আজ সোমবার, ১৫ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৩০শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

পাবনা ১ আসন দখলে নিতে জামায়াতের নানা কৌশল

পাবনা ১ আসন দখলে নিতে

পাবনা ১ আসন দখলে নিতে

নবকুমার

জামায়াতের বেশ কয়েক জন নেতা  মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে  ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর এবং দলটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণার প্রবল দাবির মুখে যেভাবে চাপের মুখে রয়েছে, সেখান থেকে দলটি আবারও উত্তরণের কৌশল খুঁজছে।

জামায়াতের  নতুন কৌশল বাস্তবায়নে বর্তমানে মূল কলকাঠি নাড়ছেন যুদ্ধাপরাধে দণ্ডিত হয়ে ফাঁসি হওয়া শীর্ষ তিন নেতা গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের তিন ছেলে আবদুল্লাহিল আমান আযমী, ব্যারিস্টার নাজিবুর রহমান মোমেন ও আলী মাবরুর। বর্তমানে দলের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আসে এই তিনজনের কাছ থেকে। এই তিনজনই বর্তমানে জামায়াতের মূল নিয়ন্ত্রক।

তাঁরা প্রমাণ করতে চান মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে জামায়াত নেতাদের ফাঁসি কার্যকর সঠিক নয়। এর জন্য তাঁরা বেড়া-সাঁথিয়া আসনে আগামী নির্বাচনে যেকোনো মূল্যে জিততে চান। কৌশল নির্ধারণে এই তিনজন দেশে ও দেশের বাইরে বারবার বৈঠক করছেন বলেও জানা গেছে।

নতুন কৌশলে গোপনে দলটি পাল্টাচ্ছে তাদের সাংগঠনিক কাজ ও প্রচারণার ধরন। এর জন্য তারা আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে নির্বাচনী এলাকাভিত্তিক কৌশল নিতে শুরু করেছে। এই কৌশলে বেছে নেওয়া হয়েছে জামায়াত অধ্যুষিত পাবনার বেড়া-সাঁথিয়া নির্বাচনী এলাকাকে।

স্থানীয় সাংসদের মধ্যে আওয়ামী লীগের কোন্দল, সাংগঠনিক দুর্বলতা, প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে সংকট কাটিয়ে ওঠার কৌশল নিয়েছেন জামায়াত নিয়ন্ত্রকরা।

নতুন কৌশলের আওতায় পাবনার বেড়া-সাঁথিয়ায় স্থানীয় সাংসদের কোন্দল-সাংগঠনিক দুর্বলতা ও প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তাকে ব্যবহার করে মিলাদ মাহফিল ও ইসলামী জলসাকেন্দ্রিক প্রচার-প্রচারণা চালানো হচ্ছে।

জামাতের শীর্ষ তিন নেতার তিন পুত্রের ঘনিষ্ঠ একাধিক সূত্র জানিয়েছে, আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে মতিউর রহমান নিজামীর ছেলে ব্যারিস্টার নাজিবুর রহমানকে জিতিয়ে আনার বিষয়টি। নিজামীর ছেলেকে জিতিয়ে এনে তারা প্রমাণ করতে চায় যুদ্ধাপরাধের বিচার করা হয়েছে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে। কিন্তু এর পরও দণ্ডিত নেতাদের সন্তানেরা বিপুলভাবে জনপ্রিয়।

বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গোলাম আযমের ছেলে আবদুল্লাহিল আমান আযমীর জিতে আসার মতো কোনো আসন নেই। অন্যদিকে মুজাহিদের ছেলে আলী মাবরুরের ফরিদপুর সদর আসন থেকে জিতে আসার সম্ভাবনা নেই। সে কারণে তাঁরা এসিড টেস্ট হিসেবে বেছে নিয়েছেন মতিউর রহমান নিজামীর ছেলেকে। পাবনা-১ বেড়া-সাঁথিয়া আসনে প্রার্থী করা হচ্ছে ব্যারিস্টার নাজিবুর রহমান মোমেনকে। এর জন্য এরই মধ্যে ওই নির্বাচনী এলাকায় ব্যাপক প্রচার-প্রচারণাও শুরু করেছে তারা।

পাবনার বেড়া-সাঁথিয়া নির্বাচনী এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা সাংগঠনিক ও প্রচারকাজে তাদের ধরন পাল্টেছে।

বেড়া ও সাঁথিয়ায় বর্তমানে প্রতিনিয়ত অনুষ্ঠিত হচ্ছে মিলাদ মাহফিল ও ইসলামী জলসা। সাংগঠনিক তৎপরতায় ব্যবহার করা হচ্ছে মসজিদ। নিজামীর ছেলের পক্ষে আগাম নির্বাচনী প্রচারণায় নেমেছে জামায়াতের মহিলা কর্মীরা। এই মহিলা কর্মীরা কখনো এনজিও প্রতিষ্ঠানের আড়ালে, কখনো ধাত্রী সেবার নামে, কখনো আত্মীয় বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে আশপাশের বাড়িতে প্রচারের কাজ চালাচ্ছে। বেড়া-সাঁথিয়ার একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জামায়াত দলীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে তাদের কিছু লোককে আওয়ামী লীগে যোগদান করিয়েছে। এরাই এখন জামায়াতের আশ্রয়। এ ছাড়া অর্থের বিনিময়ে ক্ষমতাসীন দলের কেউ কেউ জামায়াত নেতাদের আশ্রয় দিচ্ছে। ফলে পুলিশের ঝামেলা থেকেও তারা মুক্ত।

এসব কথা স্বীকার করে বেড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক রমজান আলী  বলেন, বেড়া-সাঁথিয়ায় জামায়াত এখন আওয়ামী লীগের ক্ষমতাবান অংশকে ব্যবহার করে নিরাপদে আছে। তারা নির্বিঘ্নে নিজামীর ছেলের পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছে। বাধা দিতে গিয়ে জামায়াতের চেয়েও বড় বিপদে আছে আওয়ামী লীগের একটি অংশ।

জামায়াতের প্রচারণা সম্পর্কে  জানতে চাইলে সাঁথিয়া উপজেলার ভুলুবাড়িয়া ইউনিয়ন জামায়াতের আমির মৌলভী হাসান আলী বলেন, ‘সাঁথিয়ায় পুলিশ কোনো ঝামেলা করে না। তার পরও আমরা প্রকাশ্যে জনসভা করি না। মিলাদ মাহফিলের অনুষ্ঠানে নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করি, দাওয়াতের কাজ করি। বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান করি।’ তিনি আরো বলেন, ‘আগামী নির্বাচনে আমাদের প্রার্থী মতিউর রহমান নিজামীর ছেলে ব্যারিস্টার নাজিবুর রহমান মোমেন। নির্বাচন হলে তিনিই জিতবেন। আমরা ব্যাপকভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমরা প্রমাণ করতে চাই, আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান নিজামী কতটা জনপ্রিয় ছিলেন।’

সাঁথিয়া উপজেলা ওলামা লীগের সভাপতি আবু শামা  বলেন, নিজামীর ছেলেকে জিতিয়ে আনতে এখানে জামায়াত ব্যাপক প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে তারা ফজরের নামাজের সময় মসজিদে নিজেদের মধ্যে কথা বলে ঠিক করে নেয় পরবর্তী দেখা করার স্থান ও সময়।

তারা ইসলামী জলসা ও মিলাদ মাহফিলের নামে দলীয় কাজ করছে। জামায়াতের মহিলা কর্মীরা গ্রুপে গ্রুপে ভাগ হয়ে বোরকার আড়ালে ছোট ছোট কোরআন শরিফ লুকিয়ে নিয়ে গ্রামের মহিলাদের হাতে কোরআন শরিফ ছুঁইয়ে নিজামীর ছেলের জন্য ভোট প্রার্থনা করছে।

গত ১২ মার্চ সাঁথিয়া জামাতিয়া হাফিজিয়া মাদরাসায় অনুষ্ঠিত এক ইসলামী জলসায় ওয়াজ করার সময় ঢাকার মাওলানা আবুল বাশার হেলালী বলেন, ‘আপনারা এমন একটি পবিত্র জায়গার ভাগ্যবান মানুষ, যেখানের নেতা নিজামী ইসলামের জন্য শহীদ হয়েছেন।’ এ কথা বলে মূলত তিনি নিজামীর ছেলের জন্য নির্বাচনী প্রচারণাই চালিয়েছেন।

অন্যদিকে আবু শামা আরো বলেন, এসব ছাড়াও নিজামীর ছেলের জয় নিশ্চিত করতে সাঁথিয়া উপজেলাকে আলাদা নির্বাচনী এলাকা করতে অর্থ খরচ করছে জামায়াত। তারা মনে করে, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ প্রার্থী হতে না পারলে তাদের বিজয় নিশ্চিত।

বেড়া উপজেলা জামায়াত আমির ডা. বাছেদ বলেন, ‘এ আসনে কেন্দ্রীয় জামায়াত ইতিমধ্যে নিজামীর ছেলেকে মনোনয়ন দিয়েছে। এখন তাঁকে জেতানোই আমাদের কাজ।’

সাঁথিয়ার মনমদপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা ডা. মুনসুর বলেন, ‘শুনছি নিজামীর ছেলে নির্বাচন করবেন। এটা তাঁর বাবার আসন। এখানে নিজামীর অনেক লোক আছে। এ ছাড়া তারা ব্যাপকভাবে প্রচারণার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।’

বেড়ার আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আমিনুল ইসলাম ডাবলু  বলেন, জামায়াতের কর্মীরা বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে নিজামীর ছেলের জন্য ভোট চাচ্ছে। তাদের মহিলা কর্মীরা মহিলা ভোটারদের হাতে কোরআন শরিফ দিয়ে শপথ করাচ্ছে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় অথচ জামায়াত টাকা খরচ করে বেড়া-সাঁথিয়ায় শিবিরকর্মী ও জামায়াত পরিবারের ছেলেদের পুলিশে ভর্তি করাচ্ছে। যেকোনো মূল্যে তারা নিজামীর ছেলেকে জিতিয়ে এনে প্রমাণ করতে চায় নিজামী গণহত্যা করেননি, যুদ্ধাপরাধ করেননি।