সংবাদচর্চা রিপোর্ট :
বারো মাসেও পুর্ণাঙ্গ হয়নি নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামীলীগের কমিটি। ফলে দুই নেতা পার করে দিয়েছেন দীর্ঘ এই সময়। অভিযোগ রয়েছে,আভ্যন্তরীন কোন্দল, শীর্ষ নেতাদের মধ্যে বলয় সৃষ্টির মিশন, নেতায় নেতায় দ্বন্দ্ব, পদ বাণিজ্যসহ নানা কারণে আলোর মুখ দেখছে না নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামীলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি। তাছাড়া কমিটি নিয়ে দুই ধারায় বিভক্ত সভাপতি আব্দুল হাই ও সাধারণ সম্পাদক আবু হাসনাত শহিদ মো: বাদল। তারা দু’জনেই পৃথক পৃথক ভাবে ৭৫ সদস্যের প্রস্তাবিত পূনাঙ্গ কমিটি কেন্দ্রে জমা দিয়েছেন। এছাড়া দুই কমিটিতে বাদ পড়ার আশঙ্কায় নাসিক মেয়র আলাদাভাবে তার বলয়ের নেতাদেরও একটি তালিকা কেন্দ্রে জমা দিয়েছেন। ফলে পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে নিজস্ব বলয় সৃষ্টিতে নেতানেত্রীদের মধ্যে চরম এক প্রতিযোগিতা চলছে। এমন পরিস্থিতিতে শেষ পর্যন্ত কমিটি ঘোষণা হলে পদবঞ্চিতদের মধ্যে বিরোধ প্রকাশ্যে রূপ নিবে। যার প্রভাব পড়বে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর প্রচারের ক্ষেত্রে। এ জন্য ঝুলে আছে কমিটি ঘোষণা। এমনটা মনে করছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। যদিও বিগত কমিটি কেন্দ্র থেকে ঘোষণা দেয়ায় তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল। তাদের মতে, মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা জেলার নেতা নির্বাচন করবে। যারা দলের জন্য নিবেদিত প্রাণ, দলে যাদের ত্যাগ আছে। কিন্তু কেন্দ্র থেকে এমন নেতাদের কমিটিতে অন্তভুক্ত করা হয়, যাদের পিছনে কর্মী নাই। ‘ওয়ান ম্যান শো’ নেতা হিসেবে তারা পরিচিত। যার কারণে একদিকে দলের সাংগঠনিক ভীত মজবুত হয় না অন্যদিকে দলীয় কর্মসূচিতে নেতাকর্মীর সমাগম আশানুরূপ হয় না।
এদিকে ১৯ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জ জেলা ও মহানগর আওয়ামীলীগের ব্যানারে বিশেষ বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হয় নারায়ণগঞ্জ আদালতপাড়ায় জেলা প্রশাসনের সার্কিট হাউজে। ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন নারায়ণগঞ্জের সাংগঠনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম এমপি। সভায় জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি আব্দুল হাই ও সাধারণ সম্পাদক ভিপি বাদল উপস্থিত ছিলেন। পুর্নাঙ্গ কমিটি থাকলে হয়তো জেলা আওয়ামীলীগের আরও নেতা উপস্থিত থাকতেন। কিন্তু তা সম্ভব হয়ে উঠেনি । সভায় শামীম ওসমান জেলা আওয়ামীলীগের কমিটিসহ আরও যে সকল সহযোগি সংগটনের কমিটি নাই তা নিয়ে মির্জা আজমের দৃষ্টি আকর্ষন করে বক্তব্য রেখেছেন। কিন্তু নির্বাচনের আগে সেই সহযোগি সংগঠনগুলো নতুন কমিটি পবে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে বলে বর্ধিত সভার একাধিক সূত্র জানিয়েছেন।
ওদিকে শুরু থেকেই টানাপড়ন চলছে সবশেষ সম্মেলনে ঘোষিত সভাপতি আব্দুল হাই ও সাধারণ সম্পাদক আবু হাসনাত শহিদ মো: বাদলের মধ্যে। নির্দেশনা ছিল তারা সবার সঙ্গে আলোচনা করে জেলা আওয়ামলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি কেন্দ্রে জমা দিবেন। তারপর কেন্দ্র যাচাই-বাছাই করে সেই কমিটি অনুমোদন দিবেন। কিন্তু তারা পূর্ণাঙ্গ কমিটির খসড়া তৈরীতে একমত হতে পারেননি। ফলে দুই নেতা দিয়েই চলছে জেলা আওয়ামীলীগ।
দলীয় তথ্যমতে, দীর্ঘ ২৫ বছর পর গত বছরের ২৩ অক্টোবর ইসদাইর পৌর ওসমান স্টেডিয়ামে জেলা আওয়ামী লীগ-এর জমজমাট ত্রি-বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এমপিসহ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা। সেদিন সম্মেলনে ওবায়দুল কাদের এমপি আগামী তিন বছরের জন্য দ্বিতীয়বারের মতো আবদুল হাইকে সভাপতি ও আবু হাসনাত মো. শহিদ বাদলকে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নাম ঘোষণা করেন। একই সঙ্গে আগামী একমাসের মধ্যে তাঁদের পূর্ণাঙ্গ জেলা কমিটির খসড়া তালিকা কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু নিজেদের মধ্যে মতপ্রার্থক্য ও নানাবিধ সমস্যার কারণে সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি আবদুল হাই ও সাধারণ সম্পাদক এড. আবু হাসনাত মো. শহিদ বাদল পৃথক পৃথক ভাবে ৭৫ সদস্যের প্রস্তাবিত পূর্ণাঙ্গ কমিটি তৈরি করে তা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে জমা দিয়েছেন। নাসিক মেয়র ডা. সেলিনা হায়াত আইভী কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে দেখা করে তার বলয়ের নেতাদের একটি তালিকা জমা দিয়েছেন। এছাড়া নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের এমপি শামীম ওসমান, নারায়ণঞ্জ-১ আসনের এমপি গোলাম দস্তগীর গাজী, নারায়ণগঞ্জ-২ আসনের এমপি নজরুল ইসলাম বাবুও তৎপরতা চালাচ্ছেন জেলা আওয়ামীলীগের কমিটিতে নিজের বলয়ের লোকদের অন্তভুক্ত করতে। মজার বিষয় হচ্ছে, শীর্ষ নেতাদের বলয় সৃষ্টির প্রতিযোগিতায় হাইবিট আর সুবিধাভোগী নেতারা নিজেদের জায়গা করে নেয়ার মিশনে রয়েছেন।
দলীয় সূত্রমতে, নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামীলীগের সর্বশেষ সম্মেলন হয় ১৯৯৭ সালের ২০ ডিসেম্বর। অধ্যাপিকা নাজমা রহমান সভাপতি ও এমপি শামীম ওসমান সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন। এরপর ২০০২ সালের ২৭ মার্চ নারায়ণগঞ্জ-৫ (সদর-বন্দর) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এস এম আকরামকে আহ্বায়ক করে কেন্দ্র থেকে ৬১ সদস্যের একটি আহ্বায়ক কমিটি করে দেওয়া হয়। ২০১১ সালের ৩০ অক্টোবরের সিটি নির্বাচনের পর আহ্বায়ক এস এম আকরাম আহবায়কের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। পরে ভারপ্রাাপ্ত আহ্বায়ক করা হয় যুগ্ম-আহ্বায়ক মফিজুল ইসলামকে। ২০১৪ সালের ১১ ফেরুয়ারিতে মফিজুল ইসলাম মারা যান। এরপর ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জ জেলা পরিষদের তাৎকালীন প্রশাসক বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হাইকে সভাপতি এবং সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীকে সিনিয়র সহ-সভাপতি ও এড. আবু হাসনাত মো. শহীদ বাদলকে সাধারণ সম্পাদক করে তিন সদস্য বিশিষ্ট জেলা আওয়ামীলীগের আংশিক কমিটি ঘোষণা করে কেন্দ্র। এর ১৩ মাস পর ২০১৭ সালের ২৫ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের ৭৪ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি অনুমোদন দিয়েছিল কেন্দ্র। নানা কারণে সেই কমিটি তৃণমূলের নেতাকর্মীদের কাছে ব্যাপক সমালোচিত হয়েছে। এবার কেন্দ্র কেমন কমিটি ঘোষণা দেয় সেদিকে তাকিয়ে আছে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। কিন্তু সেটা আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে হবে কি না তা নিয়ে সন্দিহান নেতাকর্মীরা। ফলে আরও দীর্ঘ সময় দুই নেতা দিয়েই চলবে নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামীলীগ। এতে আওয়ামীলীগেরসাংগঠনিক অবস্থার বারোটা বাজলেও দুই শীর্ষ নেতার কিছু যায় আসে না। এমনটা মনে করছেন, তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।