মোরশেদ মুকুল: বর্তমান সরকারের মন্ত্রিসভার ৩০তম বৈঠক শেষ হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে গতকাল সোমবার তার কার্যালয়ে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে ইপিজেট শ্রম আইনের চূড়ান্ত অনুমোদন, এভিয়েশন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি অধিগ্রহণ আইনসহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।
আগামী ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এটিই ছিল এ মন্ত্রী সভার ৩০তম এবং শেষ বৈঠক।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয় ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি। ১২ জানুয়ারি সরকার গঠিত হয়। এই সরকারে আওয়ামী লীগ ছাড়াও জাতীয় পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, জেপির প্রতিনিধিত্ব আছে। এসব দল থেকে মন্ত্রিসভায় ৬ জন স্থান পেয়েছে।
বৈঠকে প্রধামন্ত্রী বলেন, আজ আমাদের (মন্ত্রিসভা) শেষ বৈঠক। এরপর মন্ত্রিসভার আর কোনো বৈঠক হবে না। সবাই নিজ নিজ এলাকায় চলে যাবেন নির্বাচনী কাজে। আর দেখা হবে না। আগামীতে জনগণ যাকে ভোট দেবে অর্থাৎ জনগণ কাকে ভোট দেবে এটা তারাই জানেন।
‘পরবর্তীতে নতুন সংসদ হবে, নতুন কেবিনেট হবে, সেখানে কারা আসবে সেটা তো এখনই বলা যায় না, সবাই ভালো থাকবেন। সবাইকে ধন্যবাদ।’
সভায় যেসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
মন্ত্রিসভায় ইপিজেড শ্রম আইনের চূড়ান্ত অনুমোদন;
‘বাংলাদেশ ইপিজেড শ্রম আইন, ২০১৮’ এর চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা।
বৈঠক শেষে সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম সাংবাদিকদের বলেন, শ্রমিক কল্যাণ সমিতি ফেডারেশন করার জন্য ৩০ শতাংশের পরিবর্তে ২০ শতাংশ সমার্থন নেওয়ার বিধান করা হয়েছে। আর ধর্মঘট করার জন্য দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থন প্রয়োজন পড়বে।
তিনি বলেন, ২০১৩ সাল থেকে এ আইনটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এ পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়েছে।
২০০৬ সালের মূল শ্রম আইনের সঙ্গে এটাকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে এবং আইএলও, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রেরও কিছু অবজারভেশন ছিল এটাকে একটু শ্রমবান্ধব করার জন্য। সেই দাবিতেই এটাকে অনেকটা শ্রমিকদের ফেভারেবল করা হয়েছে।
নতুন আইনের বিভিন্ন পরিবর্তন তুলে ধরে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, বেপজার নিজস্ব পরিদর্শন কার্যক্রমের পাশাপাশি শিল্প প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের যে অধিদফতর আছে তাদেরও এই আইনের আওতায় পরিদর্শন সুযোগ রাখা হয়েছে।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, শ্রমিকদের ধর্মঘট করার ক্ষেত্রে যে তিন-চতুর্থাংশের সমর্থনের বাধ্যবাধকতা ছিল সেটি কমিয়ে দুই-তৃতীয়াংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। শ্রম আইনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে শ্রমিক কল্যাণ সমিতির গঠনতন্ত্র শ্রমিকরা নিজেরা করতে পারবেন, সেই বিধান রাখা হয়েছে।
শ্রমিকদের ধর্মঘট ও লক আউটের অধিকার দেওয়া হয়েছে। শ্রমিক কল্যাণ সমিতির নির্বাচিত কর্মকর্তাদের চাকরি সংক্রান্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। মালিকদেরও সমিতি করার অধিকার দেওয়া হয়েছে।
শ্রমিক কল্যাণ সমিতি মানেই ট্রেড ইউনিয়ন, নামটা ভিন্ন, কিন্তু কাজ একই। শ্রমিকরাও এই নামটি পছন্দ করেছেন। যোগ্য শ্রমিক বলে একটি বিধান ছিল, আগের আইনে সেটি বাদ দেওয়া হয়েছে।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, নির্বাহী পরিষদের পরবর্তী নির্বাচনের সময় এক বছর থেকে কমিয়ে ৬ মাস করা হয়েছে। শ্রমিকের ইস্তফাজনিত কারণে সার্ভিস বেনিফিট প্রাপ্তি সংক্রান্ত একটি নতুন উপধারা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অবসর গ্রহণের ক্ষেত্রে শ্রমিকরা সার্ভিস বেনিফিট হিসেবে প্রত্যেক বছরের জন্য ৩০ দিনের মূল মজুরির পরিবর্তে ৪৫ দিনের মূল মজুরি পাবেন।
তিনি বলেন, আইএলও, ইউএস অ্যাম্বাসি ও ইইউ-এর মতামতের ভিত্তিতে শ্রমিক কল্যাণ সমিতি গঠনের জন্য আগে একটা রেফারেন্ডাম সিস্টেম ছিল অর্থাৎ গণভোট, সেটা বাদ দেওয়া হয়েছে।
নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠানে ৩ মাস পর্যন্ত শ্রমিক সমিতি গঠন নিষিদ্ধ ছিল, সেই বিধানটিও বাদ দেওয়া হয়েছে। শ্রমিক কল্যাণ সমিতি গঠনের জন্য আগে ১২টি স্টেপ ছিল, এখন কমিয়ে তিনটি করা হয়েছে।
ইপিজেডের বিনিয়োগকারীরা এই আইনের সঙ্গে একমত কিনা- প্রশ্নে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, সবার মত নিয়েই আইনটি করা হয়েছে।
এভিয়েশন বিশ্ববিদ্যালয়:
অন্যদিকে দক্ষ বৈমানিক ও বিমান প্রকৌশলী তৈরি করতে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অ্যাভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১৮’ চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেন, এটা আমাদের দেশের জন্য একটা নতুন বিষয়। অ্যারোস্পেস শুধুমাত্র এমআইএসটিতে (মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি) একটা ডিপার্টমেন্ট আছে। আর কোথাও কোনো সুযোগ নেই, এমনকি বুয়েটেও নেই। অ্যারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিংকে সম্প্রসারিত করার জন্য এ আইনটি করা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়টির গঠন নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, অন্যান্য ইউনিভার্সিটি যেরকম, একেবারে হুবহু একই রকম অনুসরণ করা হয়েছে। তেমন কোনো পরিবর্তন নেই। এ বিষয়ে অর্ডিন্যান্স (অধ্যাদেশ) জারি হবে।
বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর তত্ত্বাবধানে এই বিশ্ববিদ্যালয়টির ক্যাম্পাস ঢাকার পূর্বাচল যাওয়ার পথে স্থাপিত হবে বলে জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, বিমান বাহিনী এবং বেসামরিক বিমান পরিবরহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় এই বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা হতে যাচ্ছে।
বীর প্রতীক তারামন বিবির মৃতুুতে শোক;
মোহাম্মদ শফিউল আলম সাংবাদিকদের বলেন, খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবির মৃত্যুতে মন্ত্রিসভা শোক প্রস্তাব গ্রহণ করে।
এরআগে ৬১ বছর বয়সী তারামন বিবি ৩০ নভেম্বর কুড়িগ্রামের রাজিবপুর উপজেলার কাচারীপাড়ায় নিজ বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। দীর্ঘদিন ধরে বক্ষব্যাধিসহ নানা রোগে ভুগছিলেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ১১ নম্বর সেক্টরের হয়ে তারামন বিবি মুক্তিবাহিনীর রান্নাবান্না, তাদের অস্ত্র লুকিয়ে রাখা, পাকিস্তানিদের খবর সংগ্রহ এবং সম্মুখযুদ্ধে লড়াই করে দেশের স্বাধীনতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। স্বাধীন বাংলাদেশে তাকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়।
একই সাথে মন্ত্রিসভায় বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলকে অভিনন্দন জানানো হয়।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, সফরকারী ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ জাতীয় দল ২-০ ব্যবধানে সিরিজ জয় করে। এজন্য মন্ত্রিসভা তাদের আন্তরিকভাবে অভিনন্দন জানায়।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব আরও জানান, তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন ডিএফপি (চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদফতর) কর্তৃক প্রকাশিত নবম জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তৃতা সমগ্র শুরুতেই প্রধানমন্ত্রীকে হস্তান্তর করা হয়।
‘পরিচালক’ পদবি পাচ্ছেন মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের প্রধান;
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট মহাপরিচালকের পদ ‘পরিচালক’ করতে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট (সংশোধন) আইন, ২০১৮’ এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা।
শফিউল আলম সাংবাদিকদের বলেন, ইউনেস্কোর প্রধান মহাপরিচালক। আমাদের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট ক্যাটাগরি-২ প্রতিষ্ঠান, এখানকার প্রধানও মহাপরিচালক। ক্যাটাগরি-২ এর বিধান হলো এখানকার (মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট) যিনি প্রধান হবেন তিনি হবেন ‘পরিচালক’। এজন্য মহাপরিচালককে ‘পরিচালক’ করা হয়েছে।
যেখানে ‘মহাপরিচালক’ আছে যেখানে ‘পরিচালক’ এবং যেখানে ‘পরিচালক’ আছে সেখানে ‘অতিরিক্ত পরিচালক’ হবে।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, আমাদের ২২ সদস্যের পরিচালনা কমিটি ছিল। কিন্তু ইউনেস্কোর রুল হলো ছয় সদস্য বিশিষ্ট কমিটি হবে, সেটা ওনাদের (ইউনেস্কো) নির্ধারিত করে দেওয়া আছে। এর বাইরে যাওয়া যাবে না। এজন্য ব্যাক করা হয়েছে ২২ থেকে ৬-এ।
বীমা করপোরেশনের মূলধন বাড়ছে;
জীবন বীমা ও সাধারণ বীমাকে করপোরেশনের অনুমোদিত ও পরিশোধিত মূলধন বাড়ানোর প্রস্তাব করে ‘বীমা করপোরেশন আইন-২০১৮’ এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন করেছে সরকার।
১৯৩৮ সালের ‘দ্য ইনসুরেন্স অ্যাক্ট’কে রহিত করে ২০১০ সালে ‘দ্য ইনসুরেন্স করপোরেশ আইন’ করা হয়। ওই আইনকে রহিত করে নতুন আইন করা হচ্ছে।
প্রস্তাবিত আইনের অধীনে জীবন বীমা ও সাধারণ বীমাকে আনা হয়েছে জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, এতদিন জীবন বীমা করপোরেশন এবং সাধারণ বীমা করপোরেশনের অনুমোদিত ও পরিশোধিত মূলধন ছিল ২০ কোটি টাকা করে। প্রস্তাবিত আইনে জীবন বীমা করপোরেশনের অনুমোদিত মূলধন ৩০০ কোটি টাকা এবং পরিশোধিত মূলধন ৩০ কোটি টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
আর সাধারণ বীমা করপোরেশনের অনুমোদিত মূলধন ৫০০ কোটি এবং পরিশোধিত মূলধন ১২৫ কোটি টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে বলে জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
তিনি আরও বলেন, প্রস্তাবিত বীমা করপোরেশন আইনে পরিচালনা পর্ষদ সাতজন থেকে বৃদ্ধি করে ১০ জনে উন্নীতের প্রস্তাব করা হয়েছে। কমপক্ষে পাঁচজনের উপস্থিতিতে কোরাম হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি অধিগ্রহণে সমতা আসছে;
সমতলের মতো পার্বত্য তিন জেলাতেও জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে সমতা তৈরি করতে একটি অধ্যাদেশের সংশোধনীতে অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা।
‘দ্য চিটাগং হিল ট্রাকস (ল্যান্ড অ্যাকুজেশন) রেগুলেশন, ১৯৫৮’ এর অধিকতর সংশোধনকল্পে প্রণীত অধ্যাদেশের খসড়ার নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে যে ক্ষতিপূরণ ছিল বাজার মূল্যের সঙ্গে অতিরিক্ত ১৫ শতাংশ। এখন ১৫ শতাংশের জায়গায় সরকারি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে ২০০ শতাংশ এবং বেসরকারি ক্ষেত্রে ৩০০ শতাংশ হবে।
সমতলে অর্থাৎ ৬১ জেলায় ক্ষতিপূরণের হার হলো বর্তমান বাজার মূল্যের সঙ্গে সরকারি ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ২০০ শতাংশ এবং বেসরকারি ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ৩০০ শতাংশ। সমতলের সঙ্গে সমতা করার জন্য পার্বত্য এলাকাতেও একই মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
সংসদ না থাকায় আইনগুলো অধ্যাদেশ আকারে জারি করা হবে বলে জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব।