আজ শুক্রবার, ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

শ্বেতাঙ্গ জঙ্গি কিন্তু জঙ্গি না !

মো:মুন্না খান
জঙ্গিবাদ বলতে বর্তমানে অস্ত্রধারী ধর্ম গোষ্ঠীকে বোঝানো হয় যারা কিনা বল প্রয়োগের মাধ্যমে ধর্মকে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। বর্তমানে জঙ্গিবাদ খুবই আলোচিত একটি বিষয়। বিশ্বব্যাপী নানাভাবে জঙ্গিবাদ শব্দটি কে ব্যবহার করা হয়। যদিও এতে বিভিন্ন দেশ বিভিন্নভাবে সুবিধা নিয়ে থাকে।

জঙ্গিবাদের প্রাথমিক পর্যায় কে বলা হয় মৌলবাদ। মুলত যারা ধার্মিক ধর্মের রীতিনীতি অনুযায়ী নিজেরা চলতে চায় এবং সমাজকে চালাতে চায় তাদেরকে মৌলবাদ বলে। যদিও এখন খুব ভুল ভাবে ধার্মিক বলতেই মৌলবাদী মনে করা হয়। আজকের মৌলবাদী লোকেরা যখন হাতে অস্ত্র তুলে নেয় তারা জঙ্গিবাদী হিসেবে পরিচিতি পায়। বর্তমান বিশ্বে জঙ্গিবাদ বলতে মুসলিম ধর্মের লোকদের বুঝানো হয় কিন্তু বাস্তবে তা কতটুকু সত্য। আদৌ কি ইসলাম জঙ্গিবাদে বিশ্বাসী? ইসলাম কি জঙ্গিবাদকে প্রশ্রয় দেয়? ইসলাম শান্তির ধর্ম। ইসলামের আবির্ভাব হয়েছে শান্তি প্রতিষ্ঠা, কল্যান ও মানবতার জন্য। ইসলাম মানুষকে প্রকৃত মানুষ বানানোর শিক্ষা দেয়। নবীকুল শিরোমনি হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম বিশ্বে শান্তি, কল্যাণ ও মানবতা অগ্রদূত।

ইসলামের নাম ভাঙিয়ে যারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালিত করে তারা প্রিয় নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর শিক্ষা ও আদর্শ থেকে অনেক দূরে। সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদের কোন ধর্ম নেই। লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে সমাজ ও রাষ্ট্রকে আতঙ্কগ্রস্ত করে রেখে পার্থিব সম্পদ অর্জন আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা। পবিত্র কুরআন মাজিদে বিভিন্ন আয়াতে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, ফিতনা-ফাসাদ কে নিষিদ্ধ করা হয়েছে তারপরেও বিশ্বব্যাপী একটি মহল তাদের হীন স্বার্থ আদায়ের জন্য ধর্ম কে পুঁজি করে মুসলমানদের জঙ্গী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে। কিন্তু ইতিহাস বলে প্রথম সুসংগঠিত জঙ্গী গোষ্ঠী হিসেবে বিশ্বে পরিচিতি পায় ইহুদীদের সংগঠন হাগানাহ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অব্যাহতি কাল পরে বেশ কিছু ইহুদিবাদী জঙ্গী সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে হাগানাহ ছিল বড়। আরো ছিল সন্ত্রাসবাদি সংগঠন ইরগুন এবং স্টার্ন গেম এর গুন নেতা ছিলেন উন্মাদ আরব বিরোধী মুনাচেম বেগিন। যিনি পরবর্তীতে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। স্টার গ্যাং এরোও নেতা ছিলেন আরেক  ভাবি প্রধানমন্ত্রী বর্ণবাদী ইজেক রবিন। এই ইহুদী সংগঠন গুলো ফিলিস্তিনিদের নিশ্চিহ্ন করতে জঙ্গী হামলা চালিয়েছে।

পরবর্তীতে জঙ্গি গোষ্ঠী হিসেবে যাদের নাম সামনে এসেছে গেছে তাদের প্রত্যেকের বেড়ে ওঠার সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর যুক্ত। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের পতনের পর মার্কিন সাম্রাজ্যের যুগ শুরু হয়। উনিশত আশির দশকের মার্কিনিরা সোভিয়েত ইউনিয়নকে কাবু করার উদ্দেশ্যে প্রত্যক্ষভাবে আফগানিস্তান, সিরিয়ায় ইসলামী জঙ্গি গোষ্ঠী বিকাশ ঘটায় এবং এই জঙ্গিগোষ্ঠীকে তারা ক্ষমতায় যেতেও সাহায্য করে। ১ জুন ২০১৪ ফক্স নিউজ কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সম্প্রতি মার্কিন নির্বাচনে রাষ্ট্রপতি প্রার্থী হওয়া হীলারী ক্লিলটন বলেন আজকে আমরা যে আল-কায়েদার বিরুদ্ধে কথা বলছি, কুড়ি বছর আগে সোভিয়েত ইউনিয়ন এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য আমরাই তাদেরকে সৃষ্টি করেছি তাদেরকে অর্থ যুগিয়েছে। অন্যদিকে পাকিস্তানের সাবেক সেনাশাসক পারভেজ মোশাররফ পত্রিকার বিশেষ সাক্ষাৎকারে বলেছেন তালেবান আমেরিকার সৃষ্টি। এটা খুবই স্পষ্ট যে আশির দশকে গঠিত রুশ আফগান যুদ্ধ হচ্ছে সর্বশেষ জঙ্গিবাদের ভিত্তি স্থাপন কাল। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ এ সময় পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এর সাহায্যে আফগান মুসলিমদের প্রতিনিধিত্বশীল একটি অংশকে জঙ্গি গোষ্ঠী হিসেবে প্রশিক্ষণ দেয়। ১৯৮০ থেকে ৯৪ এই সময়ের মধ্যে আফগানিস্তানের একটি সশস্ত্র বাহিনী  মিলিয়ন ডলার খরচ করেছিল বিভিন্ন অংশ থেকে মুসলিম তরুণদের সংগ্রহ করে এই যুদ্ধে যুদ্ধ করাতে।

কিন্তু তারা পরিষ্কার ছিলেন না যে এখানে যতটা না আল্লাহর স্বার্থরক্ষার ব্যাপার ছিল তার চেয়েও অনেক বেশি ছিল  রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষার ব্যাপার। বিশ্বে যারা তাদের স্বার্থে এই জঙ্গিগোষ্ঠীদের তৈরি করেছে আজকে তারাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। নাইন ইলেভেনের মতো সন্ত্রাসী হামলা আফগানিস্তান দখল, সিরিয়া, মিশর সহ মধ্যপ্রাচ্যের যে সকল দেশে অশান্তি বিরাজমান তার নেপথ্যে এই জঙ্গিবাদ। আজ এই জঙ্গিবাদ ঢালাওভাবে ইসলাম ধর্মের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে একটি মহল। যা সকল ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের হৃদয় রক্তক্ষরণ তৈরি করছে। বিশ্বব্যাপী মুসলিমদের সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করছে। আজকে কোন একটি দেশের মুসলমান ব্যক্তি সহ বিভিন্ন দেশে গমনকালে তাদেরকে সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে।

সর্বশেষ ঘটে যাওয়া নিউজিল্যান্ডের মসজিদে এলোপাথাড়ি হামলা চালিয়ে ৪০ মুসল্লিকে হত্যা করেছেন ব্রেনটন ট্যারেন্ট নামে একজন অস্ট্রেলিয়ার শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ব বাদী সন্ত্রাসী নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্ট চার্জের হামলাটি ছিল সুপরিকল্পিত।  হামলাকারী টুইটারে ৭৩ ইশতেহার করে হামলার ঘোষণা দেন। তাতে তিনি বলেছিলেন এটি একটি সন্ত্রাসী হামলা। ২০১১ সালে নরওয়ের অসলোতে এন্ডারস ব্রেব্রিক নামে এক ব্যক্তির সন্ত্রাসী হামলায় ৭৭ জন নিহত হয়েছিলেন। হামলাকারীর সেই হামলা থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে এ হামলা চালায় বলে ৭৩ পাতার ইশতিহারে উল্লেখ করা হয়েছে। ইশতেহারে তিনি বলেছেন আমি মুসলিমদের অপছন্দ করি। সব মুসলিমদের ঘৃণা করি। যারা অন্য ধর্ম থেকে এসে মুসলিম হয়। হামলাকারী এসব মুসলিমকে রক্তের সঙ্গে প্রতারণাকারী বলে উল্লেখ করেছেন। এসব প্রতারণাকারী বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই। স্পষ্টত হামলাকে ধর্ম বিদ্বেষী মনে হচ্ছে। কিন্তু তারপরও বিশ্ব মিডিয়া এই ঘটনাকে জঙ্গিবাদের সাথে সম্পৃক্ত মনে করছেন না। কেন করছেন না সে একজন শ্বেতাঙ্গ বলে? সে মুসলিম নয় বলে? সে ক্রিস্টান ধর্মীয় অনুসারী বলে, সত্যিই তাই যদিও ঘটনাটি মুসলিমবিদ্বেষী তারপরও ঘটনাটি জঙ্গিবাদ হিসেবে স্থান পায়নি।

কিন্তু একই ঘটনাটি যদি কোন মুসলমান করতেন তাহলে হয়তো এতক্ষণে তা বিশ্বব্যাপী জঙ্গী হামলা বলে প্রচারিত হত। সম্প্রতি ভারতের কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলায় বেশ কয়েকজন সেনা নিহত হয়। সেই সেনা নিহতের ঘটনা কে বিশ্বব্যাপী জঙ্গী হামলা হিসেবে প্রচারিত করে। ভারত এই ঘটনাকে জয়শী মোহাম্মদের হামলা হিসেবে বলেছেন।  ইতিমধ্যে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুই দেশ যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছেন। তাদের দুই দেশেরই একাধিক যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়েছে। এখন পর্যন্ত সীমান্তে যুদ্ধ চলছে। প্রসঙ্গত কাশ্মীরে কোন ধর্মীয় বিষয় নিয়ে সংঘাত নয়। কাশ্মীর একটি ভৌগোলিক অবস্থান যেখানে ধর্ম ও সংস্কৃতির সাথে পাকিস্তানের হুবহু মিল রয়েছে। যার কারনে ভারত কাশ্মীরি ভূখণ্ডকে নিজেদের মনে করলেও কাশ্মীরি মানুষের সংস্কৃতি ও ধর্ম নিজেদের মনে করতে পারেনি যার কারনে এখন পর্যন্ত কাশ্মীরি জনগণ তাদের নিজেদের অধিকার থেকে বঞ্চিত নিষ্পেষিত। কিন্তু স্বার্থন্বেষী মহল তাদের হীন স্বার্থ উদ্ধার করতে কাশ্মীরের ঘটনাগুলোকে জঙ্গী ঘটনা হিসেবে প্রচার করে।

তাই আসুন আমরা সবাই মিলে বিশ্বকে জানিয়ে দেই মুসলিমরা কখনো জঙ্গিবাদকে সমর্থন করে না। জঙ্গিবাদকে প্রশ্রয় দেয় না। জঙ্গিবাদ কোন ধর্মের না। সে কি মুসলিম, ইহুদি, খ্রিষ্টান কি শ্বেতাঙ্গ, তাদের একটাই পরিচয় তারা সন্ত্রাসী। সে যে জায়গারই হোক, যে ধর্মেরই হোক তাদেরকে শাস্তির আওতায় এনে বিশ্বকে বসবাসের শান্তির জায়গায় পরিণত করতে হবে।

যাতে পরবর্তী প্রজন্ম বসবাস করতে পারে। পাশাপাশি বিশ্বমিডিয়াকেও সত্য বিষয়টিকে তুলে আনতে হবে। মুসলিম হলে সে জঙ্গী কথাটি যেমন ঠিক না, তেমনি শ্বেতাঙ্গ হলে যে,সে জঙ্গি হবে না তাও কিন্তু ঠিক না।