এ্যাডঃ তৈমূর আলম খন্দকার: বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। অপরাধ প্রবনতা বিশেষ করে অনৈতিক অপরাধ যে ভাবে বৃদ্ধি পেয়ে সমাজের সর্বত্র মহামারী আকার ধারন করেছে তাতে মনে হচ্ছে যে, জনসংখ্যার মূলশ্রোতের একটি বড় অংশ অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। অপরাধের ধরন এবং পদ্ধতি দিন দিন অপ-গ্রেডেড হচ্ছে। অপরাধ দমনের আইন যেমন দিন দিন কঠিন হচ্ছে ঠিক তেমনি অপরাধ করার প্রবনতা ও পদ্ধতি পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। বায়ু পথে বাতাস ঠুকিয়ে হত্যা করার কাহিনী ইতোপূর্বে শোনা যায় নাই। কিন্তু বছর ২/১ এর মধ্যে এ ধরনের কয়েকটি কান্ড ঘটে গেল যা এখন হত্যার একটি পদ্ধতি হিসাবে ব্যবহার হচ্ছে। দন্ড বিধি আইন প্রনীত হয় ১৮৬০ সালে যাতে অপরাধের সঙ্গা ও শাস্তির বিধান সুর্নিদিষ্ট করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে অপরাধের ক্যাটাগরীকে আরো সুর্নিদিষ্ট করে সময়ে সময়ে স্পেশাল ল (Special Law) প্রনয়ন করা হয়েছে এবং আদালতের প্রকার ভেদে বিচার ব্যবস্থার বিধান রাখা হয়। ১৮৬০ সালে প্রনীত দন্ড বিধিতে ৫১১টি অপরাধের সঙ্গা ও শাস্তি উল্লেখ রয়েছে, এমন কি Un-Natural Offence এর শান্তির কথাও দন্ডবিধি ৩৭৭ ধারায় উল্লেখিত রয়েছে। কিন্তু বায়ু পথে বাতাস ঢুকিয়ে হত্যা করা অপরাধ সংক্রান্ত কোন সুর্নিদিষ্টভাবে দন্ড বিধি বা পরবর্তীতে প্রনীত কোন আইনে উল্লেখ নাই। অর্থাৎ আইন প্রনেতাদের মাথায় যে অপরাধ ধরনের কথা খেয়ালে আসে নাই সে অপরাধ এখন সংগঠিত হচ্ছে। এ জন্য পুলিশী ঝামেলা বা খুনের অপরাধে দন্ডিত হওয়ার কথা জেনেও অপরাধের পুনবৃত্তি হচ্ছে। নারী স্বাধীনতা, নারী নেতৃত্ব, নারী স্বনির্ভরতার কথা যতই আড়ও হচ্ছে ধর্ষণ ততই দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে যার প্রসার এখন শিশু থেকে পৌড় পর্যন্ত। বার্থ ডে পার্টীতে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে ধর্ষণের ক্ষেত্রে (অর্থাৎ ধর্ষণ জগতে) এক নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। যে সকল মেয়েরা হোটেলে বার্থ ডে পার্টী করতে যেয়ে রাত্রি যাপনে ধর্ষিতা হয় তাদের বা তাদের অভিবাবকদের কি এ মর্মে কোন দায়িত্ব জ্ঞান নাই? নিজেকে ধর্ষণ থেকে রক্ষা পাওয়ার একটু সচেতনা কি কারো বিবেককে ধাক্কা দেয় না? “Buyer Resposibility” বলতে ক্রয় বিক্রয়ের ক্ষেত্রে একটি আইনগত কথা (Legal Term) রয়েছে। যাচাই বাছাই ও পরখ করে মালামাল ক্রয় করা ক্রেতার দায়িত্ব। হোটেলে দাওয়াত গ্রহণ এর Resposibility অর্থাৎ দায় দায়িত্ব সম্পর্কে যারা Victim বা তাদের অভিবাবকরা কেন উদাসীন? এটা কি আধুনিকতার প্রভাব না নৈতিকতার অভাব?
শুধুমাত্র কি আইন প্রণয়ন করে অপরাধ দমন করা যাবে? জাতীয় সংসদ তো কঠিন কঠিন আইন প্রণয়নের একটি ফ্যাকটরীতে পরিনত হয়েছে। থানার সংখ্যা, পুলিশের সংখ্যা, পুলিশের ক্ষমতা, পুলিশী আধুনিকায়তন সবইতো জ্যামেতিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ঢাকা শহরে গত ৫ বৎসরে থানার সংখ্যা প্রায় দ্বিগুন করা হয়েছে তারপরও অপরাধের সংখ্যাও বিশেষ করে অনৈতিক অপরাধ যা কোরান শরীফের ভাষায় অশ্লীল তাও জ্যামেতিক হারেই পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে কেন? এ বিষয়গুলি একটু গভীর ভাবে খতিয়ে দেখা দরকার এবং এ জন্য শুধু পাবলিসিটির জন্য নহে বরং সমস্যার সমাধানের জন্য বিষয়টির উপর মনোনিবেশ হওয়া বাঞ্চনীয়। বৈবাহিক সম্পর্ক ছাড়া একটি ছেলে একজন মেয়েকে নিয়ে হোটেলে ঢুকবে, দরজা বন্ধ করে নাচানাচি করবে, মদ্যপান করবে এতে কোন অপরাধ হবে না বরং তাকে ধর্ষণ করা মাত্রই থানা পুলিশ কোর্ট কাচারী এসে উপস্থিত হবে এটা কি কোন যুক্তি সমর্থন করে? ধর্ষণের সূচনা যেখানে সেখানের পথরূদ্দ করতে হবে।
রাতের অন্ধকারে গভীর জঙ্গলে একাকী অবস্থায় একজন নারীকে একজন লোলপ দৃষ্টি পুরুষের হাত থেকে বাচানোর একমাত্র অস্ত্র নৈতিকতা, কিন্তু সে নৈতিক শিক্ষাই এখন অনুপস্থিত। ধর্মীয় শিক্ষা বা ধর্মীয় পুস্তকে নৈতিকতার উপর জোড় দিলেও ধর্ম শিক্ষা তো দূরের কথা বরং ইসলামিক ধর্মীয় বই বাড়ীতে রাখাও ঝুকিপূর্ণ এ কারণে যে পুলিশ যে বাড়ীতে ইসলামী ধর্মীয় বই পায় সেখানে জেহাদী বই পাওয়া গেছে বলে গ্রেপ্তার ও সন্ত্রাস দমন আইনে মামলা চালু করে দেয় যার কোন জামিন নাই। অথচ এ ধরনের ধর্মীয় বই কারাগারের লাইব্রেরীতে পেয়েছিলাম যখন আমি দীর্ঘ কারাবাসে নিয়মিত বই পড়তাম; যাকে পুলিশ এখন জেহাদী বই বলে। তবে নিরস্ত্র মানুষের উপর বোমা নিক্ষেপ বা ভিন্ন ধর্মের মানুষকে হত্যা বা কোন কারণেই বিচার বর্হিভুত হত্যা জেহাদ নহে। নিজের পাশবিকতার বিরুদ্ধে নৈতিকতার বিজয়ই শ্রেষ্ঠ জেহাদ। তাই শ্রেষ্ঠ জেহাদ অর্জন করতে হলে নিজের অপশক্তির বিরুদ্ধে নিজেকে জেহাদ করতে হবে ন্যায় ও নৈতিকতার পক্ষে। কিন্তু সে সুযোগ কোথায়?
বর্তমান যুগ ডিজিটালের যুগ, ডিজিটালের প্রভাবে বর্তমান প্রজন্ম নেট, ইন্টারনেট, ফেইস বুকসহ বিভিন্ন যান্ত্রিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারে অভ্যস্ত। এ মাধ্যমগুলি কি নৈতিকতা শিক্ষা দিচ্ছে না যুব সমাজকে বিপরীত দিকে ধাবমান করছে? এদের অভিবাবকরা অর্থের প্রভাবে এখন মেকী আধুনিতার ছোয়া পাওয়া ও সমাজে নিজেকে আধুনিকতার কেউ কেটা হিসেবে পরিচিত লাভের জন্য নৈতিকতাকে Back Dated মনে করে আধুনিকতার আগুনে ঝাপ দেয়ার আগে পর্যন্ত বুঝতে পারে না যে কোথায় তাদের গন্তব্য স্থল। রেইনট্রী হোটেলের ঘটনার পর ধর্ষকের পিতা আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার হোসেন সেলিমের মিডিয়াতে দেয়া বক্তব্যই প্রমাণ করে যে, অর্থের বিনিময়ে তারা “আধুনিকতা” বরন করেছে নৈতিকতাকে দূরে ঠেলে দিয়ে।
আমাদের আকাশ সংস্কৃতি কি নৈতিকতাকে গুরুত্ব দেয়? না দেয়ার কারণ হলো তাদের ব্যবসা। হিরোইন, ফ্যান্সিডীল, ইয়াবা, মদ, গাজা প্রভৃতি মাদক যেমন প্রজন্মকে ধ্বংস করে দিচ্ছে, অন্যদিকে এ ধ্বংসলীলাকে এক ধাপ এগিয়ে নিচ্ছে আমাদের আকাশ সংস্কৃতি।
লেখক
কলামিষ্ট ও সাবেক সিনেটর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
এবং বিএনপি’র চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা
মোবাঃ ০১৭১১-৫৬১৪৫৬
E-mail: taimuralamkhandaker@gmail.com