আজ শুক্রবার, ১৭ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৩১শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

এসকে সিনহার বিরুদ্ধে এক ডজন অভিযোগ

এসকে সিনহার বিরুদ্ধে

এসকে সিনহার বিরুদ্ধে

সংবাদচর্চা রিপোর্ট:

সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ কুমার সিনহার বিরুদ্ধে আর্থিক ও প্রভাব বিস্তার করার অন্তত এক ডজন অভিযোগ পাওয়া গেছে। তিনি নিজের আত্মজীবনী এবং বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা নিয়ে বই লিখে নতুন করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।

সাবেক প্রধান বিচারপতি এস.কে সিনহা নিজের এবং ভাইয়ের নামে প্লট বরাদ্দে প্রভাব বিস্তার, প্লটের মূল্য পরিশোধ না করা, ১/১১ এর সময় বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সরকারের আদায় করা অর্থ পুনরায় ফেরত দিতে উৎকোচ গ্রহণ, জ্ঞাত আয় বর্হিভূত অর্থের সন্ধান, আমেরিকা-কানাডা-অস্ট্রেলিয়ায় অর্থপাচার, দুদকের তদন্তে বাধা, জজ নিয়োগে দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। গোয়েন্দা ও সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।

জানা গেছে, সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার বিরুদ্ধে রাজউকের প্লটের সরকার নির্ধারিত মূল্য পরিশোধ না করে নিয়মবহির্ভূতভাবে প্লট বরাদ্দ নেওয়া ও বাড়ি নির্মাণের অভিযোগ রয়েছে। গত ২০০৩ সালে ৩ ডিসেম্বর উত্তরার ১৫ নম্বর সেক্টরের ১ নম্বর সড়কে তিন কাঠা আয়তনের ১৫ নম্বর প্লটটি বরাদ্দ পান। কিন্তু পরবর্তীতে ব্যক্তিগতভাবে প্রভাব খাটিয়ে বরাদ্দ পাওয়া প্লটটি ২০০৪ সালের ১৩ এপ্রিল ১৫ নম্বর থেকে ১০ নম্বর সেক্টরের ১২ নম্বর সড়কের ৫১ নম্বর প্লটের সঙ্গে বদল করেন। এছাড়া, তিনি প্রভাব খাটিয়ে প্লটের আয়তন ৩ কাঠার বদলে ৫ কাঠায় পুনর্নির্ধারণ করিয়ে পুনরায় বরাদ্দ করান। কিন্তু অতিরিক্ত দুই কাঠা জমির মূল্যের জন্য রাজউক থেকে দুইবার (১৩ এপ্রিল ২০০৪ এবং ১৩ জুন ২০১৬) নোটিশ দেওয়ার পরও দাম পরিশোধ করেননি।

সূত্র বলছে, এস কে সিনহা প্রধান বিচারপতি থাকাকালে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত তিন কোটি ১৭ লাখ ৮৫ টাকা কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী মেয়েদের কাছে পাচার ও অন্যান্য কাজে ব্যবহার করেছেন। সাবেক প্রধান বিচারপতির আয়কর বিবরণী, অনিরুদ্ধ রায়ের অ্যাকাউন্টস অফিসারের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিবরণী, কানাডায় পাঠানো টাকার ব্যাংক কনফারমেশন এসএমএসের স্ক্রিন শর্ট, কানাডায় অবস্থান করা প্রধান বিচারপতির মেয়ে আশা সিনহার দ্বারা অর্থপ্রাপ্তির স্বীকৃতির এসএমএস, অস্ট্রেলিয়ায় পাঠানো অর্থের কনফারমেশন ই-মেইল, ইন্দোনেশিয়ার পেনিন ব্যাংক হতে অস্ট্রেলিয়ায় সূচনা সিনহার অ্যাকাউন্টে পাঠানো অর্থের ডিপোজিট ফর্ম থেকে এসব অর্থপাচার ও জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের তথ্য জানা গেছে।

সূত্র জানায়, ১/১১ এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ১ হাজার ২৩১ কোটি ৯৫ লাখ ৬৪ হাজার ৯২৫ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা করা হয়। পরবর্তীতে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসলে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান হাইকোর্টে পৃথক রিট আবেদন করে। রিটের রায়ে সরকারের আদায় করা অর্থের কিছু অংশ অর্থাৎ ৬১৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকা ৯০ দিনের মধ্যে ফেরত দেওয়ার আদেশের বিনিময়ে প্রায় ৬০ কোটি টাকা উৎকোচ গ্রহণ করেন তিনি।

সূত্র জানায়, সাবেক প্রধান বিচারপতি ভুয়া অ্যাকাউন্ট তৈরি করে তারই নিজস্ব কিছু লোক দিয়ে মামলার তদবির করিয়ে এসব অর্থ উপার্জন করেন। বিশ্বস্ত লোকদের মধ্যে রয়েছেন বাংলাদেশি ব্যবসায়ী অনিরুদ্ধ কুমার রায়, সিঙ্গাপুর প্রবাসী বাংলাদেশি নাগরিক রণজিৎ, কানাডা প্রবাসী অভিবাসন আইনজীবী মেজর (অব.) সুধীর সাহা। এদের মাধ্যমে তিনি মানি লন্ডারিং করে বিদেশে এসব টাকা পাঠান।

সূত্র জানায়, আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের বিরুদ্ধে দুদকের একটি গুরুতর অসদাচরণ সংক্রান্ত অপরাধের তদন্ত করা হচ্ছিল। ওই তদন্তে তিনি বাধার সৃষ্টি করেছিলেন। চিঠি দিয়ে তিনি দুদকের তদন্ত কর্মকর্তাকে তদন্ত না করার নির্দেশ দেন। এভাবে সাবেক এই প্রধান বিচারপতি বিভিন্ন রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছিলেন। প্রধান বিচারপতি থাকাকালে তিনি জাপানে একটি সেমিনারে গিয়ে বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হবে বলে বক্তব্য দেন। এছাড়া, তিনি বিগত সংসদে বিনা ভোটে নির্বাচিত ১৫৩ জন সংসদ সদস্যের পদ বাতিলের জন্য পরিকল্পনা করেছিলেন। একজন আইনজীবীকে দিয়ে রিট আবেদন করানোর পরিকল্পনা ছিল তার।

সূত্র জানায়, সুপ্রিম কোর্টের সামনে থেকে মূর্তি অপসারণের বিষয়ে ইতোপূর্বে ইসলামি দলগুলো দাবি জানিয়ে আসলেও মূর্তি অপসারণ করে পুনরায় তা এনেক্স ভবনের সামনে প্রতিস্থাপন করে অরাজক পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা করেছিলেন এস কে সিনহা। এছাড়া, সরকারই জাতীয় সংসদের প্রতি আস্থা রাখতে পারছে না বলে বিতর্কিত মন্তব্য করেন। ২০১৭ সালের ২৩ মে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণ ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল থেকে সংসদের হাতে প্রদান করে আনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল শুনানিতে তিনি এ মন্তব্য করেন।

প্রসঙ্গত, ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় এবং কিছু পর্যবেক্ষণের কারণে ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ নেতাকর্মীদের তোপের মুখে ২০১৭ সালের অক্টোবরের শুরুতে ছুটিতে যান সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। সেসময় সরকারের পক্ষ থেকে অসুস্থতার কথা বলা হলেও ১৩ অক্টেবর বিদেশে যাওয়ার আগে সাংবাদিকদের বিচারপতি সিনহা জানান, তিনি অসুস্থ নন, ক্ষমতাসীনদের সমালোচনায় বিব্রত হয়ে তিনি বিদেশ যাচ্ছেন ।

গত বছরের ১১ নভেম্বর তার ছুটির মেয়াদ শেষ হলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, বিচারপতি সিনহা পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিয়েছেন। পদত্যাগ করার পর বিচারপতি সিনহার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অর্থপাচার, আর্থিক অনিয়ম ও নৈতিক স্খলনসহ সুনির্দিষ্ট ১১টি অভিযোগ ওঠার কথা সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে জানানো হয়। বলা হয়, ওইসব অভিযোগের কারণে আপিল বিভাগের অন্য বিচারকরা আর প্রধান বিচারপতির সঙ্গে বসে মামলা নিষ্পত্তিতে রাজি নন।