আজ বৃহস্পতিবার, ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

কার স্বার্থে নির্বাচনহীন সদর

সংবাদচর্চা রিপোর্ট :

নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাচন না হওয়ায় সাধারণ মানুষের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ সিনিয়র নেতারাও ক্ষুব্ধ। এক নির্বাচনে বিএনপি ঘরানার চেয়ারম্যান ষোল বছর ধরে একই পদ আকড়ে থাকায় যারপরনাই ক্ষুব্ধ ক্ষমতাসীন দলের এসব নেতারা।
অন্যদিকে নির্বাচন না হওয়াতে সাধারণ মানুষ উন্নয়ন বঞ্চিত হওয়ায় দীর্ঘ পনের বছর ধরেই ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করে আসছেন। তারা বর্তমান চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ বিশ^াসকে পুতুল চেয়ারম্যান হিসেবে তুলনা করছেন। একই সঙ্গে তিনি এই পদে থেকে নিজে উপকৃত হলেও সাধারণ মানুষের কোনো কাজে আসছেন জানিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেকে।
এদিকে জেলার সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ আইন শৃঙ্খলা কমিটির মাসিক সভাতেও সদর উপজেলা পরিষদের নির্বাচন না হওয়া নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাই। মামলা করিয়ে নির্বাচন কেন বন্ধ রাখা হয়েছে সে বিষয়েও তিনি জানতে চেয়েছেন সংশ্লিষ্টদের কাছে। এই সভায় উপজেলার বর্তমান চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ বিশ^াসও উপস্থিত ছিলেন। মূলত মামলা দায়ের করার নেপথ্যের কারিগর হিসেবে তার দিকেই তীর ছুড়েন আওয়ামী লীগের ওই বর্ষিয়ান নেতা।
আবদুল হাই বলেন, নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলাবাসী ৫ বছরের জন্য উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত করেছিলো কিন্তু বর্তমান চেয়ারম্যান ১৬ বছর যাবৎ সেই চেয়ারে বসে দায়িত্ব পালন করছেন। নিজ স্বার্থে ছোট একটি মামলা দায়ের করে বছরের পর বছর নির্বাচন বন্ধ রাখা হয়েছে।
সর্বশেষ ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সে সময় বিএনপি নেতা আবুল কালাম আজাদ বিশ্বাস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এরপর ২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন গঠিত হলে সদর উপজেলার কিছু অংশ সিটি করপোরেশনে চলে যায়। উপজেলা পরিষদ আইন ১৯৯৮ (২০০৯ সনের ৩০ জুন সংশোধিত) এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সরকার সদর উপজেলা পুনর্গঠন করে। ২০১৪ সালের ৪ মার্চ এ সংক্রান্ত একটি গেজেট প্রকাশ করা হয়।
সীমানা সংক্রান্ত ওই জটিলতা প্রসঙ্গে সদর উপজেলার তিন বাসিন্দা উচ্চ আদালতে পৃথক মামলা দায়ের করেন। ফলে মামলা সংক্রান্ত জটিলতায় সে বছর জেলার অন্যান্য উপজেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও স্থগিত হয়ে যায় সদর উপজেলা নির্বাচন। অভিযোগ ছিল যারা মামলার বাদি হয়েছেন তারা সকলেই সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ বিশ^াসের লোক। আড়ালে থেকে তিনিই ওই তিন ব্যক্তিকে দিয়ে ওই মামলা দায়ের করিয়েছিলেন। যদিও পরবর্তীতে আবুল কালাম আজাদ বিশ^াস অস্বীকার করে জানিয়েছিলেন, যারা মামলা করেছেন তাদেরকে তিনি চিনেন না, বাদি যারা হয়েছেন তারা কেউই তার লোক নন।
তথ্য মতে, দীর্ঘ পনের বছর ধরে আইনী জটিলতায় স্থগিত ছিল নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাচন। তবে আইনী জটিলতার অবসান হওয়ায় চলতি বছরের ২১ মার্চ নির্বাচন কমিশন সদর উপজেলার নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করে। সে অনুযায়ি ৮ মে এখানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। প্রার্থীরা ব্যাপক প্রস্তুতিও শুরু করে। দীর্ঘদিন পর এখানে নির্বাচনী পরিবেশ তৈরি হওয়ায় সবার মাঝেই ছিল একটা উৎসবের আমেজ। কিন্তু সেই আমেজে ভাটা পড়ে মাত্র কয়েকদিনের মাথায়। ফের আইনী জটিলতায় স্থগিত হয়ে যায় বহুল কাক্সিক্ষত এই উপজেলা নির্বাচন।
সূত্র জানায়, ৯ এপ্রিল নির্বাচন কমিশনের নির্বাচন পরিচালনা শাখার উপসচিব মো. আতিয়ার রহমান স্বাক্ষরিত একটি চিঠিতে নির্বাচন স্থগিতের কথা জানান। চিঠিতে বলা হয়, ‘আপিল বিভাগ কর্তৃক সিএমপি নং ৬৯৫/২০২২ এর ২৭ মার্চ ২০২৪ তারিখের আদেশ প্রতিপালনার্থে আগামী ৮ মে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া জেলার নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা পরিষদ সাধারণ নির্বাচন স্থগিত রাখার আইনগত বাধ্যবাধকতা রয়েছে মর্মে নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত দিয়েছে।’
ওইদিন নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ জানিয়েছিলেন, ‘আগে থেকেই এ উপজেলার নির্বাচনের ওপর স্থগিতাদেশ ছিল। বিষয়টি কবশিমনের দৃষ্টিগোচর হওয়ায় আইনি বাধ্যবাধকতা থাকায় এ উপজেলার তফসিল বাতিল হবে। পরে নতুন করে তফসিল ঘোষণা করা হবে।’
এদিকে নির্বাচনী পরিবেশ তৈরি হওয়া বেশ সরব হয়ে উঠেছিলেন সম্ভাব্য চেয়ারম্যান প্রার্থীরা। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন, নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শাহ্ নিজাম, মহানগর যুবলীগের সভাপতি সাজনু, পরিবহণ নেতা ইব্রাহীম চেঙ্গিস এবং সদর উপজেলা পরিষদের বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান নাজিম উদ্দিন।
তবে, এই নির্বাচনে যারা প্রার্থী হিসেবে মাঠে সক্রিয় ছিলেন তারা সবাই সাংসদ শামীম ওসমান অনুগামি। সে হিসেবে থানা আওয়ামী লীগের নেতারা শামীম ওসমানকেই একক প্রার্থী নির্ধারণ করার জন্য অনুরোধ করেন। তবে এই প্রার্থী নির্ধারণ নিয়ে শামীম ওসমান বলয়ে জটিলতা দেখা দেয়।
সাংসদ ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো জানিয়েছে, যে চারজন প্রার্থী হিসেবে আলোচনায় ছিলেন তাদের মধ্যে সর্বোচ্চ আলোচিত ছিলেন শাহ্ নিজাম ও শাহাদাৎ হোসেন ভূঁইয়া সাজনু। তবে তাদের মধ্যে শামীম ওসমান মনস্তাত্ত্বিকভাবে শাহ্ নিজামকেই সমর্থন দিবেনÑ এমন আলোচনা ছিল সবার মুখে মুখে। এমন যখন পরিস্থিতি, তখন প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা গোলাম সারোয়ারের ছোট ভাই ও মহানগর যুবলীগের সভাপতি শাহাদাৎ হোসেন ভূঁইয়া সাজনু নিজের সিদ্ধান্তে অনড় থাকবেন বলে শোনা যায়। এ নিয়ে নিজাম ও সাজনুর মধ্যে বাগযুদ্ধও দেখা দেয়। এতে করে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে যান সাংসদ শামীম ওসমান। কাশিপুরে আওয়ামী লীগের একটি বর্ধিত সভাতেও তিনি সেই বিব্রতকর পরিস্থিতির কথা জানিয়েছিলেন।
এদিকে শাহ্ নিজাম ও সাজনু দুজনই যদি নির্বাচনে প্রার্থী হোন তবে, সে নির্বাচনে সাধারণ ভোটার কাকে বেছে নিতে পারেনÑ এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে মাঠ পর্যায় থেকে জানা গিয়েছিল নিজাম অপেক্ষায় সাজনু সাধারণ মানুষের পছন্দে যোজন যোজন এগিয়ে ছিলেন। ফলে এই দুজন যদি ভোটের মাঠে মুখোমুখি হোন তাহলে সাজনুর বিজয় হওয়ার সম্ভাবনাই সব থেকে বেশি। আর তা হলে পরাজিত হতে পারেন শামীম ওসমান সমর্থিত প্রার্থী শাহ্ নিজাম। এমন সম্ভাবনা দেখা দেওয়ার পর ফের সামনে চলে আসে মামলা সংক্রান্ত জটিলতা। আবারও স্থগিত হয়ে যায় এই উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। এতে করে এই অঞ্চলের লাখো মানুষ ফের হতাশ হয় আরও একবার।
যদিও স্থানীয়রা বলছেন, সাংসদ শামীম ওসমানের অনাগ্রহের কারণেই সদর উপজেলা নির্বাচন শেষ পর্যন্ত আর হয়নি। তারা মনে করেন, প্রার্থীতা নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হওয়ার কারণেই তিনি এই নির্বাচনে আগ্রহ দেখাননি। যদি তার আগ্রহ থাকতো তাহলে এই মামলা পুনরায় সামনে আসতো না। কেননা, যারা মামলা করেছেন তারা সকলেই বর্তমান চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ বিশ^াসের লোক। এবং এই আজাদ বিশ^াস সাংসদ শামীম ওসমানের কথার বাইরে যাওয়ার লোক নন। ফলে তিনি চাইলে অথবা আজাদ বিশ^াসকে নির্দেশ দিলে যে মামলা ফের সামনে এসেছে তা তুড়িতেই উঠে যেত বলে মনে করেন স্থানীয় ভোটাররা। তারা বলছেন, এখনও যদি তিনি সদিচ্ছা পোষণ করেন তবে, মামলা সংক্রান্ত যে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে তা তুড়িতেই শেষ হয়ে যাবে।
এদিকে একটি সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে মামলা সংক্রান্ত জটিলতা দূর হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। সাংসদ শামীম ওসমানও নাকি চাচ্ছেন নির্বাচন হোক। তিনি দেশে ফিরলেই এ ব্যাপারে যে কোনো একটা সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। আর সেটি হলেও সেপ্টেম্বর নাগাদ। এখন দেখার বিষয় শেষ পর্যন্ত কী হয়। জেলার গুরুত্বপূর্ণ এই উপজেলা পরিষদের নির্বাচনী দ্বার উন্মুক্ত হয় নাকি আগের মতই রূদ্ধ থাকবে।