ইদানীং ‘মোটিভেশনাল স্পিকার’দের জোয়ার বইছে। মাঠে-ঘাটে, অফিসে কিংবা ফেসবুকে সবাই যেন উৎসাহ দিতেই বসে আছেন। ‘জানি, তুমি পারবে’ অথবা ‘অসম্ভব বলে কিছু নেই’। এদের মূল কথা হলো, সব সময় ইতিবাচক থাকতে হবে। ব্যর্থ হলেও সেটা মেনে নেওয়া যাবে না। সেখান থেকেই ইতিবাচক কিছু একটা খুঁজে নিতে হবে। ‘না’ শব্দটিতে বড্ড আপত্তি তাদের। অথচ মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, অতি ইতিবাচক হলেই বরং জীবনে ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কা বেশি!
মনোবিদেরা বরং একটু নেতিবাচকই হতে বলছেন। একটু রক্ষণাত্মক মানসিকতা নাকি আখেরে সফলতা এনে দেয় মানুষকে! বিবিসি জানাচ্ছে, কীভাবে নেতিবাচক মানসিকতাও জীবনে ‘ইতিবাচক’ প্রভাব রাখতে পারে—
১. অতিমাত্রায় ইতিবাচক হওয়া বন্ধ করুন, এতে উল্টো ক্ষতি হয়
মনোবিজ্ঞানী অলিভার বার্কমানের দাবি, সব সময় ইতিবাচক থাকলে ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কা বেশি। স্বল্প সময়ের জন্য ইতিবাচক মানসিকতা কাজে লাগলেও দীর্ঘ ব্যাপ্তিতে এটা ক্ষতির কারণ হয়। বিবর্তনের মাধ্যমে মানুষ আজকের অবস্থানে এসেছে। তাই একজন মানুষের সব ধরনের অনুভূতিই প্রকাশ করা উচিত। তা না করে শুধু একটি নির্দিষ্ট অনুভূতিতে জোর দিলে মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত। বার্কমানের উদাহরণটি বেশ মজার, একজন মদ্যপায়ী যদি নিজেকে অনুপ্রেরণা দিতে থাকেন, ‘আমি মাতাল, তবু গাড়ি চালাতে পারব। আমার নিজের ওপর বিশ্বাস আছে।’ সেটা আসলে বিপর্যয়েই শেষ হবে।
২. নেতিবাচক মানুষেরাই সফল!
গবেষণায় দেখা গেছে, নেতিবাচক চিন্তার উকিল কিংবা চিকিৎসকেরাই সবচেয়ে বেশি সফল। এর কারণ হচ্ছে, এঁরা সব সময় খারাপ ফলাফল কী হতে পারে, সেটা ধরে নিয়ে পরিকল্পনা সাজান। ফলে ফলাফল আরও ভালো হয়। মেলবোর্নের বিখ্যাত মনোরোগের চিকিৎসক রাস হ্যারিসের দাবি, দ্বিধা কিংবা নেতিবাচক চিন্তা আসলে মানুষকে আরও ভালো করে। নেতিবাচকতার ফলে মানুষ যে কারণে ব্যর্থ হতে পারে, সেগুলোতে নজর বেশি দেয়। ফলে সফলতা আসে আরও দ্রুত।
৩. আশা করা ছেড়ে দাও
কোনো কিছুর জন্য আশা করা কিংবা সে অপেক্ষায় বসে থাকা বোকামি। বরং কোনো আশা নেই, এমনটা ধরে নিলেই নিজের সেরাটা বের হয়ে আসে মানুষের। সেরা ফলের আশা করলে সেটা পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়। আর মিথ্যা আশা তো একজনের চলার পথ একদমই রুদ্ধ করে দেয়। গ্রিক পুরাণে প্যান্ডোরার বাক্সে সব রোগ-দুঃখের সঙ্গে আশার জায়গা দেওয়াটা কিন্তু কাকতাল কিছু নয়। কারণ, মিথ্যা কিংবা অতি আশা মানুষকে রোগের চেয়েও বেশি ভোগায়।
৪. নিজেকে সুখী করতে অন্যের মুখাপেক্ষী না হওয়া
একজন মানুষ কখনো সম্পূর্ণ বদলে যায় না। অর্থাৎ, একজন হাসিখুশি মানুষ কোনো দুর্ঘটনার পর ভাবগম্ভীর হয়ে পড়েন না। উল্টোটাও হওয়া সম্ভব নয়। মানুষ সুখী হবে কি হবে না, সেটা অন্য কেউ নির্ধারণ করতে পারে না। যিনি অখুশি, তিনি দুই কারণেই অখুশি হতে পারেন—যা চাইছেন তা পাননি বলে, আর যা পেয়েছেন সেটা হারানোর ভয়! মানুষের ধারণা, সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে পারলেই সুখী মানুষে রূপ নেবেন। কিন্তু বাস্তবে তা কখনোই হয় না। সত্যি হলো, জীবনে ভালো-খারাপ সবকিছুই গ্রহণ করার মানসিকতা নিয়ে চলতে হবে। নেতিবাচক মানসিকতাকে ছুড়ে ফেলে দিলেই সুখী হওয়া সম্ভব নয়।
৫. সবকিছুতেই আনন্দ খোঁজা ঠিক নয়
সবকিছুতে ইতিবাচক খুঁজতে গিয়ে মানুষ তাঁর প্রতিটি কাজেই মজা খুঁজে নিতে চায়। কিন্তু সত্যি কথা হলো, কিছু কিছু কাজ খুবই বিরক্তিকর এবং সেটাকে সেভাবেই মেনে নেওয়া উচিত। জোর করে মজা খুঁজতে গিয়ে হিতে বিপরীত হয়। এটা জীবনের সব ক্ষেত্রেই সত্য। বরং কোনো কিছু বিরক্তিকর, এটা মেনে নিলেই সেটা দ্রুত শেষ করার প্রেরণা আসে। চিন্তাশক্তির ব্যবহার হয়, কর্মদক্ষতা বাড়ে। সব সময় শুধু ভালো নয়, খারাপ অভিজ্ঞতাকেও কাজে লাগানোর মানসিকতা থাকা উচিত।
৬. মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়াটাও খারাপ নয়
নেতিবাচক অভিজ্ঞতার চূড়ায় থাকবে মৃত্যুর অভিজ্ঞতা। মৃত্যুর কাছাকাছি চলে যাওয়ার মতো ভয়ংকর অভিজ্ঞতা আর কী হতে পারে? কিন্তু এ অভিজ্ঞতাই কিন্তু মানুষকে সফলতা এনে দিতে পারে। এমন ধাক্কা খেয়ে জীবনের নতুন অর্থ খুঁজে পান অনেকে। নিজের জীবনকে অন্য দৃষ্টিতে দেখতে শেখে মানুষ। নিজের কাজ, চিন্তাধারা, প্রিয়জনদের নিয়ে নতুন করে ভাবতে শেখে। এই নেতিবাচক পৃথিবীকেই অন্য আলোতে দেখে মানুষ। কৃতজ্ঞতা, ভালোবাসা, প্রেম, মায়ার মতো আদিম অনুভূতি আবারও জানান দেয়। যে অভিজ্ঞতা মানুষকে মনে করিয়ে দেয়, ‘জীবনটা বোধ হয় অতটা খারাপ নয়!’