স্টাফ রিপোর্টার :
নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য একেএম শামীম ওসমান। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ ও এমপিদের একজন। যাকে এক নামে চিনে সারাদেশ। যার পরিচিতি রয়েছে দেশের বাইরে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও। কিন্তু এত প্রভাবশালী নেতা হওয়া সত্ত্বেও তার সংসদীয় এলাকায় জমির অভাবে দীর্ঘদিন যাবৎ আটকে আছে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প। যার মধ্যে দুটি হাসপাতাল ও একটি মসজিদ।
চাহিদা ও জনস্বার্থে গ্রহণ করা এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের অভাবে নিত্য ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে সাধারণ মানুষদের। বিভিন্ন সময় জাতীয় সংসদে নানা ইস্যুতে কথা বলতে দেখা গেলেও এসব ইস্যুতে কখনই তাকে কথা বলতে দেখা যায়নি। একই সঙ্গে প্রকল্প বাস্তবায়নেও লক্ষ্য করা যায়নি তেমন কোনো উদ্যোগ। যদিও বেশ কয়েক বছর পূর্বে ‘গায়েবী’ হাসপাতাল নিয়ে তিনি চাষাড়ায় কড়া ভাষায় বক্তব্য রেখেছিলেন। এরপর এ নিয়ে তিনি আর কোনো কথাই বলেননি।
জানা যায়, নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলায় জমির অভাবে গত ১৮ বছর যাবৎ আটকে আছে দুটি ২০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালের নির্মাণ কাজ। এখনো কাগজে কলমেই রয়ে গেছে, আলোর মুখ আর দেখেনি হাসপাতাল দুটি। ফলে চাহিদা থাকা সত্ত্বেও সেবা বঞ্চিত হচ্ছে ফতুল্লা, সিদ্ধিরগঞ্জ অঞ্চলের বড় একটি অংশ। অন্যদিকে অদৃশ্য হাসপাতাল দুটির নামে বছর বছর বেতন, পদোন্নতি ও চিকিৎসক নিয়োগ হচ্ছে।
একইভাবে জমি সংক্রান্ত জটিলতায় গত ৭ বছর ধরে আটকে আছে নারায়ণগঞ্জবাসীকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া উপহার সদর মডেল মসজিদ নির্মাণ। একইসঙ্গে নেয়া দেশের অন্যান্য প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়ে ব্যবহৃত হলেও সদর উপজেলা মডেল মসজিদ এখনও রয়েছে ফাইলবন্দী।
দীর্ঘদিন যাবৎ গুরুত্বপূর্ণ ও জনস্বার্থে নেয়া প্রকল্প তিনটি আটকে থাকায় ক্ষুদ্ধ উপজেলার বাসিন্দারা। তাদের মতে, প্রকল্পগুলো না হওয়ার পিছনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, প্রশাসন ও দপ্তরগুলোর সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। তা নাহলে এতদিনে প্রকল্পগুলো হয়ে যাওয়ার কথা। এদিকে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের একাধিক উধর্বতন কর্মকর্তার মতে, প্রশাসনিক জটিলতা রয়েছে। তবে স্থানীয় সংসদ সদস্য শামীম ওসমান উদ্যোগ নিলেই সমস্যাগুলোর সমাধান সম্ভব।
এদিকে সাংসদ শামীম ওসমান প্রায় সময় নারায়ণগঞ্জবাসীকে মেডিক্যাল কলেজ, নামি বিশ^বিদ্যালয়সহ অনেক প্রকল্পের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। ওই তিনটি প্রকল্প দীর্ঘদিনেও শেষ করতে না পারায় সাধারণ মানুষের মধ্যে শঙ্কা রয়েছে তার দেখানো এসব স্বপ্ন বাস্তবায়ন নিয়ে।
তথ্যমতে, ২০০৬ সালের ৪ জুন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের (উন্নয়ন-২ শাখা) তৎকালীন সিনিয়র সহকারী সচিব আবেদা আক্তার স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে নারায়ণগঞ্জ সিভিল সার্জনকে ২০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল নির্মাণে স্থান নির্বাচন করে (কমপক্ষে তিন একর) জমি অধিগ্রহণের লক্ষ্যে একটি প্রস্তাব পাঠানোর নির্দেশ দেন। ২০০৭ সালের ১৭ জুলাই এক আদেশে নারায়ণগঞ্জ জেলার ফতুল্লা ও সিদ্ধিরগঞ্জে দুটি ২০ শয্যার হাসপাতাল নির্মাণের জন্য অনুমোদন দেন স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন উপ-সচিব আবদুল্লাহ আল বাকী।
জেলা সিভিল সার্জন ও উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগের সূত্রে জানা যায়, হাসপাতাল দুটির জন্য প্রয়োজনীয় জমি অধিগ্রহণের বিষয়ে একাধিকবার জেলা প্রশাসনে চিঠি দেয়া হয়েছে কিন্তু চিঠির কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। জমি অধিগ্রহণ না হওয়ায় হাসপাতাল নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়নি। কিন্তু ১৮ বছর আগেই মন্ত্রণালয় হাসপাতাল দুটির অনুমোদন দিয়েছে এবং সেই অনুযায়ী হাসপাতাল দুটির নামে চিকিৎসকসহ স্টাফ নিয়োগ হয়েছে এবং হচ্ছে।
তারা আরও জানান, হাসপাতাল দুটিতে একজন আরএমও, একজন মেডিকেল অফিসার ও ৪ জন কনসালটেন্ট’সহ ৬জন মোট করে ১৮টি পদ রয়েছে। যার মধ্যে ৯ জন চিকিৎসক নিয়োগ আছেন এবং ৯টি পদ শূণ্য। নিয়োগপ্রাপ্ত ৯ জন হাসপাতালের নামে নিয়মিত বেতন, ভাতা পান।
এদিকে ২০১৯ সালে হাসপাতালদুটির বিষয়ে উদ্বোগ প্রকাশ করেছিলেন নারায়ণগঞ্জ ৪ আসনের এমপি শামীম ওসমান। সে বছর ৩০ জুলাই সদর উপজেলায় আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘এখনও জমির বন্দোবস্ত হয়নি, নির্মাণ হয়নি হাসপাতালের স্থাপনা অথচ উপজেলার ২টি হাসপাতালে কর্মরত দেখিয়ে মাসে মাসে ২৪ জন চিকিৎসক তুলে নিচ্ছেন মোটা অংকের টাকা।’ এ বিষয়ে তিনি সংসদে কথা তোলার আশ্বাস দিলেও তা আর হয়নি। পরবর্তীতে হাসপাতাল দুটি নির্মাণে তার কোনো উদ্যোগও লক্ষ্য করা যায়নি।
অন্যদিকে ২০১৭ সালে মুজিববর্ষে জনগণের জন্য উপহার হিসেবে দেশের প্রত্যেক জেলা, উপজেলা ও উপকূলীয় এলাকায় ৫৬০টি মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। এ প্রকল্পের আওতায় ১৪ কোটি করে নারায়ণগঞ্জের ৫ উপজেলায় তিনতলা বিশিষ্ট ৫টি এবং জেলা পর্যায়ে চারতলা বিশিষ্ট একটি মোট ৬টি মডেল মসজিদ নির্মাণের কাজ হাতে নেয়া হয়।
উপহারের ৫ মসজিদের নির্মাণ কাজ চলমান থাকলেও জমি না পাওয়ায় এখনো শুরু হয়নি সদর উপজেলা মডেল মসজিদের নির্মাণ কাজ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, প্রকল্পের প্রথম দিকে সদর উপজেলার মসজিদের জন্য খাসের জমি পাওয়া যাচ্ছিল না। পরবর্তীতে একাধিকবার জমি নির্ধারণ করার পরও তা বাতিল করা হয়। পরে ২০২২ সালে সিদ্ধিরগঞ্জের গোদনাইলে একটি জমি নির্ধারণ হওয়ার পর বিশেষ বিবেচনায় সেটা বাতিল করে ইসলামিক ফাউন্ডেশন। ২০২৩ সালে ভূঁইগড়ের একটি জমি নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু একাধিক পক্ষের আপত্তির কারণে শেষে সে জমিতেও নির্মাণ কাজ না করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় কর্তৃপক্ষ।
জেলা ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সূত্রে জানা যায়, ভূঁইগড়ের জমি বাতিল করে মূল শহরের পাশে চাঁনমারি এলাকায় একটি জমি নির্ধারণ করা হয়েছে। সরকারি একটি দপ্তর সেখানে জমি দিতে রাজি হয়েছে কিন্তু সেখানে জমি অপর্যাপ্ত। ফলে প্রায় ৯ শতাংশ ব্যক্তি মালিকানাধিন জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। কিন্তু বিপত্তির কারণ হচ্ছে, জমির মালিক ওই জমি দিতে রাজি নন।
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের জেলা উপ পরিচালক মুহাম্মদ জামাল হোসাইন বলেন, সদর উপজেলা মডেল মসাজিদ নির্মাণের জন্য জমি পাওয়া যাচ্ছিল না। গতবছর সিদ্ধিরগঞ্জের ভূঁইগড় এলাকার একটি জমি আমরা নির্বাচন করেছিলাম। কিন্তু যেহেতু এটি সদর উপজেলা মডেল মসজিদ তাই সবাই চাচ্ছে ডিসি অফিসের কাছাকাছি কোনো স্থানে মসজিদটি হোক। যার ফলে আমরা সিদ্ধিরগঞ্জের ওই জমিতে কাজ করতে পারিনি। পরবর্তীতে জেলা প্রশাসক, এমপি মহোদয়ের সঙ্গে আলোচনা করার পর চাঁনমারি একটি জায়গা জমি আমরা নির্বাচন করেছি। সেখানে সড়ক ও জনপদের জমি রয়েছে। তারা জমি দেওয়ার বিষয়ে রাজিও হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, প্রকল্প অনুযায়ী মসজিদের জন্য ৪৩ শতাংশ জমি প্রয়োজন। কিন্তু চাঁনমারিতে সওজের ৩৪ শতাংশ জমিই আছে। তাই পাশর্^বর্তী জমির মালিকের সঙ্গে আলোচনা চলছে।