আজ শুক্রবার, ১৭ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৩১শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

পানিতে ডুবছে ভবিষ্যৎ

সাবিত আল হাসানঃ

মামা ভাগ্নে হাতে হাত ধরে পুকুরে গোছল ও সপ্তাহের কাপড় পরিস্কার করতে গিয়েছিলো। নিজের ছেলেমেয়েকে ভাইয়ের কাছে রাখতে স্বাভাবিক ভাবেই দ্বিধা করবে না কোন বোন। সেই ভরসা করেই হয়তো মা মামা ভাগ্নেকে পুকুর পাড়ে যেতে দিয়ে দুশ্চিন্তা করেননি। পুকুর পাড়ে মামা কাপড় ধোয়ার সময় অগোচরেই পানিতে ডুবে যায় ভাগ্নে আরিয়ান। কিছু সময় পর আরিয়ানকে পুকুর পাড়ে না দেখে মামা ভাবেন হয়তো বাড়ি চলে গেছে। কিন্তু বাড়ি ফিরে আরিয়ানকে না পেয়ে পুনরায় দৌড়ে পুকুরে যান। এক পর্যায়ে মৃত আরিয়ানকে উদ্ধার করে তারা। যেখানে মামা ভাগ্নের খুনসুটিতে জলকেলি করে ফিরে আসার কথা ছিল সেখানে ভাগ্নে ফিরলেন লাশ হয়ে।

ঘটনাটি ঘটে ২৭ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার ঝাউগাড়া গ্রামে। আরিয়ানের মত এমন অসংখ্য শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। পুরো নারায়ণগঞ্জে সবচেয়ে বেশী শিশু পানিতে ডুবে মারা যায় আড়াইহাজার উপজেলা এলাকায়। গত ৩ মাসে পানিতে ডুবে বা সাতার না জানার কারনে ৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এদের মধ্যে ৬টি মৃত্যু আড়াইহাজারে।

গত ১৪ আগস্ট আড়াইহাজারে খেলতে গিয়ে বাড়ীর পাশের ডোবার পানিতে ডুবে মৃত্যু হয় মোস্তাকিন (১০) নামে এক শিশুর। উপজেলার কামরানিরচর গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। শিশু মোস্তাকিন একই গ্রামের মৃত আজাহার উদ্দিনের ছেলে।

১ আগস্ট ঈদের দিন নারায়ণগঞ্জের বন্দরে পায়ে লেগে থাকা পশুর রক্ত পরিষ্কার করতে গিয়ে পুকুরে ডুবে মারা যায় শিশু রিয়াদ (৬)। মৃত শিশু রিয়াদ মদনগঞ্জ এলাকার রোমান মিয়ার ছেলে।

৬ জুলাই আড়াইহাজারে খেলতে গিয়ে পুকুরে ডুবে মারা যায় মালয়েশিয়া প্রবাসী কাউসারের মেয়ে সুমাইয়া (৭) ও একই গ্রামের আবদুল বাসেদের মেয়ে আরিফা। উপজেলার শ্রীনিবাসদী গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।

২৯ জুন আড়াইহাজারে ডোবার পানিতে ডুবে হাসিব (২) নামে মৃত্যু হয় এক শিশুর। উপজেলার সদর পৌরসভার গাজীপুরা গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। শিশু হাসিব একই গ্রামের আল আমিনের ছেলে।

১৮ জুন আড়াইহাজারে ডোবার পানিতে পরে মৃত্যু হয় মোস্তাকিম (২) নামে এক শিশুর। উপজেলার রায়পুরা গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। শিশু মোস্তাকিম একই গ্রামের এমদাদুল হকের ছেলে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শুধু সাঁতার না জানার কারণেই বেশির ভাগ শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। এসকল দুর্ঘটনাগুলো ঘটে সকাল নয়টা থেকে বেলা দুইটার মধ্যে। কারন সময়টিতে মায়েরা সাংসারিক কাজে ব্যস্ত থাকেন। ছেলেমেয়ের খোঁজ নেওয়া হয় না। এ কারণে এক থেকে চার বছর বয়সী শিশুরাই বেশি এ দুর্ঘটনার শিকার হয়। অধিকাংশ শিশুই বাড়ি থেকে ২০ মিটার এবং ছোট বাচ্চারা ১০ মিটার দূরত্বের কোনো পুকুর বা ডোবায় পড়ে মারা যায়। খেলতে খেলতে কিংবা গ্রামাঞ্চলে হাত-মুখ ধুতে গিয়েও অনেক দুর্ঘটনা ঘটে। ডুবে যাওয়া একটি শিশুকে আরেকটি শিশু বাঁচাতে গিয়েও দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।

এ বিষয়ে মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের নারায়ণগঞ্জ জেলার সমন্বয়ক বিল্লাল হোসেন রবিন বলেন, পানিতে ডুবে শিশুদের মৃত্যু প্রথমত দুর্ঘটনা বলতে হবে। কিন্ত যখন এর মাত্রা বেড়ে যায় তখন এই বিষয়ে সচেতন হওয়া জরুরী। গ্রাম অঞ্চলে ২টি সমস্যা দেখা দেয়। একটি হচ্ছে গ্রামের নারীরা টিভি বা মোবাইলে ডুবে থাকেন। ফলে তার সদ্য হাটতে শেখা বাচ্চাটি কার কাছে আছে, কোথায় খেলছে সেসব নজর রাখেন না। একই ভাবে গ্রামের নারীরা ৪/৫জন একত্রিত হয়ে দীর্ঘ আড্ডায় জমে থাকেন। এতে করেও তার বাচ্চা নজরের আড়ালে চলে যায়। মা হবার সাথে সাথে তাকে সতর্ক হতে হবে এবং সচেতনতার বার্তাও পৌঁছানো প্রয়োজন।

আড়াইহাজার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সোহাগ হোসেন বলেন, এটি অত্যান্ত দুঃখজনক যে নারায়ণগঞ্জে পানিতে ডুবে সবচেয়ে বেশী শিশু মৃত্যুর ঘটনা এই উপজেলায় ঘটছে। এই বিষয়টি সমাধানের জন্য আমরা যখন যেখানে যাই সেখানে মায়েদের তথা অভিভাবকদের সচেতন করার চেষ্টা করি। তাদের বলি তারা যেন নিজ ছেলেমেয়ের খেয়াল রাখে এবং সাঁতার শেখানোর উপর গুরুত্ব দেয়। এই ধরনের মৃত্যু রোধে পরিবারের সচেতনতার বিকল্প নেই। এই বিষয়টি নতুন করে আমাদের অবগত করার জন্য ধন্যবাদ, শিশু মৃত্যু রোধে আমরা আরও বেশী সচেতনতা সকলের মাঝে ছড়িয়ে দিব।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পানিতে ডুবে মৃত্যু যে পরিমান গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয় তার চেয়ে বেশী আড়ালে থেকে যায়। এসকল মৃত্যুতে হয়না কোন মামলা কিংবা পুলিশি রিপোর্ট। ঝামেলা এড়াতে বাড়ীর লোকজন দ্রুত মৃতের দাফন সম্পন্ন করে ফেলেন। এসকল মৃত্যুর হিসেব সংরক্ষন করে মৃত্যু ঠেকাতে সচেতনতা পৌঁছে দেয়া জরুরী।