মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন :
কোটা সংস্কার আন্দোলন করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছে বেশ কয়েকজন মানুষ। মেট্রোরেল, বাংলাদেশ টেলিভিশন, ফ্লাইওভারের টোলপ্লাজা, সেতু ভবনসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। জ্বালিয়ে ছারখার করে দেয় দুই শতাধিক সরকারি-বেসরকারি গাড়ি। নরসিংদীর কারাগারের গেট ভেঙে দেয় দুষ্কৃতকারীরা। পালিয়ে যায় আট শতাধিক সাজাপ্রাপ্ত কারাবন্দি।
আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে মিশে থাকা সন্ত্রাসীরা চার-পাঁচ তলার ছাদ থেকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে হত্যা করেছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীকে। হত্যা করেছে কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যকে। সারা দেশে চালিয়েছে ন্যক্কারজনক তাণ্ডব। নাশকতা ও হত্যাকাণ্ড ঠেকাতে ২০ জুলাই রাত ১২টা থেকে দেশব্যাপী কারফিউ জারি করা হয়। নামানো হয় সেনাবাহিনী। সারা দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে র্যাব-পুলিশের পাশাপাশি বিজিবি ও আনসার মোতায়েন করা হয়। নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িতদের দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দেওয়া হয়।
২১ জুলাই ২০২৪ হাইকোর্টের রায় বাতিল করে মেধার ভিত্তিতে ৯৩ ভাগ চাকরির সুযোগ রেখে রায় দেয় আপিল বিভাগ। মুক্তিযোদ্ধা, শহিদ মুক্তিযোদ্ধা, বীরাঙ্গনা ও তাদের সন্তানদের জন্য ৫ ভাগ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ১ ভাগ, প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গ ১ ভাগ মিলে কোটা থাকছে মাত্র ৭ ভাগ। নারী ও জেলা কোটা তুলে দিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত। সংবিধানের ১০৪ ধারার ক্ষমতা বলে আদালত ৯৩ ভাগ চাকরির সুযোগ মেধাবীদের জন্য নির্ধারণ করে দেন। কোটা আন্দোলনে প্রাণহানির ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেন আপিল বিভাগ। মৃত্যুর প্রতিটি ঘটনা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে আশা সর্বোচ্চ আদালতের। ২২ জুলাই ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতমিনিময় সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, কোটা আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। জামায়াত-শিবিরের পরিকল্পনায় বিএনপির মদদে চালানো হয়েছে ধ্বংসযজ্ঞ।
তিনি বলেন, যত আইকনিক স্থাপনা করে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছিলাম, তা পরিকল্পিতভাবে নষ্ট করা হয়েছে। এবার সহজে ছেড়ে দেওয়া হবে না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আগুন সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নাশকতাকারীদের দমন করে দেশের পরিবেশ স্বাভাবিক করা হবে। বাংলাদেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীরা নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে, জানমালের ক্ষতি করে দুর্বৃত্তরা দেশকে যেভাবে ধ্বংস করেছে তার সুষ্ঠু বিচার দাবি করেন। কোটা নিয়ে আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের মূল দাবি মেনে নেওয়ার পর তারা ঘরে ফিরে যায়। তুলে নেয় কমপ্লিট শাটডাউন।
প্রশ্ন জাগে এই আন্দোলনের নেপথ্যে আসলে কারা আছে? ছাত্ররা এত পরিকল্পিত আন্দোলন করতে পারে তা অনেকেরই বিশ্বাস হচ্ছে না। আসলে কোটা আন্দোলনের শুরু থেকেই একটা সন্দেহ সবার মনে দানা বেঁধে ছিল। আন্দোলনটা আসলে কারা করছে? কারা করাচ্ছে?
বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন তার বক্তৃতায় বারবার বলেছেন আন্দোলনের নেপথ্যে আছে জামায়াত-শিবির-বিএনপি। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও একই কথা বলেছেন। আন্দোলনকারীদের চেহারা ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলে এর সত্যতা পাওয়া যায়। প্রায় প্রতিটি চেহারাতেই কোনো একটা ক্যাডারভিত্তিক দলের নেতাকর্মীর ছাপ পাওয়া যায়। তাদের কর্মকাণ্ডও ক্যাডারভিত্তিক দলের মতো।
বাংলাদেশের মানুষের বুঝতে এতটুকু বাকি নেই এই কর্মকাণ্ড জামায়াত-শিবির-বিএনপি করছে। দীর্ঘদিনের পরিকল্পনার ফসল এই কোটাবিরোধী আন্দোলন। তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে সাধারণ ছাত্রছাত্রীকে। তারা জানেই না পরিকল্পনাকারীদের আসল উদ্দেশ্য কী।
কোটার ব্যাপারে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের পর আন্দোলন থেমে যাবে এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু বিপথগামী কিছু মানুষ এখনও চালাচ্ছে হামলা, করছে ভাঙচুর। বোঝা যাচ্ছে তাদের মূল উদ্দেশ্য অন্য কিছু। ইতিমধ্যে এর বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বের করে দিয়ে তথাকথিত আন্দোলনকারীরা নিজ নিজ দখলে নিয়েছে। তারা যে সাধারণ ছাত্র নয় হল দখলের মধ্য দিয়ে তা প্রমাণিত হলো। কোটা সংস্কারের নামে তারা আন্দোলন শুরু করেছে। সে আন্দোলনকে রূপ দিয়েছে হল দখলে।
নানারকম আপত্তিকর স্লোগান তুলে বুঝিয়ে দিয়েছে তারা সাধারণ ছাত্রছাত্রী নয়। তাদের আছে রাজনৈতিক পরিচয়। সরাসরি বললে তারা জামায়াত-শিবির-বিএনপি। তাদের পেছনে আছে বড় ভাই। বড় ভাইয়েরা এসি রুমে বসে ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে দেশকে অরাজক অবস্থার দিকে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করেছে।
অন্য কোনো উপায়ে রাজনীতির মাঠ গরম করতে না পেরে বেছে নিয়েছে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে। অবশ্যই এই আন্দোলনের জন্য তারা হোমওয়ার্ক করেছে বছরের পর বছর। পরিকল্পিত এই আন্দোলনের হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে ছাত্রছাত্রীদের মাঠে নামিয়ে জানমালের ক্ষতি করেছে। সরকারকে ব্যর্থ প্রমাণের চেষ্টা করেছে।
১৯৭১ সালের পরাজিত শক্তি এভাবেই সব ব্যাপারে রাজনীতি টেনে নিয়ে এসে একটা অরাজক অবস্থার সৃষ্টি করে। যার খেসারত দিতে হয় দেশবাসীকে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তারা ঠিক এ রকম ভূমিকাই পালন করেছিল। নিজের দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি মানুষের দরদ থাকে। যারা কখনোই বাংলাদেশকে নিজের দেশ মনে করেনি তারা বা তাদের সন্তানরা বাংলাদেশকে ভালোবাসতে পারে না। এর বড় প্রমাণ কোটা সংস্কার আন্দোলনকে হল দখল ও দেশকে অরাজক অবস্থার দিকে ঠেলে দেওয়ার আন্দোলনে রূপদানের চেষ্টা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথাকে ভুল ব্যাখ্যা করে আন্দোলনকারী জামায়াত-শিবির-বিএনপির লোকেরা দেশের সাধারণ মানুষকে খেপিয়ে তোলার চেষ্টা করেছে। সাধারণ মানুষকে সরকারের বিপক্ষে দাঁড় করানোর পাঁয়তারা করেছে।
ফেসবুক-ইউটিউবসহ বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়াতে নানারকম অপপ্রচার করে দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে। মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কটাক্ষ করে নানারকম ট্রল তৈরি করে রাষ্ট্রদ্রোহী কার্যকলাপ করছে অবিরত। সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টে দেশের এসব শত্রুর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। দেশকে নৈরাজ্যের দিকে ঠেলে দেওয়ার অধিকার কারও নেই। মৌলিক মানবিক অধিকার পাওয়ার অধিকার একটি দেশের সব নাগরিকের আছে। কিন্তু অধিকার আদায়ের নামে জানমালের ক্ষতি করার বা সহিংসতা করার অধিকার কারও নেই।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে মিশে থাকা দুর্বৃত্তরা সহিংস আন্দোলন করেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীকে কাজে বাধা দিয়েছে। তাদের মারধর করেছে। বিভিন্ন স্থাপনায় গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেছে। মানুষের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। এককথায় যা মনে চেয়েছে তাই করেছে।
লাখো শহিদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশে এই কয়েক দিন জামায়াত-শিবির-বিএনপি যা করেছে, এখনও যা করছে তার অবশ্যই বিচার ও শাস্তি হতে হবে।
সরকারি তথ্য বলছে, ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত ২০ শতাংশ পদে মেধার ও বাকি ৮০ শতাংশ পদে কোটায় নিয়োগ হতো। ১৯৭৬ সালে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ ৪০ শতাংশ বাড়ানো হয়। ১৯৮৫ সাল থেকে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদে ৪৫ শতাংশ মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ হতো। বাকি ৫৫ শতাংশ অগ্রাধিকার কোটায় নিয়োগ হতো। যেখানে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা, ১০ শতাংশ নারী, ১০ শতাংশ জেলা কোটা ও ৫ শতাংশ ক্ষুদ্র ও জাতিগোষ্ঠী কোটা।
পরে ১ শতাংশ প্রতিবন্ধী কোটা যুক্ত করে ৫৬ শতাংশ অগ্রাধিকার কোটায় নিয়োগ দেওয়া হয়। যা ২০১৮ সাল পর্যন্ত চলে। শুরু থেকে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ছিল। পরে ওই কোটার অধীনে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের যুক্ত করা হয়।
কোটা নিয়ে আন্দোলনের নামে জ্বালাও-পোড়াও, দেশের সম্পদ নষ্ট করা রীতিমতো গর্হিত অপরাধ। এখনও দুষ্কৃতকারীরা যে তাণ্ডব চালাচ্ছে তাতে দেশের ক্ষতি হচ্ছে। ক্ষতি হচ্ছে জানমালের। আন্দোলনের নামে মানুষের হাত-পায়ের রগ কেটে দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে। পথচারী, দোকানদারদের ওপর আক্রমণ করা হচ্ছে। লাঞ্ছিত করা হচ্ছে সম্মানিত শিক্ষকদের। এ কীসের আলামত?
আন্দোলনকারী কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সন্ত্রাসীরা অনুপ্রবেশ করে চালাচ্ছে বিভিন্ন তাণ্ডব। বিপাকে পড়ছে শিক্ষার্থীরা। কোন দিকের ঘটনা কোন দিকে গড়াচ্ছে তা সহজ-সরল শিক্ষার্থীরা বুঝতে পারছে না। তাদের ব্যবহার করে ফায়দা লুটছে একটি কুচক্রী মহল। শিক্ষামন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন যে, ছাত্রছাত্রীরা ক্লাসে ফিরে গেলে তাদের বিরুদ্ধে কোনো আইনি বা প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে না। তিনি তাদের আগের মতো মনোযোগের সঙ্গে পড়ালেখা করার পরামর্শ দেন। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে একাত্তরের পরাজিত শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের শুরুতেই ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি দেওয়া হয়েছিল। বাংলা ব্লকেড শব্দটা নিয়ে চিন্তাভাবনা, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করার অবকাশ আছে। অনেক ‘কেন’ মনের ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে। একটা কেনরও সঠিক জবাব পাচ্ছি না। একটা জাতীয় ইস্যু যখন আন্তর্জাতিক ইস্যুতে রূপ নেয় তখন উত্তর পাওয়াটা কঠিন হয়ে যায়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের জন্য অপেক্ষা করার কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, তার বিশ্বাস ছাত্রছাত্রীরা উচ্চ আদালত থেকে ন্যায়বিচার পাবে। প্রধানমন্ত্রীর কথা মতোই ছাত্রছাত্রীরা ন্যায়বিচার পেয়েছে। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছিলেন, আন্দোলনের নামে হত্যা লুটপাট যারা করছে তাদের উপযুক্ত শাস্তির আওতায় আনা হবে। তিনি বিচার বিভাগীয় তদন্তের কথা উল্লেখ করেন।
এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের নেপথ্যে কারা? তাদের খুঁজে বের করতেই হবে। আনতে হবে আইন ও বিচারের আওতায়।
ছাত্রছাত্রীদের দাবি মোতাবেকই সর্বোচ্চ আদালতের রায় হয়েছে। বলা যায় তারা যা চেয়েছিল তার চেয়ে বেশি পেয়েছে। তারপরও কেন দেশে চলছে সহিংসতা, ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড? এসব ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের নেপথ্যে কারা? তাদের আসল মোটিভ কী? দেশি-বিদেশি কী চক্রান্ত আছে এর পেছনে? নীবিড়ভাবে তলিয়ে দেখে, গভীরভাবে তদন্ত করে তা বের করতেই হবে। বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে যারা ছিনিমিনি খেলার চেষ্টা করছে তাদের চিহ্নিত করতেই হবে। যে করেই হোক কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। আনতে হবে বিচার আওতায়। করতে হবে যথোপযুক্ত বিচার।
সাংবাদিক ও লেখক