটেল রেস্তোরাঁগুলোর পোলাও, বিরিয়ানি বা ঘি জাতীয় সব ধরনের খাবারই ভেজালে পরিণত হচ্ছে।

ফলমূল, দুধ, মাছে ফরমালিন-কার্বাইডের বিষ, অন্যান্য খাদ্যপণ্যও ভেজালমুক্ত রাখা যায়নি। এমনকি জীবনধারণের জন্য সবচেয়ে জরুরি ‘পানি’ পর্যন্ত নিরাপদ থাকছে না। যত্রতত্র নকল কারখানা বানিয়ে পুকুর-ডোবা এবং ওয়াসার পানি বিশুদ্ধকরণ ছাড়া বোতলজাত করেই ‘বিশুদ্ধ মিনারেল পানি’ বলে বাজারে সরবরাহ করা হচ্ছে। প্লাস্টিক জার (বড় আকারের বোতল) ভরা পানি বাসা-বাড়ি, অফিস-আদালতে পৌঁছানোর মাধ্যমেও জমে ওঠেছে দূষিত পানির রমরমা ব্যবসা। সেসব বোতল-জারের পানি জীবন রক্ষার পরিবর্তে নানা অসুখ-বিসুখের সৃষ্টি করছে। কিন্তু জীবন রক্ষাকারী পানি নিয়েও ‘মরণঘাতী খেলা’ চালানো নকল কারখানাগুলো বন্ধে বিএসটিআইর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা না থাকার অভিযোগ রয়েছে। মাঝে মধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে নকল ও ভেজাল কারখানার মালিক ধরা পড়লেও জরিমানা দিয়ে আবার অবৈধ পানি কারখানা পরিচালনায় লিপ্ত হন তারা।

নিয়মিত গণমাধ্যমে ভয়ঙ্কর সব তথ্য উঠে আসছে। কিন্তু থামছে না বিষ দিয়ে মানুষ মারার এ হত্যাযজ্ঞ। ভেজাল মানুষের তৈরি বিষাক্ত খাবার খেয়ে আমরা নিজেদেরকে ক্রমাগত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছি, নতুন প্রজন্মকে মেধাহীন পঙ্গু জীবনের মতো এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাচ্ছি। সরিষার তেলে কেমিক্যাল, মুরগির খাবারে ট্যানারির বর্জ্য। সিরিঞ্জ দিয়ে তরমুজের ভেতরে প্রবেশ করানো হয় তরল পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট। ক্যালসিয়াম কার্বাইড দিয়ে পাকানো হয় কলা, মাছে ফরমালিন, অপরিপক্ব আনারস, টমেটোতে হরমোন, পচনরোধে বিষাক্ত ফরমালিন, তাজা দেখাতে মাছে রেড অক্সাইড। মাছে ও দুধে ফরমালিন, ফলমূলে কার্বাইডসহ নানা বিষাক্ত কেমিক্যাল, সবজিতে রাসায়নিক কীটনাশক, জিলাপি-চানাচুরে পোড়া মবিল-এ তালিকা অনেক দীর্ঘ।

ভেজাল কিংবা বিষাক্ত খাবার গ্রহণের ক্ষতির দিক সবারই জানা। ক্যান্সার, হাঁপানি, চর্মরোগ, ব্রঙ্কাইটিস, নিউমোনিয়া, তাৎক্ষণিক মৃত্যু, পাকস্থলীতে প্রদাহ, লিভারের সংক্রমণ, ডায়াবেটিস, কিডনি রোগ-কী না হতে পারে! ফরমালিন ও অন্যান্য কেমিক্যাল সামগ্রী সব বয়সী মানুষের জন্যই ঝুঁকিপূর্ণ। শিশুদের বুদ্ধিমত্তা দিন দিন কমছে। বয়স্ক লোকেরাও এসব রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এ ছাড়া গর্ভবতী নারীর ক্ষেত্রেও মারাত্মক ঝুঁকি রয়েছে। সন্তান প্রসবে জটিলতা, শিশুর জন্মগত ত্রুটিসহ বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম হতে পারে।

মানুষের অস্বাভাবিক মৃত্যুর প্রবণতা বেড়ে গেছে। অটিজম, প্রতিবন্ধিত্ব ও হৃদরোগ সহ নতুন নতুন রোগের প্রকোপ বেড়ে গেছে। সবাই জানে ও বোঝে কিন্তু উপায় কী? কী করে এই ভয়ঙ্কর অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব? আমাদের ভবিষ্যৎ কী? ভবিষ্যৎ কী অনাগত প্রজন্মের? আসলে কত কাজই না আমাদের করার আছে দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য, অনাগত ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। সত্যিকারের ভালো মানুষের কি আজও অভাব! সামাজিক সম্পর্কের এক অদৃশ্য জালের আবর্তে বন্দি সমাজের সব মানুষ। কিছু মানুষ বিষ মেশায়, আর অনেক মানুষ সেই বিষ খাবারের সঙ্গে খায়। শহরের পাশাপাশি গ্রামের খাবারগুলোর স্বাস্থ্যসম্মত মানও ধরে রাখা দরকার। এখনি সময় এসব থামানোর। মানুষই মানুষের খাবারে বিষ মেশায়; এর চেয়ে হতাশাজনক আর কী হতে পারে? আমাদেরকে ভাবতে হবে আসলেই আমাদের কী করা উচিত। সত্যি কি বিষ খাব, নাকি আরো কিছু করা যেতে পারে প্রতিকারমূলক, প্রতিরোধমূলক, সচেতনতামূলক, শাস্তিমূলক, কিংবা শিক্ষামূলক। পৃথিবী যত আধুনিক হচ্ছে, তার সঙ্গে সঙ্গে অত্যাধুনিক হচ্ছে ধ্বংসাত্মক, হত্যাযজ্ঞমূলক সব কর্মকান্ড। আমাদের সৃজনশীলতার বিকাশ ও ভালো কাজের স্পৃহাও অভিনব হওয়া দরকার। মানবতার কল্যাণে হাত প্রসারিত করা প্রত্যেক মানুষের আরো দরকার। পৃথিবীটা আমাদের, জীবনটা আমাদের। নিজে ভালো থাকার দায়িত্ব যেমন আমাদের একান্তই নিজের, তেমনি অন্যকে ভালো রাখাও আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।