আজ মঙ্গলবার, ৩রা আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১৭ই জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

কেমন আছে আমাদের উচ্চ শিক্ষা

কেমন আছে আমাদের উচ্চ শিক্ষা

কেমন আছে আমাদের উচ্চ শিক্ষা

নতুন বছরের শুরুতেই সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ঘটে-শিক্ষা ও যে কোন গণ আন্দোলনের অন্যতম পীঠস্থান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সাধারণ ছাত্রদের আন্দোলন দমনের জন্য প্রশাসন ছাত্রলীগের শরনাপন্ন হন।

ছাত্রলীগ নির্যাতননিপীড়ন করে আন্দোলন দমানোর চেষ্টা করে। যা বিশ্ব বিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক পরিবশের উপর মারাত্মক ও নির্মম আঘাত। মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয়ার চেষ্টা করে। ভিন্ন মত দমনের এই কৌশলী অক্টোপাস গলা চেপে ধরে সকল গণতান্ত্রিক চেতনার।

গত বছরের ১৬ই ফেব্রুয়ারী ঢাকার সরকারী ¯ সাত কলেজকে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অধিভূক্ত করার পর থেকেই আন্দোলনের সূত্রপাত হয় । উচ্চ শিক্ষা উচ্চতর দক্ষতা বৃদ্ধি করে। জ্ঞান চর্চার অন্যতম পীঠস্থানবিশ^বিদ্যালয়। সুজলা সুফলা বাংলায় বিশ্ব বিদ্যালয়ের ছাত্ররা দেশের স্বাধীনতা,

স্বার্বভোমত্ত ও শিক্ষার অধিকার আদায়ে লড়াকু ভূমিকা রেখেছে। শিক্ষার সংকটসবার। সংকট সমাধানে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। সেই জন্য সবগুলো গণ-আন্দোলনে ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক-পেশাজীবি-কর্মজীবি
হাতে হাত রেখে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছে।

অধিকার ছিনিয়ে এনেছে। এই সত্য প্রতিষ্ঠা করেছে-অধিকার ভিক্ষা করে নয় লড়াই করে আদায় করে নিতে হয়। তাই এই বাংলার ইতিহাস লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস। মর্যাদা, মনুষ্যত্ব ও বিবেক নিয়ে শির উচু করে বাঁচার ইতিহাস। দেশের স্বাধীনতার বয়স যত বাড়ছে সাথে সাথে মর্যাদা, মনুষ্যত্ব ও বিবেকের শির উচু না হয়ে নিচু হয়ে যাচ্ছে। বিক্রি হয়ে যাচ্ছে মুক্তির লড়াইয়ের সংগ্রামী
ইতিহাস।

লড়াই করে নয়, তোষামোদি করে, চাটুকারীতা করে, নতজানু হয়েবেঁচে থাকার প্রতিযোগিতা চলছে। প্রাইমারি থেকে উচ্চ শিক্ষা সর্বত্রই আত্মকেন্দ্রিক হওয়ার মনভাব জাগিয়ে তুলছে। মানুষে মানুষে ঐক্য ও সমাজের প্রতি দায়ব্ধতা তৈরি করে শিক্ষা। তাই শিক্ষাকে নানাভাবে বিভক্ত করে মানুষ থেকে মানুষকে, সমাজ থেকে মানুষকে ও অর্থনীতি থেকে সমাজকে বিভক্ত করে ফেলেছে। ফলে মানুষের প্রতি মানুষের দায়বোধ, সমাজের প্রতি মানুষের দায়বদ্ধতা ও সমাজ পরিচালনায় অর্থনীতির প্রভাব বুঝার ক্ষমতা হারিয়ে
গেছে।

শাসকদের দীর্ঘ দিনের ষড়যন্ত্রের ফলাফলের প্রভাব ছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের অধিভূক্তি বাতিলের আন্দোলনে। এটা যে একটা শিক্ষা ব্যবস্থার সামগ্রীক সংকট তা আড়ালে চলে যায়। সংকটের বিরুদ্ধে হাতে হাত রেখে না দাঁড়িয়ে বিশ^বিদ্যায়ের শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কলেজের শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যায়। শাসক পক্ষও তৃপ্তির ঢেকুর তোলে।

শাসকদের শিক্ষা সংকোচন নীতির অংশ হিসেবে ১৯৯২ সালে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মধ্য দিয়ে জাতীয় বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। পাবলিক বিশ্ব বিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ¯সাত কলেজগুলোকে জাতীয় বিশ্ব বিদ্যালয়ের অধিভূক্ত করে পরিচালনার ঘোষনা আসে।

সাথে সাথে প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে তীব্র প্রতিবাদ করা হয়। বলা হয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠানের কোন ধারনাই হতে পারে না। এখানে ছাত্রদের সাথে বিশ্ব বিদ্যালয় প্রশাসনের কোন যুক্ততা নাই। শুধু মাত্র বোর্ডের মত করে পরীক্ষা নিবে আর সাটির্ফিকেট প্রদান করবে। যা উচ্চ শিক্ষার মর্মবস্তুর সাথে বিরোধাত্বক। সংকট নিরসন করতে জাতীয় বিশ^বিদ্যালয় সম্পূর্ণরুপে ব্যর্থহয়। সেশন জট, ফলাফল বিপর্যয়, ক্লাস, পরীক্ষা নিয়ে দুর্বিষহ অবস্থা আরো বেড়ে যায়। অনিশ্চিত হয়ে পড়ে শিক্ষা জীবন।

জাতীয় বিশ্ব বিদ্যালয়ের নামের সাথে ‘সেশনজট আতংক’ ওতোপ্রতোভাবে যুক্ত হয়ে পড়ে। এই সংকট থেকে নিরসনের একমাত্র উপায় জেলায় জেলায় বিশ্ব বিদ্যালয় নির্মান করা। আশু সমাধান হিসেবে দেশের ঐতিহ্যবাহি ১৯টি কলেজকে বিশ্ব বিদ্যালয় করার দাবি উন্থাপিত হয়। ছাত্রদের যৌক্তিক আন্দোলনকে প্রতিহত করতে ২০১৪ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কলেজগুলোকে পুনরায় পাবলিক বিশ্ব বিদ্যালয়ের অধিভুক্তির ঘোষনা দেন।

পরীক্ষামূলকভাবে ঢাকার সরকারী সাত কলেজকে অধিভূক্ত করা হয়। সংকট নিরসন করতে ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয় ব্যর্থতার পরিচয় দেন। বাধ্য হয়ে শিক্ষার্থীরা সংকট সমাধানের আশায় রাস্তায় নামে। সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের উপর পুলিশি হামলায় চিরদিনের জন্য অন্ধ হয়ে যায় সিদ্দিকুর রহমান নামের একজন শিক্ষার্থী। উচ্চ শিক্ষার অধিকার আদায় এবং সংকট নিরসনের দাবি
করতে এসে পুলিশি হামলায় অন্ধ হয়ে যাওয়ার ঘটনা ইতিহাসে বিরল।

সিদ্দিকুর অন্ধ হয়ে জাতির চোখ খুলে দিলো। শিক্ষা ব্যবস্থার গলদ সবার সামনে আবারও উন্মোচিত হলো। ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অধিভূক্তি বাতিলের দাবিতে গড়ে উঠা আন্দোলনে যুক্তি দাঁড় করিয়েছে সবাই (বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীও অধিভূক্ত

কলেজের শিক্ষার্থী) একই পরিচয়ে দাঁড়াতে পারবে না। এটা তাদের মানসম্মানে বাঁধে।। কিন্তু তারা একবারও ভাবলো না এটা যে একটা সামগ্রিক ব্যবস্থার সংকট। এটার দায় শাসকের, শাসকের শিক্ষা সম্পর্কীত দৃষ্টিভঙ্গির। ভাবতে না পারার মধ্য দিয়ে, বর্তমান সময়ের উচ্চ শিক্ষা যে মূল্যবোধ ও যুক্তিবাদী মনন তৈরি করতে পুরো পুরি অক্ষম তা স্পষ্ট হয়েছে। শিক্ষার মানের এই অধঃপতন সকল শিক্ষানুরাগী মহলকে পীড়া দেয়।

শিক্ষায় প্রতি বছর বরাদ্ধ কমা ও গবেষনায় বরাদ্ধ না থাকায় জ্ঞান চর্চা যে বিঘ্নিত হয় তা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। প্রশাসনের মদদে আন্দোলন দমানোর জন্য সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের সন্ত্রাসী তান্ডব বিশ্ব বিদ্যালয়ের স্বায়ত্বশাসন যে পুরোপুরি শাসকদলের অনুগত তা দৃশ্যমান হয়।

শাসক যেমন চায় বিশ্ব বিদ্যালয় তেমনি পরিচালিত হয়। স্বায়ত্বশাসন শুধুকথার কথা। উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষক নির্বাচন হয়, তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণীর কর্মকর্তা কর্মচারি নির্বাচন হয় কিন্তু যে ছাত্রদের জন্য বিশ^বিদ্যালয় তাদের ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ হয়ে আছে। ছাত্রদের সামনে ছাত্র সংসদগুলো হয়ে গেছে ক্যাফেটেরিয়া। ডাকসু কি? ছাত্রদের প্রশ্ন করতে উত্তর আসে একটা
ক্যাফেটেরিয়া। বিশ্ব বিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তুলতে ছাত্র সংসদের ভূমিকা আজ রুপকথার গল্পের মত মনে হয়।

মত প্রকাশের স্বাধীনতাও ক্যাম্পাসগুলোতে নেই বললেই চলে। ভিন্নমত কেউ সইতে পারে না। মতের ভিন্নতার জন্য, ভিন্ন রাজনীতিক সংগঠন করে বলে ছাত্ররা নানা ভাবে হলগুলোতে নিপিড়নের শিকার হয়। সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠনের নেতাদের কাছে নতজানু ও অনুগত হতে হয়। হলে সিট পাওয়া অধিকার নয়, বড় ভাইদের করুণা।

মিথ্যা হলেও বড় ভাইদের কথাই সঠিক বলে চাটুকারিতা করতে পারলে ভাইরা তুষ্ট হয়। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়েরশিক্ষার্থীদের সাত কলেজ অধিভূক্তি বাতিলের আন্দোলন দমনের নমুনা স্পষ্ট করলো মত প্রকাশের স্বাধীনতা পুরোপুরি স্তব্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তর্ক-
বির্তকের মধ্য দিয়ে মতের সঠিকতা-বেঠিকতা নির্ণিত হয়।

সেই পথ রুদ্ধ। টি,এস,সি গুলোতে বিভিন্ন কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে সভা-সেমিনার, র‌্যাগ ডে পালন করা হয়। ছাত্র-শিক্ষকদের মতের আদান প্রদানে টি,এস,সির ভূমিকা চোখে পড়ে না। সবগুলো বিশ্ব বিদ্যালয়ে কর্পোরেট ব্যবসার রমরমা আয়োজন নিশ্চিত হয়েছে। যে কোন মত বা চিন্তা আসতেই পারে তাই বলে তাকে দমনের

চেষ্টা গণতান্ত্রিক পরিবেশকে হত্যা করার শামিল। বরাবরই শাসকরা ভিন্ন মতকে দমাতে চেয়েছে। স্বাধীন দেশেও তার ধারাবাহিকতা বিদ্যমান। শিক্ষার সার্বিক সংকট নিরসন এবং শাসকেদের শিক্ষা সম্পর্কীত দৃষ্টিভঙ্গি উন্মোচন আজ সময়ের দাবি। সময়ের এই দাবি পূরণে পূর্বের মত ছাত্রদের ভূমিকা এবং সর্বস্তরের মানুষের সহযোগিতা আবশ্যক।

                           তীব্র তরু

                        ছাত্র সংগঠক