আজ রবিবার, ২১শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৬ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

কদর বাড়ছে পাটজাত পণ্যের বড় হচ্ছে বাজার

শিল্প প্রতিবেদক:

পাটের তৈরী হরেক রকম পন্য ক্রেতাদের আকৃষ্ট করছে। ধীরে ধীরে বাড়ছে পাটজাত পন্যের বাজার। এ খাত থেকে সরকার কোটি কোটি টাকা প্রতিবছর রাজস্ব আদায় করছে। পাটজাত পন্যের বিক্রেতা, মালিক, সংগঠন ও পৃষ্ঠপোষকগন বাজার বৃদ্ধির সাফল্যে ধন্যবাদ জানিয়েছেন পাট ও বস্ত্র মন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম দস্তগীর গাজী (বীর প্রতীকের) যুগোপযোগী সিদ্ধান্তকে।

পাটজাত পন্য সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করছে মহিলা ক্রেতাদেরকে। গতকাল নারায়ণগঞ্জের একটি অভিজাত পাটজাত পন্যের দোকানের শোভা নামের এক মহিলাকে পাটজাত পন্য কিনতে দেখা গেছে। তিনি জানান, পাটের ঐতিহ্য আমাদের রক্তের সাথে মিশে আছে। এ সকল পন্য গুনে ও মানে অন্য সব ধরনের পণ্যের চাইতে বেশি টেকসই। পাট পন্যের বাজার আরও সহজলভ্য হওয়া প্রয়োজন। প্রতিটি পাড়া মহল্লায় একটি করে পাটজাত পন্যের দোকান থাকা দরকার। যাতে করে ক্রেতারা হাতের কাছে এ ঐতিহ্যবাহী শিল্পের পণ্য কিনতে পারেন।

জানা গেছে, পাট শিল্প ব্রিটিশ শাসনামলে বাংলায় এবং পাকিস্তানি আমলে পূর্ব বাংলায় (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে) পাটজাত দ্রব্য সামগ্রী উৎপাদন ছিল একক বৃহত্তম শিল্প। স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জাতীয় জিডিপি এবং কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে এই শিল্পের অবদান হ্রাস পায় (অনপেক্ষ এবং আপেক্ষিক অর্থে)। কিন্তু তারপরও এই শিল্প দেশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।

পাট থেকে কার্পেট উৎপাদন

১৮৮৫ সালে জর্জ অকল্যান্ড একজন বাঙালি অংশীদার (শ্যামসুন্দর সেন) নিয়ে কলকাতার হুগলি নদীর তীরবর্তী রিশড়া নামক স্থানে প্রথম পাটকল স্থাপন করেন। প্রাচীনকাল থেকেই বাংলায় পাট উৎপাদিত হত। কিন্তু ১৮৮৫ সালের পূর্বে স্থানীয় তন্তুবায় শ্রেণির দরিদ্র জনগণের জন্য মোটা বস্ত্র তৈরি করতো। পাটভিত্তিক শিল্প স্থাপনের অনুপ্রেরণা আসে স্কটল্যান্ডের ডান্ডি থেকে। নেপোলিয়ানের যুদ্ধের সময় ঘন ঘন নৌ-অবরোধের ফলে রাশিয়ার শন জাতীয় গাছের কারখানাগুলি বিকল্প হিসেবে পাট ব্যবহারের সম্ভাবনা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করে। ১৮৩২ সালে বেলফোর ও মেলভিলের কারখানাগুলি কলকাতার বিভিন্ন স্থান থেকে কাঁচাপাট আমদানি করে এবং এই কাঁচাপাটের সঙ্গে তিমির তেল ও পানি মিশিয়ে পাট নরম করে নেয়। ১৯৩৮ সালে এই নতুন প্রক্রিয়া প্রয়োগ করা হয়। এ সময় ডান্ডির মিলগুলি জাভা থেকে আমদানি করা চিনির জন্য ডাচ সরকারের নিকট থেকে বিপুল পরিমাণ ব্যাগ তৈরির কার্যাদেশ পায়। ডাচ সরকার এই তৈরিকৃত পাটের ব্যাগ গ্রহণ করে এবং এই মোটা ক্যানভাস বিশেষ সামগ্রী হিসেবে স্থায়ীরূপ লাভ করে। এই ব্যবস্থা কাপড় ও ব্যাগ উৎপাদনে পাটের ব্যবহার শুরুতে সহায়তা করে। ফলে পাটশিল্পে নতুন প্রেরণার সূচনা হয়। অবশ্য ক্রিমিয়ার যুদ্ধই (১৮৫৪-৫৬) প্রকৃতপক্ষে পাটশিল্পকে একটি শক্ত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করে। বিশ্ববাণিজ্য প্রতি বছর শতকরা ৫ ভাগ বৃদ্ধি পেতে শুরু করলে ঔপনিবেশিক অঞ্চল থেকে বিকল্প আঁশ সহজলভ্য হলে ডান্ডির কারখানাগুলি আর অলসভাবে বসে থাকে নি। আমেরিকার গৃহযুদ্ধ (১৮৬১-৬৫) এই বিকল্প প্রক্রিয়ায় আরো উৎসাহ প্রদান করে। এই যুদ্ধের ফলে আমেরিকা থেকে তুলার সরবরাহ অনেকাংশেই সীমিত হয়ে পড়ে। কারণ পরিখা যুদ্ধকালে ইউনিয়ন এবং কনফেডারেসির সৈন্যদের জন্য মোটা বস্তা ও বালির বস্তা, পাটের আঁশ দিয়ে পাকানো সুতা, দড়ি সরবরাহ বিঘিœত হয় এবং মূল্যও বৃদ্ধি পায়। ফলে ডান্ডির টেকসই বিকল্প আঁশের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। উভয় ক্ষেত্রেই এই শিল্প নতুন ব্যবহারকারীর সন্ধান পায় যারা আর কখনো শন বা তুলার ব্যবহারে ফিরে যায় নি। এই স্থায়ী পরিবর্তনের প্রধান কারণ ছিল তুলনামূলকভাবে পাটের সস্তা দামের সুবিধা।

এভাবে প্রথম যখন বাংলায় পাটকল স্থাপিত হয়। তখন ডান্ডির মিলগুলি সুপ্রতিষ্ঠিত এবং তাদের পণ্যের জন্য নতুন বাজারের সন্ধান করছিল। কিন্তু কলকাতার মিলগুলি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দ্রæত অগ্রগতি সাধন করে। ১৮৮২ সালে মিলের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ১৮ টিতে উন্নীত হয় এবং ১৯০১ সালে ৩ লক্ষ ১৫ হাজার সুতা কাটার টাকু, ১৫ হাজার তাঁত, ১ লক্ষ ১০ হাজার শ্রমিক এবং ৪ কোটি ১০ লক্ষ টাকার পরিশোধিত মূলধন নিয়ে মিলের সংখ্যা ৩৫-এ উন্নীত হয়। বাংলাদেশের উৎপাদিত ৮৫% পাটজাত দ্রব্য অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করা হয়। এভাবে উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে পাট শিল্প উপমহাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শিল্পে পরিণত হয় এবং কলকাতা বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাটজাত দ্রব্য উৎপাদন কেন্দ্রে পরিণত হয়।

ঘটনাক্রমে সব পাটকল রাজধানী শহরের আশেপাশে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং বিদেশি পুঁজিপতিদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। তবে বাঙালিরা এই শিল্পের সঙ্গে আদৌ জড়িত ছিল না, শুধুমাত্র একজন প্রথম পাটকল স্থাপনের অংশীদার ছিলেন। পাটজাত দ্রব্য উৎপাদনের কারখানা কলকাতা কেন্দ্রিক গড়ে উঠার পিছনে কিছু সহায়ক উপাদান কাজ করে। এগুলি ছিল কম শ্রম-মূল্য (প্রায় ১/৩ ভাগ), কাঁচাপাটের সহজলভ্যতা, দীর্ঘ সময় কাজ করানো এবং অধিকতর মানসম্পন্ন পণ্য উৎপাদন।

বিশ শতকের প্রথম তিন দশক থেকে পাটশিল্পের অভাবিত উন্নতি সাধিত হয়। ১৯০৩-০৪ সালে পাটকলের সংখ্যা ছিল ৩৮টি, কিন্তু ১৯২৯-৩০ সালে সেই সংখ্যা বেড়ে ৯৮টিতে উন্নীত হয়। উৎপাদনের দিক থেকে স্থাপিত তাঁতের সংখ্যা ৩ গুণ বেড়ে যায় এবং এই শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকের সংখ্যা ১,২৩,৬৮৯ থেকে ৩,৪৩,২৫৭ জনে উন্নীত হয়। এর মূল কারণ ছিল বিনিয়োগকৃত অর্থ থেকে উচ্চ মুনাফা। বিশ্ববাজারে পাটজাত দ্রব্য সামগ্রীর চাহিদার কারণেই এই অবস্থার সৃষ্টি হয়।

নারায়ণগঞ্জে পাটের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে করনীয় সম্পর্কে জাতীয় ভেজাল প্রতিরোধ ফাউন্ডেশনের সভাপতি সুলতান মাহমুদ বলেন, পাটচাষীদের পর্যাপ্ত সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। উৎপাদিত পাটের ভাল দাম দিতে হবে। পাট পন্যের বিশাল বাজার তৈরী করতে হবে। দেশের বাইরে রপ্তানীতে আরো জোর দিতে হবে। সাধারন জনগনকে পাটজাত পন্য ব্যবহারের উদ্বুদ্ধ করতে হবে।