তপু সারোয়ার:
‘একটাই কথা আছে বাংলাতে, মুখ আর বুক বলে এক সাথে, সে হলো বন্ধু… বন্ধু আমার’ বন্ধুত্ব নিয়ে এমনই অমর অনেক গান রচনা করেছেন গীতিকার কবিরা। বন্ধুত্বকে বলা হয় স্বর্গীয় সর্ম্পক। এ বাঁধন স্বর্গীয় বাঁধন। ভাই, বোন, আত্মীয়, স্বজন আমরা জন্মসুত্রেই পেয়ে থাকি। কিন্তু বন্ধু। সৃষ্টিকর্তা বন্ধুত্ব নির্বাচনের একক স্বাধিনতা দিয়েছে। যেখানে দুই ভূবনের দুই বাসিন্দা নিজেদের সুখ, দুঃখ ভাগাভাগি করে। বন্ধুত্ব এমন এক সর্ম্পক যাকে কোন কিছুর সাথে তুলনা চলেনা। কিন্তু নারায়ণগঞ্জের কালীরবাজারের স্বর্ণ ব্যবসায়ী প্রবীর ঘোষ হত্যাকান্ডে তার বাল্য বন্ধুর সম্পৃক্ততার খবরে হতবাক শহরবাসী। তারা বলছে, বন্ধুত্বের সম্পর্কের নজীরবিহীন কালিমা লেপন করেছে পিন্টু ভৌমিক। বন্ধুত্বের মধুর সর্ম্পককে সে ছিন্ন করেছে নিন্দনীয় এক জঘণ্য বর্বরতা দিয়ে। যার নিন্দা বা ঘৃনা প্রকাশ করার মত ভাষা হারিয়েছে প্রবীর ঘোষ ও পিন্টু ভোমিকের ব্যবসায়ীক বন্ধু মহল থেকে শুরু করে শহরবাসীর সকলে। একটি হত্যাকান্ডে শোকে স্তব্দ ঐতিহ্যবাহী কালিরবাজারের স্বর্ণ পট্টির ব্যবসায়ী, হতভম্ব শহরবাসী। প্রবীর ঘোষের খুন হওয়ার ঘটনায় যতোটা না অবাক হয়েছে তার পরিবার, ব্যবসায়ী, শহরবাসী তার চেয়ে বেশী হতবাক ও বিস্মিত করেছে হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত পিন্টুর সম্পৃক্ততার খবর।
আরও বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে, ঠান্ডা মাথায় বন্ধু প্রবীর ঘোষকে হত্যার পর পিন্টু ভৌমিক ছিলেন বন্ধুকে ফিরিয়ে দেওয়ার আন্দোলনে। বন্ধু নিখোঁজের ঘটনা নিয়ে পুলিশের ভুমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে আবেগঘন জ্বালাময়ী বক্তব্যও দিয়েছেন পিন্টু। প্রবীর চন্দ্র ঘোষ নিখোঁজের পর বেশ স্বাভাবিক ছিলো ঘাতক পিন্টু ভৌমিকের আচরণ। পরদিন থেকেই খুব স্বাভাবিকভাবে মিশেছেন ব্যবসায়ী বন্ধুদের সঙ্গে। সক্রীয় ছিলেন প্রবীরকে উদ্ধারের দাবিতে হওয়া আন্দোলনেও। নিয়মিত ব্যবসায়ীক কার্যক্রম চালিয়েছেন তার প্রতিষ্ঠান ‘পিন্টু স্বর্ণ শিল্পালয়’ এ বসে। মনযোগী ছিলেন ধর্মীয় কর্মকান্ডে।
পুলিশ জানায়, নিখোঁজের পর প্রতিবাদ সভায় প্রবীরকে উদ্ধারে পুলিশের ভুমিকা নিয়ে প্রশ্নতুলে বক্তব্যও রাখে সে। প্রতিবেশি, ব্যবসায়ী বন্ধু ও পুলিশের কাছে বারবার শুনিয়েছেন একই গল্প। ঘটনার দিন প্রবীর ঘোষ তার কাছে অপর বন্ধু গোপী ও উত্তমের খবর জানতে চান। তাছাড়াও সাড়ে সাত হাজার টাকা চাইতে এসেছিলেন তিনি। তার পর থেকে আর কোন যোগাযোগ হয়নি প্রবীরের সঙ্গে।
শোকে প্রতিবাদে সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখেছেন কালিরবাজারের ব্যবসায়ীরা। কোনভাবেই যেন সহকর্মী ব্যবসায়ী প্রবীর চন্দ ঘোষের নৃসংশ হত্যাকান্ডটি মেনে নিতে পারছেন না।
শোকে মুহ্যমান পরিবারের সদস্যরা। সবচেয়ে হতবাক ও নির্বাক করেছে ঘনিষ্ঠ বন্ধুর হাতে প্রবীর চন্দ্র ঘোষের খুন হওয়ার বিষয়টি। প্রবীর ঘোষের লাশ উদ্ধারের পর থেকে তার বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। ক্ষণে ক্ষণে স্বজনদের কান্না আর আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠছে চারপাশের পরিবেশ। সন্তানের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে এমন সংবাদের পর থেকেই প্রায় বাক শক্তি হারিয়ে বসে আছেন বাবা ভোলানাথ ঘোষ। কিছুক্ষণ পর পরই প্রিয় সন্তানকে খুঁজে ফিরছেন মা। কাঁদছে প্রবীরের ১২ বছরের মেয়ে দিয়া। ছোট মেয়ে ঐশী ঠিক বুঝেই উঠতে পারছেনা তার কী করা উচিৎ। যখন মা কিংবা বোনকে খুব বেশী করে কান্না করতে দেখছে তখন সেও হঠাৎ হঠাৎ করেই সামিল হচ্ছে সেই কান্নায়। সব মিলিয়ে গুমোট এক পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে তার বাড়িতে।
বন্ধু বন্ধুকে এতোটা নৃসংশ ও নির্মমভাবে হত্যা করতে পারে? এটা বিশ্বাস করতে কস্ট হচ্ছে কালিরবাজারের স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের।
পুলিশ ও পরিবার বলছে প্রবীর ঘোষ, পিন্টু ভৌমিক, উত্তম, গোপী এই চারজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তারা সবাই কালিরবাজারে জুয়েলারী ব্যবসা করে। কিছু দিন আগে ভারতের কলকাতায় পিন্টু ভৌমিকের ওপেন হার্ট সার্জারী হয়। প্রবীর ঘোষ নিজেই ভারতে পিন্টুর চিকিৎসার জন্য সকল প্রকার সহযোগিতা করে।
হত্যাকান্ডে রহস্য উম্মোচিত করার পথে পুলিশ বলছে, প্রবীর ঘোষের এক ভাই সৌমিক ঘোষ ইতালী প্রবাসী। সেখান থেকে মোটা অংকের টাকা পাঠানো হয় প্রবীর ঘোষের কাছে। দীর্ঘদিন ধরে ওই টাকা লেনদেন হতো প্রবীর ও পিন্টুর মধ্যে। ভাইয়ের দেয়া টাকা নিয়েই প্রবীর ও পিন্টু স্বর্ণ এবং সুদের ব্যবসা করছিলেন। এই টাকার একটি বিশাল অংশ পিন্টুর কাছে গচ্ছিত ছিলো। সম্প্রতি সৌমিক ঘোষ যখন দেশে আসে তখন থেকেই নিখোঁজ ছিল প্রবীর। সৌমিক দেশে আসার আগেই টাকার জন্য পিন্টুকে চাপ দিতে থাকে প্রবীর। এসব নিয়ে তাদের মধ্যে মনোমালিন্য দেখা দেয়। পরে পরিকল্পনা করেই ১৮ জুন রাত ৯টার দিকে মোবাইল ফোনে প্রবীরকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে যায় পিন্টু। এবং ভাড়া বাসায় নিয়ে প্রবীরকে হত্যা করে পিন্টু ও তার দোকানের কর্মচারী বাপন ভৌমিক। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে পিন্টু যে বাসাতে থাকে সে বাসার ফ্লাটেই প্রবীরকে হত্যা করা হয়েছে। হত্যার পর ওই বাসার নিচে সেপটিক ট্যাংকে লাশ ব্যাগে করে ফেলে দেওয়া হয়। তিনটি ব্যাগে ভর্তি ৫ টুকরো লাশ উদ্ধার হলেও হাটুর নিন্মাংশ পাওয়া যায়নি।
এ ঘটনায় পুলিশ ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আটককৃত পিন্টু ও বাপনকে আদালতে পাঠায়। আদালত তাদের ৫ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করে।
অন্যদিকে দুই পা ছাড়াই মঙ্গলবার বিকালে মাসদাইর শ্মশানে প্রবীর ঘোষের সৎকার করা হয়।
আটককৃত পিন্টু ভৌমিক (৪৭) কুমিল্লার মেঘনা থানার চন্দনপুর এলাকার মৃত সতীশ দেবনাথের ছেলে। নারায়ণগঞ্জ শহরের ১৫ আমলাপাড়া কেসি নাগ রোডের ঠান্ডু মিয়ার বাড়িতে ভাড়া থাকে। আর বাপন ভৌমিক ওরফে বাবু (২৭) কুমিল্লার দাউদকান্দি থানার ঠেটালিয়ার কুমদ ভৌমিকের ছেলে। সে কালিলবাজার কাজী ভবনে মা স্বর্ণ শিল্পালয়ে কাজ করে।
প্রসঙ্গত, গত ১৮ জুন আনুমানিক রাত সাড়ে ৯টার সময় একটি ফোন পেয়ে প্রবীর ঘোষ নিজ বাসস্থান থেকে বের হন। এরপর থেকে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। ১৯ জুন সকাল ১০টা থেকে তার ফোন বন্ধ পাওয়ায় প্রবীর ঘোষের বাবা ভোলানাথ ঘোষ নারায়ণগঞ্জ সদর থানায় জিডি করেন। পরে একটি অপহরন মামলা হয়। মামলার তদন্ত ভার দেয়া হয় জেলা গোয়েন্দা পুলিশকে। ডিবি পুলিশ বিষয়টির তদন্ত করে পিন্টু ও বাপনকে আটক করে। এবং প্রবীর ঘোষের মোবাইল ফোন ট্র্যাকিং ও ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদে পিন্টু স্বীকার করে প্রবীর ঘোষকে হত্যার বিষয়টি। পরে তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে সোমবার রাতে শহরের আমলপাড়া এলাকার ঠান্ডু মিয়ার ৪তলা ভবনের সেফটিক ট্যাংকের ভেতর থেকে সোমবার (৯ জুলাই) রাত ১১ টার দিকে প্রবীর ঘোষের খন্ডিত লাশ উদ্ধার করা হয়।