বিপ্লব হাসান:
পাঠক তার পছন্দের পত্রিকাটি অন্তত পাঁচ টাকার বিনিময়ে সারা পৃথিবীর খরব পেয়ে যায় নিমিষেই হাতের নাগালে। লাখ লাখ টাকা খরচ করে খবরের কাগজের মালিক পক্ষ রাত ১২টার পর তীর্থের কাকের মতো বসে থাকেন পাঠক মহলে খবরের কাগজ পৌঁছবে বলে। কিন্তু একবারও কি পাঠক ভাবেন কার মাধ্যমে তার পছন্দের খবরের কাগজটি তিনি সহজেই পেয়ে যান? মালিক পক্ষ কি একবারও ভাবেন তার কোটি টাকার খবরের কাগজটা কে এসে তার পরিশ্রমের মাধ্যমে পাঠক মহলে ছড়িয়ে দেন? তিনি আর কেহ নন।
তাকে পাঠক মহল এক নামে চেনেন তার নাম হলো, ‘হকার’ যাকে পত্রিকার হকার বলে চেনেন এমনকি তাকে অনেক সময় ডাকা হয়,‘এই পেপার’,‘ওই পত্রিকা’ ইত্যাদি ইত্যাদি নামে ডাকে। একটা পত্রিকার দাম যদি পাঁচ টাকা হয় তবে হকার পাঁচ টাকা বিক্রি করে পত্রিকার এজেন্ট এবং এজেন্ট পত্রিকার মালিককে দিয়ে কত টাকা হকার পায়? সে ক্ষেত্রে একজন হকার অবশ্যই নিরীহ মানুষ যার অঢেল টাকা কামানোর পথ নাই বলেই পত্রিকা বিক্রি করার জন্য নেমে যায়। সময়টা কখন পাঠক জানে? কি দিন কি রাত কি বৃষ্টি কি রৌদ্র, কি গরম কি শীত আকাশ পরিবেশের আবহাওয়া যেমনই থাক হকার তার আরামের ঘুম হারাম করে মোরগ ডাকার আগেই নেমে পড়েন সমিতি কিংবা এজেন্টের কাছ থেকে পত্রিকা সংগ্রহ করার জন্য তার পর কুকুরের মতো ছুটে চলেন মানুষের দুয়ারে দুয়ারে। পা ক্ষয় করেন গলা ফাটান শুধু একটা পত্রিকা বিক্রি করার জন্য।
সেই গভীর রাত থেকে নেমে সারা দিনের পরিশ্রমের ফল আসে একজন হকারের জন্য সর্বসাকুল্যে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। যেদিন ভালো চলে সেদিন ৩০০টাকা হয়। খারাপ হলে ২০০ টাকার মতো থাকে। কিন্তু এই আয়ের কোনো নিরাপত্তা নেই। এমনকি সামান্য এই আয়ের নিমিত্তে বিপন্ন হয় পুরো জীবনটাই। তাছাড়া পরিবার- পরিজন ও সন্তান লালন-পালন করে তাদের শিক্ষা, চিকিৎসাসহ এই আয় দিয়ে টিকে থাকা মুশকিল। এরই জনবহুল ব্যস্ত এই এলাকায় খবরের কাগজ বিক্রির উলেখযোগ্য বাজার হিসেবে বেছে নেন রাস্তার চলমান গাড়িগুলোকে। সে জন্য দিতে হয় দৌড়ঝাপ। সে ক্ষেত্রে দূর্ঘটনায় পড়া স্বাভাবিক। পাঠকের কাছে নিজের জীবন বাজি রেখে খবরের কাগজ পৌঁছায় ঠিকই কিন্তু দূর্ঘটনায় তাদের পাশে কেউ থাকার নাই। প্রাকৃতিক রোগব্যাধি তো থাকেই। এই এলাকার হিসাব অনুযায়ী একজন হকারের মাসিক আয় সর্বসাকুল্যে ৯হাজার টাকা। ব্যস্ততম এই এলাকায় পারিপার্শ্বের সাপেক্ষে ৯ হাজার টাকায় টিকে থাকার কথা না থাকলেও নিজের সমস্যা ঢেকে পাঠকদের পত্রিকা ঠিকই পৌঁছে দেয় হকার।
তাদের সম্বন্ধে ভাবার জন্য নাই পাঠকের সময় না পত্রিকার হকার সমিতির সময় না পত্রিকার মালিক পক্ষের সময়। সংবাদপত্র বিক্রি করে হকাররা লাভ পান কমিশন অনুযায়ী। প্রকাশকের কাছ থেকে হকার্স সমিতি পত্রিকা প্রায় ৩৫ শতাংশ কমিশনে। এর মধ্য থেকে হকাররা পত্রিকা পান ৩২ শতাংশ কমিশনে। মাঠ পর্যায়ের হকাররা অনেক পত্রিকার ক্ষেত্রেই নির্ধারিত কমিশন পান না। মধ্যস্বত্ব ভোগীরা তাতে ভাগ বসায়। ১৯৭৪ সাল থেকে এই একই রেটে চলছে পত্রিকা বিপণন। অনেক সময় গড়িয়েছে। দুই টাকার পত্রিকা ১২ টাকা হয়েছে, সবার লাভ বেড়েছে। কিন্তু হকারদের আয় বাড়েনি। অনেকে পত্রিকার সংখ্যার কথা বলেন, কিন্তু হকাররা বলছেন, তাতে কাজ হচ্ছে না। সার্বিকভাবে তারা পিছিয়ে পড়ছেন। এছাড়া কোনো কোনো পত্রিকার ক্ষেত্রে অবিক্রীত পত্রিকা ফেরত দেয়ার সুযোগ থাকে না বা সীমিত থাকে। যেমন এক পত্রিকা হকার আল আমিন মিয়া বলেন, বাংলাদেশ প্রতিদিন আর প্রথম আলো ফেরত নেয় না।
একটা পত্রিকা থেকে গেলে বিরাট ক্ষতি। আমাদের আয় কম। পাঁচটা পত্রিকা বেচলে ১০ টাকা লাভ হয়। একটা থেকে গেলে তার পুরোটাই ক্ষতি। বড় পত্রিকাগুলো ফেরত দিতে ঝামেলা হয়। দু’চারটা ফেরত নেয়, বাকিগুলোর নিজের পকেট থেকে গচ্চা দেয়া লাগে। এরকম কয়েকটা হলে আর কুলায়া ওঠা যায় না। বৃষ্টির মৌসুম এলে নিয়মিত পত্রিকা ভিজে যায় আবার রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অনেক সময় পত্রিকা বিক্রি করতে রাস্তায় নামাই যায় না। শত ঝামেলা পেরিয়েও হকাররা নিয়মিত পাঠকদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও ঠিক সময়ে পত্রিকা পৌঁছে দেন। মাস শেষে যখন নিজেদের হিসেবের খাতা খুলেন প্রহসন আর মানসিক কষ্ট ছাড়া আর কিছু না। এইতো গেলো রূপগঞ্জের হকারদের হালহকিকত ।
পত্রিকার হকার ফারুক বলেন, গ্রামে পত্রিকা এখন খুব কম বিক্রি হয়। ইন্টারনেটের মাধ্যমে সকলেই খবর পড়ে থাকে। আগের চেয়ে এখন পত্রিকা চলে না। তবুও পত্রিকা বিক্রি করছি অল্প স্বল্প নিজেদের খরচ বাড়লেও পত্রিকার দামও আমাদের পাওনা তো বাড়ে না। বছরে দুটো ঈদ আসলে পত্রিকার হকাররা পান না কোনো অতিরিক্ত মূল্য।
স্বাধীনতার পর থেকে দিনের পর দিন যে কোনো পত্রিকার দাম বেড়েছে। বেড়েই চলছে। কিন্তু বাড়ে নি হকারদের শ্রমের মূল্যের। অষ্টম ওয়েজ বোর্ড হিসেবে সাংবাদিকরা বেতন পায় ঠিকই কিন্তু প্রেসের আওতায় আসে না সাংবাদিকদের সংবাদ বাহকের বাইরের মূল সংবাদ বাহক তথা হকাররা। সাংবাদিক সম্পাদক প্রকাশকরা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের নিচে বসে সংবাদ লিখেন, ছাপান কিন্তু এই সংবাদ ও সংবাদপত্র যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে এলাকার পাড়া-মহল্লা এমনকি শোবার ঘরে নিয়ে পৌঁছায় তাদের দুর্দশা জীবন ও কষ্টময় জীবিকার কথা বৈচিত্রময় সংবাদপত্রে আসে না। রাতের প্রহর কাটিয়ে ভোর হলেই চোখ মেলে পত্রিকার শিরোনামগুলোতে চোখ বুলালে আতংকিত আমরা হই ঠিকই কিন্তু যারা সর্বদায় পাঠকদের জন্য নিজেরাই আতংকে থাকেন তাদের খবর আমরা নিজেরাও নেই না এমনকি সংবাদপত্রে কখনও আসতে দেখি না। গ্রাম শহরের লক্ষ কোটি লেখক সংবাদ কিংবা কবি সাহিত্যিকদেরও দেখি না। পত্রিকার হকারদের নিয়ে দু কলম লিখতে । সাংবাদিকদের আড়ত জাতীয় প্রেসক্লাবে হয়েছে কি হকারদের নিয়ে কোনো সম্মেলন? কিন্তু পত্রিকার সাংবাদিক – সম্পাদক প্রকাশক পাঠক আমার আপনার সকলেরই উচিত পত্রিকার হকারদের ন্যায্য অধিকার পাওয়ার ব্যবস্থা নেয়া।যাদের অঢেল ও সীমাহীন পরিশ্রমের ফলে আমরা প্রতিদিন সংবাদপত্র পাই এবং পড়ি তাদের জন্য সাংবাদিক সম্পাদক পাঠক এমনকি উভয়ের কিছু একটা করা দরকার।
এ ক্ষেত্রে জাতীয় প্রেসক্লাব ও তথ্য মন্ত্রণালয় রাখতে পারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। আর সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারেন দেশের লেখক সাহিত্যিকরা। যাদের কলমের খোঁচায় ওঠে আসবে হকারদের দূর্ভোগের কথা।
হকাররা হয়তো শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসায় থাকার স্বপ্ন দেখে না তবে একটু ভালো করে বাঁচবে। তিন বেলায় অন্তত ডাল ভাত খাবে এমন আশা করতেই পারে।