আজ বৃহস্পতিবার, ১১ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৬শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

ঝুঁকিতে ফতুল্লার বিসিক

স্টাফ রিপোর্টার :
অপরিকল্পিত ভাবে গড়ে উঠা ফতুল্লার বিসিক শিল্পনগরী এখন ঘিঞ্জি এলাকায় পরিণত হয়েছে। পর্যাপ্ত অগ্নি নির্বাপন ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকার পাশাপাশি ঘিঞ্জি এলাকায় পরিণত হওয়ায় শিল্পাঞ্চলে যেকোনো সময়েই ঘটতে পারে ভয়াবহ দূর্ঘটনা। বোদ্ধা মহল বলছেন, এমনটা ঘটলে ম্যাসাকার হবে বিসিক শিল্পাঞ্চল। সম্ভাব্য সেই দূর্ঘটনা রোধে বিসিক শিল্পনগরীকে ঢেলে সাজানোর বিকল্প পথ দেখছেন না বিশেষজ্ঞ মহল এবং সচেতন ব্যবসায়ীরাও।
জানা গেছে, গত রোববার বিসিক শিল্পাঞ্চলের শাসনগাঁও এলাকায় তিতাস গ্যাসের পাইপ থেকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। আগুণ ছড়িয়ে পড়ার আগেই গ্যাস বন্ধ করে দেয়ায় বড় দূর্ঘটনা থেকে রেহায় মিলেছে। যদিও আশপাশের কয়েকটি দোকান পুড়ে ভস্মীভুত হয়েছে।
স্থানীয়রা বলছেন, যেখানে আগুন লেগেছিল, তার কিছু দূরে বেশ কয়েকটি কারখানা ছিলো। কোনো ভাবে কারখানা পর্যন্ত আগুন গেলে মুহুর্তেই তা ছড়িয়ে পড়ার জোরালো সম্ভাবনা ছিল। এমনটা হলে আগুনের ব্যাপকতা যেমন বৃদ্ধি পেত, তেমনই ক্ষয়-ক্ষতির পরিমানও বাড়তো বহুগুণে। এর সাথে ছিলো প্রাণহানীর শঙ্কাও। ভবিষ্যতে এমন অগ্নিদূর্ঘটনা প্রতিরোধ করতে এখনই ব্যবস্থা গ্রহণের বিকল্প নেই বলে মনে করেন সচেতন মহল। তারা বলছেন, ভয়াবহ কোনো ট্র্যাজেডির আগেই বিসিককে পরিকল্পিত ভাবে গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। সেই দাবি বাস্তবায়নে কী আদৌ সোচ্চার হবেন সংশ্লিষ্টরা? এমন প্রশ্ন উঠলেও দায়িত্বশীলদের নীরবতা যেন ভাঙছেই না।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, ১৯৯১ সালে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় বিসিক প্রতিষ্ঠিত হয়। ৫৮ দশমিক ৫২ একর জমির এ শিল্পনগরীতে শিল্প প্লটের সংখ্যা ৭৪১। এর মধ্যে বরাদ্দ হয়েছে ৭৪০টি। বরাদ্দকৃত প্লটের মধ্যে ৪২৯টি শিল্প ইউনিটের ৪২০টি উৎপাদনরত, তিনটি বাস্তবায়নাধীন ও ছয়টি শিল্প ইউনিট রুগ্ন অবস্থায় রয়েছে। এ শিল্পনগরীতে প্রায় ২ লাখ ২৯ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। এর মধ্যে ১ লাখ ১৩ হাজার পুরুষ ও ১ লাখ ১৬ হাজার নারী শ্রমিক রয়েছে বলে বিভিন্ন তথ্য উপাত্তে জানা গেছে।
এই লাখো শ্রমিকের কর্মস্থল ফতুল্লার বিসিক শিল্পনগরী এখন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অভাবে ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বিসিকের প্রায় ৮০ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্ত অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। পর্যাপ্ত পানির উৎসের ঘাটতি এবং কারখানার ভবনগুলোর অবকাঠামোগত ব্যাপক ত্রুটিও বিদ্যমান। প্রতিষ্ঠানগুলোতে অগ্নিকাণ্ড মোকাবেলায় পানির রিজার্ভ বা অন্যান্য উৎস নেই। পুকুর যেমন ভড়াট হয়েছে, তেমনই খালগুলোও দখল দূষণের কবলে পড়ে অস্তিত্ব হারিয়েছে বহু আগেই। এছাড়াও পরিকল্পিত ভাবে ভবন গড়ে তোলা হয়নি। ফায়ার সেফটি আইনের হিসেব ধরলে ফতুল্লার ৮০ শতাংশ প্রতিষ্ঠানই অগ্নি ঝুঁকিপূর্ন। বিসিকের বর্তমান প্রেক্ষাপট অনুযায়ী এখানে ফায়ার প্ল্যান শতভাগ নিশ্চিত করাটা হুট করে সম্ভবও নয়। যতটা সম্ভব ততটাও করছেন না মালিকপক্ষ। প্রতিটি ভবনে পৃথক দুটি সিঁড়ি প্রয়োজন থাকলেও বিসিকে ডাবল সিঁড়ি সংবলিত ভবন বা কারখানার সংখ্যা খুবই কম। যেসকল প্রতিষ্ঠানে ডাবল সিঁড়ির ব্যবস্থা নেই, সেসকল প্রতিষ্ঠানে তা করতে গেলে ভাঙতে হবে ভবন। তা আবার নির্ভর করছে ওই ভবনের ইমারত বা অবকাঠামোর নকশার উপর।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলছেন, ফায়ার সেফটি প্ল্যান বাস্তবায়ন করতে হলে ঢেলে সাজাতে হবে বিসিক শিল্পাঞ্চলকে।
একই কথা জানিয়েছেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বিকেএমইএ’র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। দৈনিক সংবাদচর্চাকে তিনি বলেন, ‘বিসিককে এখন ঢেলে সাজানোর বিকল্প নেই। সেই লক্ষ্যে বিসিক কর্তৃপক্ষ ও ফায়ার সার্ভিসকে উদ্যোগ নিতে হবে। এখানে সেন্ট্রাল ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপন এবং পুকুরের জায়গায় পুকুর বানিয়ে কাজ করতে হবে। বিসিকের অনেক বিল্ডিংয়েই ফায়ার সেফটির ইকুইপমেন্ট বা ফায়ার সেফটির ব্যবস্থা পুরোপুরি নেই। কারণ ৩ কাঠার যেই প্লট সেই প্লটের মধ্যে টোটাল সেফটি ব্যবস্থা নিশ্চিতকরে বিল্ডিংগুলো করা হয়নি। এগুলো সব পুরনো বিল্ডিং। আমরা সকল ব্যবসায়ীদের পরামর্শ এবং প্রস্তাব রেখেছি যে, ৪টি প্লট একত্রিত ভাবে জয়েন্ট বিল্ডিং করে ফায়ার সেফটির বিধি মেনে নতুন ভাবে বিল্ডিং করতে। বিসিকটাকে ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। এজন্য বিল্ডিংগুলো ভেঙে পরিকল্পিত ভাবে করতে হবে। কারণ যেভাবে অগ্নি ঝুঁকি দেখা দিচ্ছে, তাতে বিকল্প কোনো পরিস্থিতি নেই। এখানে যেকোনো সময়ে অগ্নিকাণ্ডের মাধ্যমে ম্যাসাকার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আমি মালিকদের এই বিষয়ে প্রস্তাব বা পরামর্শ দিয়েছি। এখন বিসিক কর্তৃপক্ষ ও ফায়ার সার্ভিস যদি উদ্যোগ নেয় তাহলে এটা বাস্তবায়ন হতে পারে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আসলে বিসিকে যখন বিল্ডিংগুলো নির্মাণ হয়, তখন এমন ফায়ার সেফটি আইনের বালাই ছিলো না। তাই কোনো পরিকল্পনা মোতাবেক ভবন হয়নি। এখন ঝুঁকির বিষয়টি সামনে রেখে আইন হয়েছে। কিন্তু ভবনগুলোতো সেই পুরনোই রয়ে গেছে।’
বিসিককে পরিকল্পিত ভাবে গড়ে তুলতে সমন্বিত উদ্যোগের প্রস্তাব রেখে মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘এই বিষয়ে জেলা প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস, কলকারখানা অধিদপ্তর, বিসিক কর্তৃপক্ষ ও ব্যবসায়ী সংগঠনের সমন্বিত উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।
এই বিষয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাহমুদুল হকের কাছে জানতে চাইলে তিনি দৈনিক সংবাদচর্চাকে বলেন, ‘অগ্নিঝুঁকির বিষয়গুলো দেখার জন্য আমরা একটা কমিটি করেছি। সেখানে ফায়ার সার্ভিস, পরিবেশ অধিদপ্তর, তিতাস, ডিপিডিসি এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা আছেন। এই কমিটির মাধ্যমে আমরা বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে দেখছি যে, তাদের অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা সঠিক বা পর্যাপ্ত আছে কিনা। যেসকল প্রতিষ্ঠানে ফায়ার সেফটি ব্যবস্থা নেই, সেসকল প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষকে আমরা সতর্ক করার পাশাপাশি উদ্বুদ্ধ করে যাচ্ছি। অন্যথায় আমরা জরিমানা করার মাধ্যমে আইন প্রয়োগ করছি। এসকল বিষয়গুলো মনিটরিংয়ের জন্য কমিটি করা হয়েছে। আমাদের কমিটি মাঠে কাজ করছে।’