আজ রবিবার, ৯ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৪শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

সাত খুনের রায় দ্রুত কার্যকরের দাবি

সংবাদচর্চা রিপোর্ট :
নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুন ঘটনার আজ দশ বছর। দীর্ঘ এ সময়ে আদালতের রায় সাড়ে পাঁচ বছর ধরে ঝুলে আছে আপিলে। এদিকে, রায় কার্যকরে ধীরগতি নিহতের পরিবারে বাড়াচ্ছে ভয়, ছড়াচ্ছে আতঙ্কÑ দাবি স্বজনদের। আপিলে বিভাগে রায় বহাল রেখে অবিলম্বে তা কার্যকরের দাবি করেছেন স্বজনেরাসহ সাধারণ মানুষ।
রওজার বয়স এখন ৯ বছর ১০ মাস। বাবা জাহাঙ্গীর আলমকে দেখেনি সে। কেউ বাবার কথা বললে বাঁধাই করা বাবার একটি ছবি বুকে জড়িয়ে ধরে সে। ছবিতে চুমু দেয়, আদর করে। ছবির বাবার সঙ্গেই কথা বলে ফুটফুটে এই ছোট্ট শিশুটি।
জাহাঙ্গীর আলম গাড়ি চালাতেন। ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল তিনিসহ সাতজন ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড থেকে অপহৃত হন। তিন দিন পর শীতলক্ষ্যায় সাতজনেরই লাশ ভেসে ওঠে। ‘নারায়ণগঞ্জের সাতখুন’ হিসেবে ঘটনাটি সারা দেশে ব্যপক আলোচিত হয়।
ওই ঘটনায় নিহত ব্যক্তিরা হলেন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন সরকার, যুবলীগ নেতা মনিরুজ্জামান স্বপন, স্বপনের গাড়ির চালক জাহাঙ্গীর আলম, নজরুলের সহযোগী তাজুল ইসলাম, নজরুলের বন্ধু সিরাজুল ইসলাম লিটন ও চন্দন সরকারের গাড়িচালক ইব্রাহিম হোসেন।
নজরুল ইসমলাম ছিলেন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ১ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র। তিনি ছিলেন যুবলীগ নেতা। তার সঙ্গে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ছিল পাশর্^বর্তী ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নূর হোসেনের। তবে, নেহাতই ভদ্রলোক ছিলেন আইনজীবী চন্দন সরকার। বইপ্রেমি চন্দন সরকার কোনো রাজনীতি করতেন না। কারো সঙ্গে ছিল না কোনো রকম বিবাদ। তারপরও লোমহর্ষক ওই ঘটনায় তিনিও অপহরণের শিকার হয়েছিলেন। কেবলমাত্র নজরুল ইসলাম, স্বপনদেরকে অপহরণ করার দৃশ্য দেখে ফেলায়।
এ ঘটনায় নিহত নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি ও নিহত আইনজীবী চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার বাদী হয়ে ফতুল্লা মডেল থানায় পৃথক দুটি হত্যা মামলা করেন। আলোচিত এ হত্যা মামলায় ২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালত সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন, র‌্যাব-১১ চাকরিচ্যুত সাবেক অধিনায়ক লে. কর্নেল তারেক সাঈদ, মেজর আরিফ হোসেন ও লে. কমান্ডার এম এম রানাসহ ২৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা প্রদান করেন আদালত। পরবর্তী সময়ে ২০১৮ সালে ২২ আগস্ট উচ্চ আদালত ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ বহাল রেখে অন্য আসামিদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা বহাল রাখেন।
সাত খুনের একটি মামলার বাদী নিহত প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি বলেন, ‘দশ বছরেও হত্যাকাণ্ডের বিচার শেষ হয়নি। এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় হাইকোর্ট নিম্ন আদালতের রায় বহাল রাখার পর আসামীপক্ষ সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেছেন। বর্তমানে মামলাটি আপিল শুনানির অপেক্ষায় আছে। আমরা চাই দ্রুত রায় কার্যকর করা হোক।’
মামলাটি গত ৫ বছর যাবৎ আটকে আছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে। দীর্ঘ সময় ধরে আটকে থাকলেও এখনো শুনানি শুরু হয়নি বলে জানিয়েছেন বাদিপক্ষের আইনজীবী সাখাওয়াত হোসেন খান।
দৈনিক সংবাদচর্চাকে তিনি বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জের বিচারিক আদালতে মামলাটির রায় হয়েছে। রায় হওয়ার পর আসামীরা হাইকোর্টে আপিল করে যা নিষ্পিত্তি হয়েছে। আপিল নিষ্পিত্তিতে হাইকোর্ট জর্জ কোটের রায় কিছু সংশোধন করে কিছু অপরাধীর রায় বহাল রেখে এবং কিছুদের সাজা কমিয়েছে। এরপর অপরাধীরা আপিল ডিভিশনে আবেদন করে। যা বর্তমানে শুনানির অপেক্ষায় আছে।’
সাত খুনের ঘটনাক্রম
২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল দুপুরে নারায়ণগঞ্জ আদালতে একটি মামলায় হাজিরা দিয়ে আসেন তৎকালীন প্যানেল মেয়র ও ২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, তার বন্ধু সিরাজুল ইসলাম লিটন, সহযোগী মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, স্বপনের গাড়ি চালক জাহাঙ্গীরকে। হাজিরা শেষে ঢাকার ফেরার পথে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের ফতুল্লার লামাপাড়া থেকে তাদের অপহরণ করা হয়। ওই ঘটনা দেখে ফেলায় নজরুলের গাড়ির পেছনে থাকা আইনজীবী চন্দন সরকার ও তার গাড়িচালক ইব্রাহিমও অপহৃত হন।
তিন দিন পর ৩০ এপ্রিল শীতলক্ষ্যা নদীতে মেলে ছয়জনের লাশ। ১ মে নজরুলের বন্ধু সিরাজুল ইসলাম লিটনের লাশও নদীতে ভেসে ওঠে। লাশ উদ্ধারের পর নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি এবং চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পাল দুটি মামলা করেন, যার তদন্ত চলে একসঙ্গে।
দুই মামলার তদন্ত শেষে নারায়ণগঞ্জের সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন ও র‌্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ ৩৫ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেন তদন্ত কর্মকর্তা মামুনুর রশিদ মণ্ডল।
আসামিদের মধ্যে র‌্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ ১৭ জন এবং নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের তৎকালীন ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নূর হোসেনের পাঁচ সহযোগীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ঘটনার ১৭ মাস পর মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনকে ভারত থেকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়।
আসামিদের মধ্যে ২১ জন ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তদন্ত চলাকালে নূর হোসেন ভারতে থাকায় তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের সুযোগ পায়নি পুলিশ।
গ্রেপ্তার র‌্যাব সদস্য আদালতে যে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন, তাতে হত্যাকাণ্ডের ভয়ঙ্কর বিবরণ উঠে আসে। তারা জানান, অপহরণের পর সাতজনকে চেতনানাশক ইনজেকশন দিয়ে অচেতন করা হয়। পরে মুখে পলিথিন পেঁচিয়ে হত্যা করা হয় শ্বাস রোধ করে। লাশগুলো শীতলক্ষ্যায় ফেলে দেওয়ার সময় ডুবে যাওয়া নিশ্চিত করতে বেঁধে দেওয়া হয় ইটের বস্তা। আর লাশ যাতে ফুলে না ওঠে সেজন্য চিরে ফেলা হয় লাশ।
জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেন ২০১৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে এ মামলার আসামিদের বিচার শুরু করেন।