আজ বুধবার, ২৪শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৯ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

বউয়ের প্রেমিকের চিৎকারে খুন

(সংবাদচর্চা পডকাস্ট) অডিও শুনুন

বিল্লাল আহম্মেদ:

আমি মিনজুর বাবা, মিনজু আমার মেয়ে, আমি ছেলে ধরা না, মেয়ের কাছে আসছি, আমাকে মেরো না, এমন অনেকে কথাই বলার চেষ্টা করেছিলো গণপিটুনীতে খুন হওয়া বাক প্রতিবন্ধী সিরাজ। ৬ বছরের মেয়ে মিনজুকে নিয়ে তার স্ত্রী শামসুন্নাহার পরকীয়া প্রেমিক মান্নানের হাত ধরে পালিয়ে গিয়েছিলো। এক বছর পর মেয়ের খোঁজ পেয়ে তাকে দেখতে ব্যকুল হয়ে উঠে কথা বলতে না পারা এ বাবা। মেয়ের মায়া ভরা মুখ দেখতে তার পছন্দের চুড়ি, লিপিস্টিক কিনে নিয়ে গিয়েছিলো। মেয়েকে আদর করে কোলে নিয়ে রাস্তায় বের হওয়ার পথে স্ত্রী শামসুন্নাহারের পরিবারের লোকজন ও পরকীয়া প্রেমিক মান্নানের চিৎকারে এলাকাবাসী শিশু ধরা আখ্যা দিয়ে বেধড়ক পিটিয়ে হত্যা করে সিরাজকে। এ ঘটনায় দু’টি মামলা হয়। একটি মামলায় সিরাজের স্ত্রীর পরকীয়া প্রেমিক মান্নানকে প্রধান আসামী করা হলেও গ্রেপ্তার হয়নি সে। বর্তমান মামলার তদন্ত করছেন সিআইডি পুলিশ।

গত বছর আগে এইদিন সিদ্ধিরগঞ্জের মিজমিজি প‚র্বপাড়া আল-আমিন নগর এলাকায় ছেলেধরা সন্দেহে সিরাজ গণপিটুনির স্বীকার হয়ে মারা যায়। প্রথমদিকে তার পরিচয় পাওয়া যাচ্ছিলো না। পরে পুলিশ ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে পরিচয় উদঘাটন করে। ভোলা জেলার লালমোহন থানার মুগিয়া বাজার এলাকায় আ. রশিদ মন্ডলের ৭ সন্তানের মধ্যে সিরাজ সবার বড়। জন্ম থেকেই সে বাক প্রতিবন্ধি অর্থাৎ কথা বলতে পারে না। তাই বলে সংসারের কারও উপর ভরসা না করে নিজেই রোজগার করতেন। কাজ করতেন রাজ মিস্ত্রির সহযোগী হিসেবে। ভোলার সিরাজ ভাড়া থাকতেন নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার সিদ্ধিরগঞ্জের সাইলো এলাকার ঠিকাদার মোহর চানের বাড়িতে।

পুলিশের সূত্রে জানা গেছে, বাক প্রতিবন্ধী সিরাজকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় এসআই সাখাওয়াত হোসেন বাদী হয়ে ৭০ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাত দেড় থেকে দুইশত জনকে আসামি করে একটি মামলা করেন। পরে আরও একটি মামলা করেন নিহতের ছোট ভাই আলম।

ছেলে হত্যার বিচার নিয়ে হতাশায় পড়ে গতকাল সিরাজের বাবা আ.রশিদ মন্ডল বলেন, তার ছেলে কথা বলতে না পারলেও অনেক বুদ্ধিমান ছিলো। সিরাজ যে টাকা কাজ করতো সে টাকা থেকে তাকেও দিতো। বড় ছেলে হারিয়ে বস্তি ঘরে বাস করা এ বাবা জানান, অনেক কষ্টে দিন কাটছে আমাদের। গতবছর এই দিন সিরাজ তার মেয়েকে দেখতে গিয়েছিলো। মেয়েকে কোলে নিয়ে বাড়ির বাইরে এসেছিলো। এ সময় সিরাজের স্ত্রীর’র পরিবারের লোকজন ও তার পরকীয়া প্রেমিক মান্নান চিৎকার করে বলে উঠেছিলো ছেলে ধরা, ছেলে ধরা। এই চিৎকার শুনো এলাকার লোজন এসে সিরাজ কে পিটিয়ে হত্যা করে। ওই সময় মেয়েটা পাশেই কাঁদছিলো। তিনি বলেন, অনেকের নামে মামলা হয়েছে কিন্তু পুলিশ তদন্তকালে মামলার কোন অগ্রগতি পাওয়া যায়নি। ছেলে হারিয়ে এই বাবার এখন একটাই আক্ষেপ বিচার দেখে মরতে পারবে কিনা না।

পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, এক বছর পূর্বে বিদ্যুৎ মিস্ত্রী আ. মান্নান ওরফে সোহেলের সাথে মেয়ে মিনজুকে নিয়ে পালিয়ে যায় সিরাজের স্ত্রী শামসুন্নাহার। সেই থেকে মেয়ের মুখ দেখা হয়নি সিরাজের। কত জায়গায় খোঁজ করেছেন তার ইয়ত্তা নেই। কাজ শেষে কখনও কাজে নাগা দিয়ে মেয়ের খোঁজে দিন পার করেছেন সিরাজ। শেষ পর্যন্ত খবর পেয়ে ওই দিন প্রতিবেশীর কাছ থেকে ১শ টাকা ধার নিয়ে মেয়ের সাজ সজ্জার জিনিস কিনে মেয়ের কাছে যান সিরাজ। মেয়ের হাতে যখন চুড়ি লিপিস্টিক তুলে দিচ্ছিলেন তখন তা দেখে ফেলে মান্নানসহ তার স্ত্রীর পরিবারের লোকজন। তারা সিরাজকে চলে যেতে বলেন। এতদিন পর মেয়েকে কাছে পেয়ে ছেড়ে আসতে মন চাইছিলো না তার।
মেয়েকে কোলে নিয়ে রাস্তার পাশে দোকানে যাওয়ার সময়ে ছেলে ধরা বলে চিৎকার দেয় তারই এক সময়কার স্ত্রী, স্ত্রীর ছোট বোন ও স্ত্রীর পরকীয়া প্রেমিক মান্নান। এসময় স্থানীয়রা আর কিছু যাচাই না করে সিরাজকে পেটানো শুরু করে। বোবা সিরাজ ইশারা ইঙ্গিতে সবাইকে বুঝানোর চেষ্টা করে যে ছেলে ধরা না। মিনজু তার আদরের কন্যা। তার রক্তই ওই শিশুর গায়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নিজের সন্তানকেই সে কোলে নিয়েছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। সেদিন যেন ওই মানুষরূপি হাত-পা ওয়ালা প্রাণীগুলো জন্তুতে রূপ নেয়। তারা বোবা সিরাজকে অমানুষিক নির্যাতন করে। এক পর্যায়ে সিরাজের দেহ নিথর হয়ে যায়। আর তখন পাশে দাঁড়িয়ে বাবাকে মারার দৃশ্য দেখে কান্না করছিলো ছোট্ট মিনজু।
সিরাজ হত্যার খবর পেয়ে সিদ্ধিরগঞ্জের সাইলোগেট এলাকায় কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে এলাকাবাসী। সিরাজ এলাকায় অনেকের কাছে প্রিয় মানুষ ছিলো।

নিহত সিরাজের ভাই ছোট আলম গতকাল রোববার এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ভাইকে পিটিয়ে হত্যার খবর শোনে থানায় গিয়েছিলাম। পুলিশ কে বলেছিলাম মামলা করবো কিন্তু পুলিশ বলেছিলো বেশি কথা বললে হাজতে ঢুকিয়ে দিবে। পরে পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা করেছে। সেই মামলায় ঘটনার সাথে জড়িতের বাদ দিয়ে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের জড়ানো হয়েছে। এতে করে প্রকৃত অপরাধীরা আড়াল হয়ে গেছে। আলম বলেন, পুলিশের উপর ভরসা হয়নি তাই বাধ্য হয়ে তিনি নিজেই নারায়ণগঞ্জের আদালতে আরেকটি মামলা করেছেন। তখন দুটি মামলারই তদন্তের দায়িত্বে ছিলেন এসআই সফিক। এই পুলিশ সদস্য বেশ কয়েক বার তাকে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন তবে বার বার এক ঘটনা নিয়েই আলোচনা করেছেন তিনি। কিন্ত আসামীদের গ্রেপ্তারের জন্য কোন পদক্ষেপ নেননি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিবি পুলিশের এসআই সফিক জানান, দুইটি মামলাই বর্তমানে সিআইডির তদন্তাধীন।

এ প্রসঙ্গে নারায়ণগঞ্জ সিআইডির প্রধান এএসপি হারুন অর-রশীদ দৈনিক সংবাদচর্চাকে জানান, সিদ্ধিরগঞ্জের সিরাজ হত্যা মামলা বর্তমানে সিআইডির তদন্তে রয়েছে। মামলাটি নিয়ে সিআইডি গভীর তদন্ত করছে। যাতে করে প্রকৃত আসামীদের আইনের আওতায় আনা যায়। নারায়ণগঞ্জ সিআইডি পুলিশ মামলাটি বিশেষ ভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে বলে জানান সিআইডির এই কর্তকর্তা।